Monday, February 27, 2023

পরাজগত


-          মৃত্যুর পরে কী?

-          সেটা তো জীবিতদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়

-          সত্যি কি তাই?

-          মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন?

-          কিছু বলতে চাইছি না, প্রশ্ন করছি।

-          এর জবাব তো সবাই জানে, ধার্মিক হলে, মানে সব ধর্মেই তো মৃত্যুর পরের সময় নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা আছে।

-          হুঁ, আমি আপনার মন্তব্য শুনতে চাই, যেমন মৃত্যুর পরের জগতে কেউ কি চাইলে জীবিত থেকেও যোগাযোগ করতে পারে?

-          ব্যাপার কী? এরকম অদ্ভূত একটা বিষয় নিয়ে আপনি কথা বলছেন হঠাত? এ ব্যাপারে আপনার কি কোন থিওরি আছে? আপনি তো যথেষ্ট যুক্তিবাদী মানুষ বলেই জানি সাদী ভাই।

-           বটেই, তবে সেদিন মরফুন, মানে মফু ফকিরকে নিয়ে জানতে চাইছিলে না? এই যে সে মৃত আত্মা বা অন্য সব অলৌকিক শক্তির সাথে কথা বলতে পারে বলে দাবী করে সেটা আসলে কী?

- হ্যাঁ

- তার থিওরিটা বলছি, বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। দেখো, মানুষ- বা শুধু মানুষ কেন কোন জীবিত প্রাণিই একসময় পৃথিবীতে ছিলো না, রাইট?

- হ্যাঁ

- এবং তারা কেউই একসময় পৃথিবীতে থাকবে না। 

- হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই।

- আর সবাই কিন্তু পৃথিবীতে বেশ কিছু ধাপ পার করে আসে, যেমন একটা গাছ ফলের বীজ থেকে মাটিতে আসে, চারা গাছ হয়, বড় হয়ে বৃক্ষ, গুল্ম ইত্যাদি হয়, আবার মরে গিয়ে পঁচে যায়, তার আগে সাইকেল চালু রাখতে মাঝে আরো কিছু বীজ দিয়ে যায়।

- হ্যাঁ

- পাখি হবার আগে থাকে ডিম, আর মানুষ  বা ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণিরা থাকে ভ্রুণদশায়, মায়ের পেটে- তাইতো?

- হ্যাঁ, আপনি আসলে কী…

- বলছি। আপনার নিজের কথাই ভাবুন, আপনি আপনার মায়ের পেটে ছিলেন অন্তত দশ মাস।

- কোন সন্দেহ নাই

- রাইট, কিন্তু তার কোন স্মৃতি কি আপনার আছে?

- না,থাকার কথাও না, কারোর ই নেই।

- কিন্তু আপনি যে আপনার মায়ের পেটে ছিলেন সেটা কিন্তু অন্য সবার; মানে তখন যারা পৃথিবীতে ছিল তাদের মনে আছে, আপনার মা, বাবা মানে যারা যারা দেখেছেন, এমন কি মেডিক্যাল টেস্ট এ চাইলে সেসময়ের ছবি তুলে আপনাকেও দেখা গেছে।

- হ্যাঁ

- মফুর মতে মায়ের পেট বা ভ্রুণদশা যেমন একটা ধাপ, এই পৃথিবী যেমন আরেকটা, মৃত্যুও তেমনি এরকম একটা দশা ছাড়া কিছুই না। মায়ের পেটে থেকে আপনি যেমন পৃথিবী কেমন তা বুঝতে পারতেন না, তেমনি আমরাও মৃত্যু কেমন তা বুঝতে পারি না, মানুষ পরের ধাপটা আগে থেকে আঁচ করতে পারে না। কিন্তু-

- কিন্তু?

- কিন্তু আগের ধাপটা পারে, যেমন আপনি যে গর্ভে ছিলেন তা পৃথিবীর অনেকেই জানে ও মনে করতে পারে।

- তার মানে, তার মানে?

- হ্যাঁ, তার মতে মৃতদের জগত থেকে চাইলে আত্মারা আমাদের দেখতে পারে, শুনতে পারে। আমরা তাদের দেখি না, মৃতদের জগত থেকে তারা কেউ কেউ আমাদের পৃথিবীতে যোগাযোগ ও করতে পারে। ঠিক যেমন আমরা ভ্রুণ দশায় থাকা কোন প্রাণীকে চাইলে রেকর্ড করতে পারি, ছবি তুলতে পারি। এমন কি শব্দ শোনাতে পারি। গর্ভে থাকা বাচ্চা কিন্তু সুন্দর মিউজিক শুনে সাড়া দেয়। চিৎকার, কান্না ইত্যাদি শুনলে সে কষ্ট পায়। জন্মাবার পরে অবশ্যই তা আর মনে থাকে না।

- তাতো হবেই, সে তো সে সময় তার মায়ের প্লাসেন্টায় যুক্ত।

- প্রতিটি মাত্রাই নাকি এরকম কোন না কোনভাবে যুক্ত। আর মৃত্যু এরকম একটা মাত্রা থেকে আরেক মাত্রায় প্রবেশ মাত্র। যদিও তখন আপনি আর আপনি থাকবেন না, আপনার এই জীবনের স্মৃতি থাকবে না। এখন মফুর কথা হল চাইলে এই জগত থেকেও কেউ কেউ পরের জগতে যোগাযোগ করতে পারে! আর এই যোগ টা হয় মূলত স্বপ্নের মাধ্যমে। আপনার সচেতন আর অবচেতন যখন মিলেমিশে একাকার। সবাই পারে না, কারো কারো ব্রেইন এরকম থাকে। তারাই মিডিয়াম। আর এই ক্ষমতা বাড়াতে কিছু ড্রাগ হেল্প করে। যেমন একটা প্রচলিত ব্যাপার আছে জানেন তো যে সিনথেটিক বেইজড ড্রাগ নিলে কারো কারো সেই মাতৃগর্ভের সময়ের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়? মফুও এরকম ভাবেই আরেক মাত্রায় যোগাযোগ টা করে।

- অথবা পুরোটাই এক ড্রাগ এডিক্টের মতিভ্রম। হাহাহা! ভালই মজা নিলেন ভাই যাই বলেন। আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, গড!

- না, না, মজা নেইনি। আর আপনাকে এটা মানতেও বলছি না। তবে এটা মফুর দাবী। আর সে তার ভিশনগুলি কভাবে পায় আর আমার কেসে সাহায্য করে সেটা যতদিন অন্য কোন ভাবে ব্যাখ্যা না পাচ্ছি এটাকেই একটা ব্যাখ্যা ধরে রাখতে হচ্ছে।

- আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করছেন এটা?

- অবিশ্বাস ও করছি না। বিভিন্ন কেসে মফু আমাকে অদ্ভূত ভাবে সাহায্য করেছে। কোন একটা ক্রাইম সিনে গেলে সে আশে পাশের বিভিন্ন বস্তুর থেকে কোন একটা অদ্ভূত উপায়ে সূত্র বের করে। তার মতে সে নাকি একটা ‘সোয়াদ’ মানে স্বাদ পায়। কখনও গন্ধ কখনো মুখের স্বাদ, আর তা থেকেই পুরো ঘটনাটা, মানে ক্রাইমটা কিভাবে ঘটলো তা সে বলে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেটা মিলেও যায়।

- ওকে, লং লিভ টু মফু

- ইয়েস!

-মেহেদী হক

Sunday, December 11, 2022

আজদহা আর আলিশান খাঁ

মেহেদী হক

চন্দনগড়ে আজ ক’দিন ধরেই থমথমে উত্তেজনা, কিসের একটা চাপা ভয় চারিদিকে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই উত্তরের হাট বন্ধ করে দিচ্ছে মহাজনেরা। ঝাউতলার যাত্রাপালা আর বসছে না, বাচ্চারা রাতে আর কাঁদছে না, চ্যাংড়া বখাটেরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? ব্যাপার হল গুজব রটেছে তেপান্তরের ওইপাড় থেকে (যেখানে কেউ যায়নি কিন্তু সেটা যে আছে সবাই জানে) আজদহা নেমে এসেছে এই পাড়ে!

আজদহা কী?

আজদহা হল বিরাট এক সাপ, যার বড় বড় ঠাণ্ডা লেবুর মত  সবজে চোখ, কটকটে তীক্ষ্ণ তিমি মাছের কাঁটার মত দাঁত। নিশ্বাস যেখানে পরে সেখানে গর্ত হয়ে যায়, গর্ত সাথে সাথে ভরে ওঠে পাতালের কালো পানিতে আর তাতে ঘুরতে থাকে ছোট ছোট কুমিরের মত কাঁটাল মাছ।

আজদহা একশো বছর ঘুমিয়ে থাকে, আর ঘুম ভাঙ্গলেই হাভাতের মত চারদিক গিলতে গিলতে নাকি ছুটে আসে। আশেপাশে যা পায় তার আর বাছবিচার করেনা, হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, খরগোষ, মোষ, মুষিক, খড়ের গাদা, চালের নাড়া, তাল গাছ, শাল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ- সোজা কথা সব গিলতে গিলতে বড় বড় লেবু রঙা দুই চোখ খুলে সে আসছে, এদিক ওদিক নিশ্বাস ফেলে ফেলে বিষম গর্ত করে করে চারিদিক ফুটিফাটা। ও হ্যাঁ তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারের কথাই তো বলা হয়নি, সেটা হল- মানুষ! মানুষ যদি পায় তবে নাকি সে সব কিছু ফেলে তার পিছনে ছোটে। তেপান্তরের এই পাড়ে (যেখানে মানুষেরা থাকে আরকি) মোটামুটি সব রাজ্যের মানুষ নাকি ইতিমধ্যে আজদহার পেটে চলে গেছে, এমন খবরই সেদিন চন্দনগড়ের রাজপথে ধরে ছুটে আসতে আসতে রাজা গদাধরের প্রধান চর বিটকেল বর্গি চিতকার করে বলছিলেন। সেই থেকে রাজ্যের আর কারও জানতে বাকি  নেই যে আজদহা চলে এলো বলে।

পরের ঘটনায় যাবার আগে রাজা গদাধরের কথা একটু বলতে হয়। নামে গদাধর হলেও গদা টদা তিনি খুবই ভয় পান। সারাদিন নিজের কামরায় ঘাপটি মেরে শুয়ে বসে থাকেন আর চারবেলা ভূড়িভোজ করেন। রাজ্যের যে অবস্থা তাতে যে এরকম বিলাসব্যাসন করাটা খুব ভালো আইডিয়া তা না। কোনরকম রাজকার্য না করে করে আর খাজনা-(ঘুষ) ইত্যাদি না তুলে তুলে রাজকোষও তেপান্তরের মাঠ। এদিক ওদিক থেকে ধারদেনা করে করে চালাচ্ছেন, এই করতে করতে ইদানীং অন্য রাজ্যের রাজারা ধারও দিতে চাচ্ছে না। আর অন্যদিকে অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির বলে রাজার আজ পর্যন্ত কোন রানীও হয়নি। বিয়ের পয়গাম হয়, আয়োজন হয় কিন্তু মূল অনুষ্ঠানে বরের খবর নেই, না তিনি নাকি নিজের কামরায় বসে বসে আখ চিবাচ্ছেন, এরকম একাধিক চেষ্টা (তেপান্তরের) মাঠে মারা যাবার পর প্রধান উজীর সুগম্ভীর ভদ্র হাল ছেড়েছেন। ওদিকে ভুষণ্ডির রাজা গোগণ্ডগোল হুমকী দিয়েছেন তাঁর পাওনা ফেরত দিতে না পারলে অচিরেই চন্দনগড় সে দখল নিতে আসবে। কারণ এদ্দিনে যা ধার দিয়েছেন তা দিয়ে নাকি দুইটা চন্দনগড় সব মানুষসুদ্ধ কেনা সম্ভব। যাই হোক এসব কিছুর পরেও জনগণের প্রবল অপ্রিয় হলেও চন্দনগড়ে তার প্রতিপক্ষরা তার চেয়েও ক্যাবলাকান্তি বলে সবাই অগত্যা তাঁকেই মেনে নিয়ে কষ্টে সৃষ্টে চলছেন। বরং রাজা অন্যমনস্ক বলে মাঝে মাঝেই ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি মেরে অনেকে বেশ ভালোই আছেন বলা যায়।

তো এইরকম জোড়াতালি দিয়ে দিয়ে তাও চলেই যাচ্ছিলো, তা এর মধ্যে হঠাত বলা নেই কওয়া নেই চলে এলো আজদহা। যাকে কেউ দেখেনি, কিন্তু আজন্ম শুনে আসছে যখন আছে তো বটেই। দাদা পরদাদা থেকে শুনে আসা জলজ্যান্ত গল্প সব, প্রাচীন পুঁথিতে কাঁচা হাতে কিছু আঁকিয়ে বড় করে এঁকেও রেখেছে তার ছবি, একেবারে ভিরমি কাটার মত ছবি বটে। তাই ক’দিন ধরে সবাই একটু তবদা মেরে আছে।

কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না, কিছু একটা করতে হবে। উজীর সুগম্ভীর ভদ্র শেষে থাকতে না পেরে রাজা গদাধরের কামরায় এলেন।  রাজা তখন নিবিষ্ট মনে একটা ঢাউস সাইজের তালমিছরির টুকরো মনযোগ দিয়ে চাটছেন। আবেশে চোখ প্রায় ঢুলু ঢুলু এমন সময় সুগম্ভীর তাঁর জলদগম্ভীর গলায় বললেন-

রাজামশাই!

কে? কে? আচমকা আওয়াজ শুনে হাত থেকে মিছরির তাল পড়ে গেল মাটিতে, সাথে সাথেই রাজার খাস ভৃত্য কুড়াই সেটা কুড়িয়ে আবার পাতে তুলে রাখলো।

গলা খাকারি দিয়ে সুগম্ভীর বললেন- জ্বী আমি, বলছিলাম কিছু একটা করতে হয় এবারে।

-         কী বিষয়ে?

-         আজদহা।

-         ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা কী করা যায়?

-        আবার গলা খাকারি দিয়ে খাস ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলেন উজীর। রাজা সেটা দেখতে পেয়ে হাতের ইশারা করলেন, ভৃত্য কুড়াই সাথে সাথে কামরা ত্যাগ করলো।

গলা নামিয়ে কাছে এসে উজীর বললেন-

-         রাজামশাই মার্সেনারি ভাড়া করুন।

-         মারছে কী?

-         মার্সেনারি- মানে ভাড়াটে পালোয়ান। সে আপনার হয়ে আজদহা মেরে দেবে।

-         কেন মেরে দেবে?

-         আপনি তাকে লোভ দেখাবেন, মেরে দিলে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা।

-         আরে আমার তো রাণী-ই নাই, রাজকন্যা কোত্থেকে আসবে? আর রাজ্যও তো যায় যায়।

-       তাহলে অন্য কোন একটা চাপা মারতে হবে। আমাদের যে রাজকোষ খালি তা তো আর সেই ভিনদেশি পালোয়ান জানবে না। শর্ত থাকবে। সে আজদহাকে মারতে গিয়ে মরে গেলে আমরা তার একটা মূর্তি বানাবো রাজদ্বারে আর বেচে গেলে রাজকোষ।

-         মরে গেলে তো মনে হচ্ছে ব্যাটার লাভ বেশী হবে। রাজদ্বারে মূর্তি সোজা কথা না। আর অর্ধেক রাজত্ব দিলে তো ঋণের অর্ধেক তাকেই দিতে হবে।

-       এগজ্যাক্টলি, আমার মতে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিন। যে আজদহাকে মারতে পারবে অর্ধেক রাজত্ব আর- ওই ইয়ে, না রাজকন্যা হচ্ছে না। যাই হোক ম্যানেজ করতে হবে একভাবে।

     কী নেজ?

-         ম্যানেজ- মানে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। শেষে ছোট করে একটা *শর্ত প্রোযোজ্য টাইপ কিছুও জুড়ে দেব। ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইলো, আমি এলান তৈরী করে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নিচ্ছি।

-         ফিং- কী?

-         আরে ধুরো, সব বোঝার দরকার নেই আপনি মিছরি খান।

এই বলে উজির সুগম্ভীর বের হয়ে পুরো চন্দনগড় জুড়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন যে যে আজদহাকে মেরে আসতে পারবে সে পাবে চন্দনগড়ের অর্ধেক রাজত্ব ও আরো অনেক ‘আকর্ষণীয়’ পুরস্কার। কিন্তু ঢেঁড়া পেটানোর পর দেখা গেল চন্দনগড়ের অর্ধের রাজত্ব নিয়ে কারো তেমন কোন উৎসাহ নেই। আকর্ষণীয় পুরস্কারেও কেউ খুব একটা আগ্রহী না। প্ল্যান মাঠে মারা যাচ্ছে আর ওদিকে শোনা যাচ্ছে আজদহা নাকি খুব কাছাকাছি চলে এসছে। উপায়ন্তর না দেখে উজীর সুগম্ভীর আরো গম্ভীর হয়ে এই সব ঢেঁড়া ট্যারা বাদ দিয়ে সরাসরি পালোয়ান ধরে আনার জন্যে চারিদিকে লোক পাঠালেন। একের পর এক ভাড়াটে পালোয়ান এল- তেপান্তরের দিকে গেল, কিন্তু- আর ফিরে এলো না। তার মধ্যে ছিল-

মুচড়া খান, (প্রতিপক্ষকে খালি হাতে মুচড়ে দেন) কটকটি সিং (অত্যন্ত কটকটে মেজাজ), মুগুর মালী (বাগানের মালী, বাগানে বাঘ এসে পড়ায় মুগুর পেটা করে সেটাকে তাড়ান তাই মুগুর মালী), তলোয়ার খাঁ (তলোয়ার এ সিদ্ধহস্ত) চাবিলাল (এর বিশেষত্ব ভালমত জানার আগেই তিনি আজদহার খোঁজে চলে যান ও আর ফিরে আসেন নি)। এরকম একের পর এক পালোয়ান এল আর গেল কিন্তু কেউ ফিরে এলো না। এদিকে চন্দনগড় মোটামুটি খালি হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে উজীর আদেশ দিলেন

-         আলিশান খাঁ কে খবর দাও, বলো যে সে রাজি হলে পুরো রাজত্ব!

আলিশান খাঁ হল গোটা সপ্তভূমির সবচেয়ে নামজাদা পালোয়ান, শোনা যায় খালি হাতে নাকি হাতি নিয়ে লোফালুফি করেন প্রতি সকালে। এক চুমুকে পুকুরের সব পানি খেয়ে ফেলেন (মাছসহ)। আস্ত সুপারী গাছ দিতে দাঁত খোঁচান। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল তাকে কেউ কখনো দেখেনি! তিনি নাকি থাকেন ভয়াল আন্ধারপোঁতা জঙ্গলে, কেউ যদি তার সাহায্য চায় তবে আন্ধারপোঁতা জঙ্গলের যে আলিশান বটগাছটা আছে তার নিচে একটা কাগজে নিজের সমস্যার কথা লিখে রেখে আসতে হবে। সমস্যাটা গুরুতর হলে তিনি সেটা সমাধান করে দেবেন। তবে বিনিময়ে কী চাই সেটা উনি তখনি না বলে সময়মত চেয়ে নেবেন। উজির সুগম্ভীরের লোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আন্ধারপোঁতার পাকুর বটের তলায় কোনমতে চিঠিটা রেখেই ছুট! আদৌ কাজ হল কি না তা দেখার সময় নাই, সাহসও নাই কারো। উজীর কে তা বলাও হল না।

চিঠি পৌঁছে দেবার পরে এবারে শুরু হল অপেক্ষার পালা, ওদিকে চন্দনগড়ের আশেপাশে মাঝে মাঝেই অদ্ভূত সব গর্জন শোনা যাচ্ছে, সবাই মোটামুটি নিশ্চিত আজদহা চলে এসেছে, আর সময় নাই। যারা এখনো ছিল তারাও এবারে দলে দলে চন্দনগড় ছাড়া শুরু করলো। উজীর সুগম্ভীর ও রাজা গদাধরকে  সহ পালাবার জন্যে জুড়ি গাড়ি পেছনের দরজার বেঁধে রেখেছেন। আর একদিন অপেক্ষা করবেন এর মধ্যে আলিশান খাঁ চলে এলে তো হল, সে যদি আজদহাকে মারতে পারে তবে তো রাজ্য তারই। আর যদি সে না আসে তাহলেও রাজ্য চলেই গেল। দেখা যাক, আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা শুধু।  


আন্ধারপোঁতা জঙ্গল।

ভোর হচ্ছে। পুবের আকাশে লালচে কমলা রঙ ধরেছে। একগাদা পাখী ক্যাঁচর ম্যাচর শুরু করেছে তাও সেই আঁধার থাকতেই। জঙ্গলের প্রবেশপথের ঠিক সামনেই এক বিরাট অবয়ব। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে ছোটোখাট একটা পাহাড় না হলেও টিলা, কিন্তু নড়ে উঠতেই বোঝা গেল এটা কোন একটা প্রাণি। প্রাণিটার মাথাটা যেন বিরাট এক পাথুরে টিলা, কুঁতকুঁতে চোখ, সারা গায়ে ঝলমলে কালচে আঁশ। মাথার যেখানে কান থাকার কথা সেখান থেকে হঠাৎ পাখির ডানার মত কানকো ধরনের কিছু একটা বের হয়েছে। হেমন্তের সকালে নিশ্বাসে যেন ধোঁয়া ফুঁড়ে বের হচ্ছে থেকে থেকে। এই সেই আজদহা! বিরাট এক নাগসর্প, আদতেই বিরাট বপু। মোটামুটি কয়েক রাজ্যের প্রাণিকূল খেয়ে সাবড়ে এই জঙ্গলের কাছে একটু বিশ্রামে থেমেছে সে, হুট করে আর কিছু করার ইচ্ছা নাই। দেখা যাক, চাইকি এখানেই পরের একশো বছরের জন্যে ঘুমটা শুরু করা যেতে পারে। গত কয়দিন বেশ কিছু হুমদো হুমদো পালোয়ান টাইপ মানুষ খেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। আজ একটা দারুণ ঘুম দেবার তোরজোড় করছে সে এমনি সময় হঠাত দূর থেকে কাউকে আসতে দেখা গেল। সাদা আলখাল্লা পরা টিংটিঙে এক লোক। দেখে হাসি পেল আজদহার, এত এত পালোয়ান এর পর এ আবার কে? একে তো খেয়েও সুখ হবে না।

কাছে আসতেই দেখা গেল গেরুয়া বরণ আলখাল্লা পরা এক সন্ত-সাধু, হতে একটা একতারা নিয়ে স্মিতমুখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে আসছে। আজদহাকে সে যেন চোখেও দেখেনি।

আর থাকতে না পেরে কৌতুক চোখে তাকিয়ে আজদহা হালকা গলা খাকারি দিল-

-         এহেম!

-         আরে, তুমি আবার কে? বলে উঠলো সাধু বা গায়ক লোকটা।

-         আমি আজদহা, সপ্তভূমির সর্বোচ্চ খাদক। একশো বছর ঘুমিয়ে থাকি। জেগে উঠে খাই একশো হাতি, দুইশো মোষ, চারশো হরিণ, ছয়শো

-         আরে আরে থামো থামো। তুমি দেখি কথা কইতে পারো, আজব কিসিম প্রাণি? তা এত ঘুমাও ই বা ক্যান আর এত খাও ই বা ক্যান?

-         আজদহা একটু থতমত খেয়ে বলে- কারণ এটাই আমার কাজ।

-         খালি খাওন আর ঘুমান? এই কইরা জীবন কাটাইবা? দুনিয়ার আর কিছু দেখবা না? শুনবা না?

-         দুনিয়ার আর কিসের কথা হচ্ছে? অবাক আজদহা।

-         এই ধরো ফুল, এই ধরো মেঘ, এই ধরো একটা ব্যাং চুপ কইরা বইসা রইলো নদীর পাড়ে। বা ধরো শিল্পকলা, যাত্রাপালা, নাচ, গান, আঁকিবুকি। তা গানটান জানো কিছু?

আজদহা তো হতবাক। গান? এ আবার কী? পান খায় শুনেছি, জান যায় শুনেছি, বান ডাকে তাও জানি, কিন্তু গান? এ আবার কী?

-         গান কী? আজদহা শুধায়।

-         শোনার জিনিস, শুনবা নাকি??

-         ব্যাথা পাবো না তো?

-         আরে না না, পাইলেও কইলজার মধ্যে হালকা পাইতে পারো।

আজদহা শুনে ভয় পেয়ে গেলে সাথে সাথে লোকটা তাকে আস্বস্ত করে

-         আরে না না এই ব্যাথা সেই ব্যাথা না। শোন তাইলে।

বলে একতারায় টুং টাং শুরু করে গায়ক বা সাধু। এরপর ভরা গলায় ধরলো গান, সেই গান শুনে আজদহার প্রাণ আকুলি বিকুলি। চোখে পানি ছলাৎ ছলাৎ, প্রাণে পানি শলাৎ  শলাৎ। কলজেতে সেই ব্যাথা চিন চিন। গান শেষে ছল ছল লেবুর মত সবুজ চোখ একেবারে বরফের মত সাদা বানিয়ে মুখ তুলে সাধু বা গায়ক লোকটাকে বললো

-         কী শোনালে ভাই, এতো যাকে বলে একেবারে যা-তা লেভেলের। বলো তোমার জন্যে কী করতে পারি আমি?

-         তোমার ভাল লাগছে- এই আমার পাওনা।

-         তারপরেও বলো কী চাই তোমার।

-         একটা করতে পারো, যত নিরপরাধ প্রাণীকে খাইছো তাদের ফিরায়ে দাও। প্যাটের জন্যে যা খাইছো ঠিক আছে, জিবের জন্যে যা খাইছো তা ফিরত দাও। তুমি তো তন্ত্রমন্ত্র জানো, চাইলেই পারবা।

আজদহা চুপ।

-         কি হইলো।

-         ইয়ে মানে হজম হয়ে গেছে। আর মন্ত্র একটা ছিল মনে হয়, সেই একশো বছর আগে মুখস্ত করছিলাম, ভুলে গেছি।

-         আইচ্ছা বাদ দাও। যারা গেছে গেছে, আইজ আর কাইল। মন্ত্র টন্ত্র লাগবো না। এইবার কী করবা?

-         আরো গান শুনাও আমাকে।

-         না আইজ আর না, আমারে ওইবেলা ফিরতে হবে। একটা শো আছে নিমপোতার মাঠে।

-         আমিও যাব। করুণ চোখে তাকিয়ে বলে নাগসর্প আজদহা।

-         আমি ঠিক করছি এখন থেকে গান গাইবো, তুমি শিখাবে আমাকে? এই একশো বছর পর পর এই একই জিনিস আর ভালো লাগে না।

-         গান শিখবা?

-         হুঁ।

-         আইচ্ছা, লও যাই, তয় ঘাসপাতা খাইতে হবে কিন্তু। মানুষ, ইন্দুর বান্দর সব বাদ।

আজদহা ঘার কাত করে সম্মতি জানালো। এতগুলি জন্তু জানোয়ার (ও মানুষ) হজম করে বেচারা একটু অফ খেয়ে আছে।

আজদহা বশ পর্ব কেমন গেল এ নিয়ে রাতে সভা বসেছে রাজা গদাধরের কামরায়। আলিশান খাঁর পোষা কবুতর এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেছে উজীর সুগম্ভীরকে। তাই নিয়ে তিনি আর রাজার কামরায়-

-         এই পালোয়ানও মারা গেছে?

-         যাক মূর্তি টুর্তি বানানো লাগবে না। রাজদ্বারে মূর্তিতে মূর্তিতে ছয়লাব। আর রাজত্ব?

-         চায় না।

-         পাগল নাকি?

-         তাই তো মনে হয়, অথবা বেশি বুদ্ধি।

-         সেকি তাহলে- তাহলে তো পুরা­-

-         হ্যাঁ, পুরা লোন আপনাকেই টানতে হবে। একটু থেমে যোগ করেন উজীর- ইন্টারেস্ট সহ।

রাজা আবার মুষড়ে পড়ে সজোরে মিছ্রির তাল চুষতে শুরু করেন।

সুগম্ভীর বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললেন

-         ইমোশনাল ইটিং।

আর আজদহা? সে আর সেই নাম না জানা বাউল (নাকি আলিশান খাঁ?) নাকি আজকাল সপ্তভূমির বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে শো করে বেড়াচ্ছে, আগে থেকে বুকিং না দিলে নাকি শোতে ঢোকার উপায় থাকে না।

Wednesday, November 16, 2022

যে তিনটি কারণে আমার উপন্যাসটি আজো লেখা হয়নি।

নাম্বার ১

নাম
প্রথম কারণটি আসলে কোন কারণ বলা যাবে না, বলা যায় কপালের ফের। কারণটা হল আমার নাম! আমার নাম মাহমুদুল হক। নামের কোন সমস্যা না, সমস্যা হল এই নামে আরেকজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আছেন। কালো বরফের লেখক- মাহমুদুল হক। তার মানে নিজের নামে লেখা শুরু করলে সেটা পরে গিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি ঝামেলার জন্ম দেবে, তখন  বলতে হবে কোন মাহমুদুল হক? কালো বরফ? নাকি কাপুরুষের জবানবন্দি' র মাহমুদুল হক? (আমি আমার উপন্যাস না লিখলেও সেটার একটা নাম ঠিক করে রেখেছি।) এই ঝামেলায় যাওয়াই যাবে না। নাম পালটে ফেলতে হবে। তাহলেই সব ঠিক। সমস্যাটা সেখানেই হল। উপন্যাসের খসড়া মনে মনে ভাবা শেষ, কিন্তু নাম আর খুঁজে পাই না। কী নাম দেব? অনিকেত হক? মৃদু নাসের? কৃষ্ণ হক? নাকি ভারি কোন নাম যেমন- নাভিয়ান আরমান মুরাদ? ভ র ম ইত্যাদি মিলে মিশে একটা থিক থাই স্যুপ ধরনের কিছু। কিন্তু শেষ মেশ আর পছন্দ হলই না কোন নাম। এবং সত্যি, ওই একটা কারণে আমার আর উপন্যাসের প্রথম লাইনটা আজো লেখা হয় নি! সুতরাং কারণ নাম্বার এক বললে এটাকেই লিখতে হবে।

নাম্বার ২

সারভাইকাল রিব এরর।
ইংরেজীতে বলার কারণে ব্যাপারটার একটা আলাদা গুরুত্ব এসছে, এবং ব্যাপারটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ না, ব্যাপারটা গুরুতর। যারা যারা ভাবছেন কেন আমি নাম ছাড়া নিদেনপক্ষে উপন্যাসটা বেনামে হলেও লিখে ফেললাম না তাঁদের জন্যে এই দুই নাম্বার কারণটা একটা উত্তর। ঠিক ধরেছেন, শুধু আপনি মনে মনে ভাবছেন যে ব্যাটা নাম বাদ দিয়ে জিনিসটা লিখে ফেলতি- তা নয়, আমি নিজে সেটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু 
ঠিক যেদিন আমি নাম ছাড়া লিখতে বসেছি ওপর থেকে প্রজাপতি হাসিমুখে চোখ টিপে বললেন, দেখি কিভাবে লিখিস- এবং লিখতে বসে টের পেলাম হাত নড়লেই চোখে অন্ধকার দেখছি। ঘাড় মাথা সব টরররর হয়ে যাচ্ছে। চোখে মুখে অন্ধকার। প্রচণ্ড বেদনা সারা ঘাড়ে। ডাক্তারের শরণে গিয়ে জানা গেল এটা কিঞ্চিত হাড় মুড়মুড়ি ধরনের ব্যামো বটে। এর গালভরা নাম সারভাইকাল রিব। স্রষ্টা আমাকে কম দেননি, বরং অন্যদের চাইতে বেশীই দিয়েছেন। আমার গলার কশেরুকা হাড়ের শেষটা দুইদিকে একটু বেশী বড়। যার ফলে ঝুঁকে কিছু লিখতে গেলে সেটা নার্ভে চাপ দেয়। আর চোখে মুখে অন্ধকার দেখা যায়। আগেও ছিলো বয়সকালে আস্তে আস্তে গোকুলে বেড়েছে। সময়মত, মানে কিনা ঠিক যখন বুকার টুকার সামনে প্রায় উঁকি দিলো বলে- তখনই ইনি ম্যাচিওর্ড করেছেন। এখন কোন উপায় নেই। এর অপারেশন খুবই রিস্কি। হয়ত দেখা গেল এটা ঠিক হয়ে গেল কিন্তু আমার বাম পাশের ঠোঁট আর চোয়াল ঝুলে গেল একপাশে। ভুল করে হয়ত অন্য কোন নার্ভে চাপ পড়ে গিয়েছিলো। নার্ভের তারগুলি নাকি অনেকটা বিটিটিবি টেলিফোনের এক্সচেঞ্জ বক্সের তারের মত। শুনে টুনে তাতে আর সায় দিলাম না। তার বদলে চল্ল টোটকা দাওয়াই। প্রথমে নামকরা ফিজিও থেরাপিস্ট ঘাড় টার টিপে টুপে বললেন, বাস- বুঝে গেছি। রমজান! একে দেড় কেজি ঝোলাও! সভয়ে তাকিয়ে দেখি চোঁয়ারে ধরনের  এক যমের অরুচী রমজান কোত্থেকে কি সব বাটখারা নিয়ে এল। সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় ঝোলাবেন? রমজান জিজ্ঞাস করলেন- সমস্যা কোথায়? ইয়ে, ঘাড়ে। তাইলে ঘাড়ে। মনে মনে আর কোন জায়গায় সমস্যা হয়নি বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। মোটামুটি মাসখানেক প্রায় প্রতিদিন মাথায় আর ঘাড়ে পেঁচিয়ে পুচিয়ে কিভাবে করে এই কেজি দুইয়েক বাটখাড়া ঝুলিয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হল। ঘাড় ব্যাথা তো ঘাড়ব্যাথা, পারলে ঘাড়টাই বিদায় নেয়। আয়নার সামনে তাকালে গলা লম্বা লম্বা লাগে ইদানীং। সব কষ্টই সহ্য করা যায় যদি লেখালেখি আবার শুরু করা যায়। কিন্তু না। বরং ব্যাথা দিন দিন বাড়ছেই। এদিকে যেই শুনছে সেই একটা অব্যার্থ ওষুধ বাতলে দিচ্ছে। কেউ বল্ল সাভারের সিআরপি তে চলে যাও, সেখানে যাবার সাথে সাথে বাতাস গায়ে লাগলেই নাকি ঠিক হয়ে যাবে। (কে যায় সেই সাভার?) কেউ বলে, ওই সব কিচ্ছু না, মেডিটেশন কর। আলফা লেভেলে গিয়ে ভাবো তোমার হাড় হাড্ডি কিছুই নেই, তুমি বালির দলা। (দুইদিন চেষ্টা করে ঘুমিয়ে পড়লাম, বেকায়দায় ঘুমিয়ে এবারে ঘাড়ের অন্যদিকে ব্যাথা শুরু হল)। আরেক আত্মীয় বুদ্ধি দিলেন এক চৈনিক চিকিতসকের কাছে যেতে। চিকিতসক একজন মহিলা, তিনি নাকি চাইনিজ সিস্টেমে কঠিন ঝাঁড়া দেন, আর বান টান কি জানি করেন। আমি অত পাগল হইনি যে চৈনিক ওঝার কাছে যাব। কিন্তু সেই আত্মীয়র ঘাড়েও এরকম কী একটা সমস্যা ছিলো আর তিনি নিজে উপকার পেয়েছেন। সুতরাং একটা ট্রাই নেয়া যাক। 

চৈনিক চিকতসার বিতং না বললে আসলে কেউ বুঝবেন না যে আমি লেখালেখি নিয়ে কতটা সিরিয়াস। চৈনিক চিকতসা আসলে কিছুই না, ফিজিওথেরাপির ঢঙে দলাই মলাই, দলাই মলাই করে চারজন মেয়ে (কেউ আগ্রহী হয়ে ঠিকানা চাইবেন না, এই চারজনের হাতের চাইতে লোহার পাত নরম)। এর পরে কিছু সাকশন কাপ বসিয়ে দেয়া হয় সারা গায়ে- আই মিন সা-রা গায়ে। সেগুলি বায়ুশূন্য করে দেয়া হয় ফলে নিচের ভেইনের রক্ত সব জমাট বেঁধে থাকে। এর পর যখন ছেড়ে দেয়া হয় তখন হঠাত করে দ্রুতবেগে আবার রক্ত চলাচল করে, ফলে একটা চনমনে বোধ হয়। এটা ছিলো থিওরি। আমার বেলায় থিওরি খাটলো না। দেখা গেল রক্ত আমার জমাট বেঁগে সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ছেড়ে দিলে সেটা আটকেই থাকছে। দ্রুত বেগে নামছে না। চৈনিক চিকিতসক- যাঁর বাংলাদেশি নাম আরজিন আরা, আসল নাম ওজিনো আরা। তাঁর ২৬ বছরের চর্চিত বাংলায় বললেন,

- কিচু গুলমাল মুনে অয়। টিক অই যাবে নো ছিন্তা ইয়াং মেন।

আমি বিমর্ষ মুখে এদিক ওদিক তাকাই, পাশের বেডে আরেক ছেলে আমার সমবয়সীই হবে, চারজন লৌহ মানবীর কিল ঘুষি খেতে খেতে আমাকে বল্ল- ভাই আপনার কেস কী? আমি জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেলাম। এবং ওইদিনই ছিলো আমার এক বন্ধুর জন্মদিনের দাওয়াত, আমাকে দেখে সে আঁতকে উঠলো। কারণ ঠিক কপালের মাঝ বরাবর একটা সাকশন কাপ দেয়াতে দেখতে হয়ছে অনেকটা সংশপ্তকের হুরমতির মত। গভীর কালচে লাল জমাট বাধা একটা গোল দাগ। এটার গ্রহণযোগ্য ব্যখ্যা অল্প পরিচিত কাউকে দেয়া সম্ভব, ছোটবেলার বন্ধুকে বিশ্বাস করানো কঠিন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একই সাথে জীবনের একটা সম্পদ ও তারচেয়েও বেশি জীবনের অভিশাপ। কপালের এই দাগের তাই অদ্ভূত, ভয়াবহ ও কুৎসিত সব ব্যাখ্যা বের হতে লাগলো। যাদের এরকম অভিশপ্ত বন্ধু আছে তারা আশা করি কিছুটা আঁচ করতে পারছেন, সেটা দশ দিয়ে গুণ করলে আমার সমস্যার কাছাকাছি একটা কিছু ধরতে পারবেন।

যাই হোক এই সব আজব আজব কারণে আমার লেখাটা শুরু হয়নি তখনো। তবে সুসংবাদ হল সব জড়িবুটি বাদ দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড এডযাস্টেবল বসার চেয়ার কেনার পরেই দেখা গেল আস্তে আস্তে হাড় মুড়িমুড়ি সমস্যাগুলি অনেকটা কাটা শুরু করলো। ব্যাস, হাতের ব্যাথার অজুহাত নেই, আর তদ্দিনে এক আঙ্গুলে টুকুরটাকুর করে ইউনিকোডে বাংলা হরফ টাইপ করাও মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেছে, কাগজে কলমে লেখার ব্যাপারটাও নেই, তাহলে?
তাহলে এর পর আর কী থাকতে পারে? কী কারণে তবে আর বসে থাকা? সেটাই আসলে দি এন্ড বা সাহিত্য সমাধি। বলা যাক তবে-

নাম্বার ৩

যদিদং হৃদয়ং তব
উপন্যাসের খসড়া মাথায় মাথায় দাঁড়া করানো আর সত্যি সত্যি লিখে ফেলা দুইটা দুই জিনিস তা লিখতে গিয়েই টের পেলাম। খালি সাদা মনিটর আর সেখানে ব্লিংক করছে একটা ছট্ট কালো কারসার। এটা যে কি ভয়াবহ দৃশ্য তা আশা করি লিখতে চেয়েও লিখতে না পারা অনেকেইউ বুঝতে পারবেন। দেখা গেল ঘণ্টা চলে যাচ্ছে একবার ও কি বোর্ড এ হাত দেয়া হচ্ছে না, এরপর থেকে দেখা গেল আমি লিখতে না পারার কারণে যে কোন কিছুতেই অন্য সবার দোষ খুঁজে পাচ্ছি, আর পাশাপাশি অনেক গুলি কারণ অলরেডি বের করে ফেলেছি যেমন একটা বলি-  আমি লিখতে পারছি না এর মূল কারণ আসলে পশ্চিম দিকের একটা বাড়ি যেটা নতুন সাদা রঙ করা হয়েছে সেটা। কারণ ঠিক যখন আমি নাস্তা টাস্তা করে নেট এ জীবনের অনেক সময় অপচয় করে পরে লেখার একটা মুডে আসি তখন ই সেই বিল্ডিং এ রোদ পরে প্রতিফলিত হয় চোখের মাঝে লাগে। এরকম অবস্থায় লেখা যায় না। টেবিল সরিয়ে দেখেছি তখন আবার অকারণে বাসার সবাই (যারা আমার সাহিত্য নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়) কোন কারণ ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করে। মন দিয়ে লেখা তখন একটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখন বুঝতে পারছি লেখকেরা কেন লেখার আগে একটা তারবিহীন টাইপ্রাইটার নিয়ে একটা দ্বীপের মধ্যে চলে যায়।

পর পর কয়েকদিন এই অবস্থা যাবার পরে আমার মেজাজ অনেকটা আমাদের বাসায় সামনের কালুর মত হয়ে গেল। যে কাউকে দেখলেই খ্যাঁ করে উঠছি, বা গরগর করছি শুধু কন্ঠনালীর কিছু সীমাবদ্ধতার জন্যে তাঁর মত পুরোদমে ঘেউ ঘেউ টা করা যাচ্ছে না। 

ঠিক এইরকম তুঙ্গ অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও মাথা ঠাণ্ডা করতে চলে গেলাম আবার সেই বন্ধুদের কাছে (যেটা আমার জীবনের আরেকটি বড় ভুল)। তারা আমাকে দেখা মাত্র বুঝে ফেললো কিছু একটা গড়বড়। হাজার হলেও বাবা মায়ের চাইতেও এই অভিশপ্ত বন্ধুরাই আপনাকে সবচে বেশি চেনে। শুনে টুনে তারা যেই বুদ্ধি দিল তা এইরকম-
আমার লেখা হচ্ছে না কারণ আমার কোন প্রেম হয় নাই, এবং সেই কারণে ছ্যাঁকাও খাই নাই। মহৎ সাহিত্য করতে গেলে প্রেম লাগে,যত বেশি প্রেম তত বড় সাহিত্য আর বিরাট কালজয়ী কিছু করতে গেলে লাগে ছ্যাঁকা। এইটার কোনটাই নাই বলে আমার লেখা টেখা হচ্ছে না আর হবেও না। 
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম।
- আমাকে এখন আমার উপন্যাস লেখার জন্য প্রেম করতে হবে?
- অবশ্যই!
- আর ছ্যাঁকা খাইতে হবে?
- সেইটা চেষ্টা করা লাগবে না খুব একটা।
- আচ্ছা যদি ছ্যাঁকা না খাই?
- তাইলে প্রেমটা তো হইল। সেটাই বা কয়জনের হয়।
অকাট্য যুক্তি। 

শুরু হল আমার সাহিত্য যাত্রা শুরুর অনুপ্রেরণা খোঁজার পালা।
না যতটা ভাবছেন অতটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ অনেকদিন থেকেই  যাকে বলবো বলবো ভাবছিলাম সেই সাদিয়াকে এবারে বলে ফেলার একটা দারুণ উপলক্ষ পাওয়া গেল। এমনিতে যেমন বুক দুরু দুরু গলা শুখু শুখু ব্যাপার থাকে এখন সেটা যেন কিছুটা কম। কারণ এখন জবাব টা 'না' হলেই বরং বাংলা সাহিত্যের জন্যে একটা বিরাট সুসংবাদ। দিনক্ষণ ও কিভাবে কী ইত্যাদি সব বাতলে দিল আমার এক বন্ধু, (যার এ পর্যন্ত মোট বান্ধবীর সংখ্যা ১৩)। তার কিছু টিপস এখানে তুলে দেই-

১। চোখে তাকাবি না, তাইলে তোর যে ব্যাক্তিত্ব নাই, আর একটা চিপা ছাগলা ক্যারেক্টার আছে সেটা আরো বেশি বোঝা যাবে। বেস্ট হয় সানগ্লাস পরে যাওয়া।
২। কোন সময় দেয়া যাবে না, বাইনারি সিস্টেমে রাজী আছো কি নাই- এই রকম একটা হ্যাঁ- না প্রশ্ন। সময় দিলেই মেয়েটা অনেক বাস্তব চিন্তা করবে আর বাস্তব চিন্তা করলেই সে তোর সাথে ঝোলার কোন যুক্তি পাবে না।
৩। বেশি কাঁদো কাঁদো ভাব দেখানো যাবে না, ভাব দেখাতে হবে আমার আরো বেশকিছু অপশন আছে, লিস্টে প্রথমে তুমি, রাজী থাকলে বলো, না থাকলে আমি পরেরজনের কাছে যাচ্ছি। ভদ্রতা করে লিস্টের শুরু থেকে শুরু করেছি।

এরকম আরো গোটা দশেক উপদেশ। আমার যেহেতু লক্ষ্য মহৎ ও কালজয়ী কিছু তাই আমি এগুলোর সব গুলির ঠিক উল্টোটাই মনে মনে ঠিক করে নিলাম। এবং শরতের এক বিকেলে ক্যাজুয়াল একটা আড্ডার পরে চোখে চোখ রেখে, কাঁদো কাঁদো হয়ে প্রেমের প্রস্তাব ফেঁদে বসলাম সাদিয়ার কাছে। যেহতু পৃথিবীতে এই প্রথম একটা প্রেমের প্রস্তাবের অন্যতম উদ্দেশ্য মহৎ সাহিত্য সুতরাং সেটা একটু বেশি নাটুকে হয়ে গেছিল সন্দেহ নাই।
অবশ্যই আপনাদের মনে হচ্ছে উত্তরে সাদিয়া কী বলেছিল?
উত্তরটা অন্যভাবে দেই।
কেউ কি আমার কোন উপন্যাস পড়েছেন? কালজয়ী? বা অন্য কিছু ছোটখাট কিছু জয়ী? না?
হুম। এটাই।
এটাই আমার উপন্যাসটা আজো লিখতে না পারার তিন নম্বর এবং যাকে বলে লাস্ট বাট নট দা লিস্ট কারণ। 
এখনো মাঝে মাঝে অলস সন্ধ্যায় আমাদের মেয়ে লিয়া কে নিয়ে যখন ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে নতুন এনিমেটেড ফিল্ম দেখি তখন হঠাত সাদিয়া বলে ওঠে-
অ্যাই, তুমি না আগে লেখালেখি করতে? একটা উপন্যাস না লিখবে বলেছিলে? লেখো না কেন? 
আমি হাসিমুখে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে বলি- 
না থাক, কী বলি তা আর না-ই বা শুনলেন।

Friday, November 11, 2022

আশ্রম

এটাই ভালো হয়েছে কী বল?

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সাদিয়া বলল

মাঝে মাঝেই আম্মুকে এখানে দেখতে আসতে পারবো।

হুম। কী উত্তর দেব জানি না, ভাল হয়েছে এটা বলাও কেমন আবার- না চল ওনাকে নিয়ে যাই এটাও বলা যাচ্ছে না।

আম্মু সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে খুব পছন্দ করতো, খুব সোশাল ছিলো। এখানেও কত মানুষ তাই না?

হুম। আবার একই উত্তর দিলাম। উত্তর বা ঠেক দেয়া একটা শব্দ। কী করা যায় না বুঝলে আমরা যেই রকম করি আরকি। মেসেঞ্জার বা এস এম এস এ সেটা ইংরেজীতে মাঝে মাঝেই Hm হয়ে যায়।

চারদিকে অনেক গাছ। আর ঢাকার মধ্যেই, তাই না? ভাব যদি তাকে ঢাকার বাইরে রেখে আসতাম?

এটাই ভাল হয়েছে, আমিও এবার চায়ে চুমুক দিলাম।

আমার মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে এখানে এসে আম্মুর সাথে একটু শুয়ে থাকি। এটা করা যায় না, না?

হুম।

ভাব এখানেও আম্মু কিন্তু ঘুমিয়েই আছে। হাসপাতালেও যেমন ছিল। আসলে পারথক্য শুধু কথা বলা যাচ্ছে না, আর হাত টা ধরা যাচ্ছে না, আর দেখা যাচ্ছে না, আর... বলতে বলতে সাদিয়া আবার কাঁদতে লাগলো।

আজিমপুর কবরস্থানে আমাদের আম্মুকে রেখে যতবার ই আসি, প্রতিবার ই এরকম হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আস্তে আস্তে সয়ে যাবে, কিন্তু যায় না। এই ভয়াবহ ব্যস্ত শহরের মধ্যে একেবারে হঠাত সমতল নিশ্চুপ গোরস্তানে যেন কত বছরের কত মানুষের হাহাকার জমে আছে, কত মানুষ ছিল কিন্তু স্রেফ নেই হয়ে এখানে আছে, বা হয়ত এখানে নেই, হয়ত কোথাও নেই। কে জানে? কিন্তু কি আশ্চর্য করুণ সুন্দর জায়গাটা। সারি সারি সাদা সাইনবোর্ড, কত হাজার হাজার মৃত মানুষের নাম। কত তাদের ঠিকানা, চুনকুটিয়া, কেরানীগঞ্জ, চানখারপুল, নারায়ণগঞ্জ, আরমানীটোলা, মোহাম্মদপুর। সে সব ছাপিয়ে উঠে গেছে থোড়াই কেয়ার করা কিছু অশ্বত্থ, জারুল আর কদম। সেখানে ডাকছে বুলবুলি, ফিঙ্গে, শালিক।

ফিরতে ফিরতে আমারো তাই মনে হল।

মা কে  হয়ত এখানে রাখাই ভাল হয়েছে। 

Sunday, September 5, 2021

বিষপর্ণী


সাদী হকের সাথে আমার পরিচয় কিভাবে হয়েছিলো তা আগেই বলেছি। সেই যে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে জাহাজ নিয়ে সবাই ডুবোচরে আটকা পড়লাম, আর বয়স্ক রাশভারী এক ভদ্রলোক হাতে একটা চিতাবাঘের মাথা খোদাই করা সাবেকী লাঠি নিয়ে একটা প্রায় অবিশ্বাস্য গল্প বলেছিলো? তা সেই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন চলে গেছে। আমিও এই রহস্যময় মানুষটার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। মাঝে একবার কোথায় যেন কী একটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের সাথে টেবিলে বসা অবস্থায় তার একটা ছবি দেখেছিলাম পেপারে। ওই পর্যন্তই। এর মধ্যে নিজের জীবনে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক ঝড়ঝাপ্টা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ একটা ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। হুট করে আগের পত্রিকা ছেড়ে এখন যোগ দিয়েছি নতুন একটা দৈনিক পত্রিকায় ফিচার পাতার বিভাগীয় স¤পাদক হিসেবে। তো সেখানেই এক সন্ধ্যায় যখন পত্রিকা অফিসের চিলেকোঠার নিজস্ব ছোট ক্যান্টিনটায় বসে প্রমাণ সাইজের ডাল পুরী খাচ্ছি তখন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের পাতার ফটোগ্রাফার রাদী এসে ঢুকলো। জুনের মেঠো গরমে তার ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে।

কী খবর রাদী?

আর বলবেন না ভাই, যা-তা গরম। এর মধ্যে আজ যেতে হয়েছিলো পুরোনো ঢাকায়। একেবারে জিলাপী গিট্টু জ্যাম। বাইক নিয়েই প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে গেল যেতে ভাবুন।

কোথায় ছিলো এসাইনমেন্ট?

বলধা গার্ডেন, ওই যে নারিন্দার দিকে।

ও হ্যাঁ চিনি তো, সেটার কথা তো ভুলেও গেছিলাম। তা কিসের ছবি তুলতে গিয়েছিলে? গ্রীষ্মের খররোদে উদয়পদ্মের বাহার। ফুল ফুটুক না-ই ফুটুক আজ গ্রীষ্ম?

নারে ভাই, ফুল টুল না, একটা ডেডবডি- খবর দেখেন নাই?

না তো কী হয়েছে? কার ডেডবডি? ওই বাগানের মধ্যে?

সেকী? এটা তো আজকের হট টপিক। নারিন্দার পুরোনো ব্যবসায়ী চার্কি পরিবারের  নাম শুনেছেন? সেই পরিবারের মূল লোক আলীম চার্কি মারা গেছেন।

বল কী? সে না এই সেদিন দক্ষিণ ঢাকার মেয়র ইলেকশনে দাঁড়ালো? ওই যে টিয়াপাখি দিয়ে ভাগ্য গুণে বলে দিল সে-ই হবে দক্ষিণ ঢাকার মেয়র, পরে হেরে গেল?

হ্যাঁ, দুপুরের তার ডেডবডি পাওয়া গেছে বলধা গার্ডেনের ভেতরে। সম্ভবত আগেই মারা গেছে, আবিষ্কার হয়েছে পরে।

কিভাবে মারা গেছে? খুন নাকি?

না মনে হয়, জখম টখম নেই, তবে ডাক্তারি পরীক্ষা করলে না বলা যাবে। লোকটা পড়ে ছিল খুব অদ্ভুত ভাবে, যেন  দুই হাত জড়ো করে কিছু একটা ধরে আছে, দাঁড়ান ছবিগুলো মেমোরি কার্ড থেকে নামাচ্ছে নিচে। দেখবেন না হয়।

হুম, এ তো বেশ প্রভাবশালী লোক, ওই বাগানের মধ্যে এভাবে পড়ে ছিলো, আশ্চর্য ব্যাপার। হার্ট এটাক টেটাক হবে মনে হয়। কিন্তু সে ওখানে ঢুকলো আর কেউ দেখলো না, জানলো না?

কি জানি, একটু রহস্যময় মনে হয়েছে আমার কাছে, সাদী ভাইও তাই বললেন।

সাদী ভাই?

সাদী হক, ওই যে অলৌকিক বিষয়গুলির রহস্য উদঘাটন করেন যে, নাম শোনেননি?

আরে নাম শুনেছি মানে? তাঁর সাথে পরিচয়ও আছে রীতিমতন। সে আরেক মজার গল্প। তুমিও ভালই চেন মনে হচ্ছে?

খালি চিনি? আমাকে বলতে পারেন তার এক রকম সাইড কিক, ব্যাটম্যানের যেমন রবিন। হাহাহাহা। তাঁর একটা ক্লাব আছে, আলৌকিক সব ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে বের করেন, নাম নিহিলিন ক্লাব।

বাহ, নামটা ভালো দিয়েছে, বেশ একটা ইস্ট মিটস ওয়েস্ট তাইপ ব্যাপার আছে। তা উনি ওখানে চলে গেলেন?

আরে উনি তো পুরান ঢাকাতেই থাকেন, মাহুতটুলীতে তার দাদার আমলের বাড়ি। চলুন নিয়ে যাব একদিন, বেশ মজা পাবেন। সেইরকম সুন্দর একটা বাড়ি। আর মোটামুটি একটা মিউজিয়াম বলতে পারেন অদ্ভুত সব জিনিসপত্রের।

হ্যাঁ যাওয়া যায়, আগে যখন একবার-

স্যার, রকিব স্যারে ডাহে।

মাঝখানে ক্যান্টিন বয় হাসান এসে পড়ায় আড্ডায় বাগড়া পড়লো।

আচ্ছা আচ্ছা আসছি যাও, দ্রুত ঠা-া হয়ে আসা চা আর পুরীর অর্ধচন্দ্র অবশিষ্ঠাংশে কামড় বসিয়ে রাদীকে বিদায় জানিয়ে নেমে এলাম নিচে। অফিসের ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়লো জগন্নাথে পড়ার সময় বলধা গার্ডেনে গিয়েছিলাম একবার ঘুরতে, তখন আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সেখানে, এদ্দিন পরে হঠাত করে ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়লো।

 

মাহুতটুলি

আজকাল সকালে দেরী করে ওঠা হচ্ছে, একটা বড় কারণ বাসায় ব্রডব্যান্ড ইন্টাারনেটের আগমন ও ওয়াই ফাই করে ফেলা। রিয়া মজা করে বলে-

আগে ঘরে ছিল শুধু ওয়াইফ, এখন এসেছে হাই ফাই ওয়াইফ, মানে ওয়াই ফাই, তার দামই বেশী হয়ে গেছে হাহাহা।

কথাটা ভুল না, কারণে অকারণে একটু পর পর কোথায় কী ঘটছে তা বার বার দেখতে চাওয়াটা একটা নেশার মত হয়ে গেছে। যার বেশিরভাগই আদৌ কোন কাজের না। আর তা করতে করতেই দিন শেষ, দিন তো দিন, রাতেও সবাই বুঁদ। কোন দিনই রাত একটার আগে ঘুমাতে যাওয়া হচ্ছে না। লিয়া এখনো ছোট, এক বছর দুই মাস, এখন থেকেই সে ধরেছে মায়ের মোবাইলে ইউটিউব, ইউটিউব ছাড়া তাকে খাওয়ানো কঠিন।  ওর হাতে মোবাইল দেখলে রীতিমতন আতংক লাগে।

যাই হোক, কাল অবশ্য একটা বড় সময় পার করেছি সেই আলীম চার্কির ঘটনাটা নিয়ে বিভিন্ন নিউজ পড়ে। ব্যাপারটা আসলে কিছুই না। আমার মনে হয় সাধারণ হার্ট এটাকে মারা গেছে একজন বয়স্ক লোক, ঘুরতে গিয়েছিলো বাগানে, এরপর হার্ট এটাকে মৃত্যু । এ বয়সে তাঁর মত প্রভাবশালী একজন মানুষ কেন একা একা ঘুরতে গিয়েছিলো তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না, বাসার লোকেরা বলছে সে নাকি একাই বের হয়েছিলো, গাড়িও নেয়নি, বলেছিলো কাছেই পার্টি অফিসের একটা কাজে যাচ্ছে, কাজের লোককে বলে গিয়েছিলো দুপুরে বাসায় এসে খাবে। পার্টির কাজে মাঝে মাঝেই এরকম বের হন তিনি, তাই কেউ এটা নিয়ে আলাদা করে আগ্রহ দেখায়নি, তবে তার এসিসিটেন্ট বলেছে উনি সাধারণতঃ এরকম একা একা বের হন না, কেউ না কেউ সাথে থাকেই। সেদিন একাই বের হয়েছিলেন।

একজন মানুষ এরকম ঘুরতে যেতেই পারে একা একা, কিন্তু যেহেতু তিনি বেশ প্রভাবশালী একজন মানুষ আর ডেডবডিটা পাওয়া গেছে একটা অদ্ভুত জায়গায় তাই বেশ রঙ চড়িয়ে ব্যাপারটা খবর হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নাম না জানা হাবিজাবি অনলাইন নিউজ পোর্টালে তো রীতিমত হত্যা রহস্যের গল্প ফাঁদা হয়েছে। খবরের বদলে আজকাল হচ্ছে খবরের চোরাবালি, এত খবর যে ডুবে যেতে হয় আর শেষমেশ বোঝাই যায় না আসলে কি ঘটেছে। আসলে ভদ্রলকের ডেডবডির ছবিটাই সবার এত আগ্রহের কারণ। হাত জোড় করে সোজা সামনের দিকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসা অনেকটা যোগ ব্যায়ামের সূর্য নমস্কারের ভঙ্গিতে আধশোয়া। এদিকে ভদ্রলোকের মরেও শান্তি নেই, যেহেতু রাজনৈতিক দলের একটা যোগাযোগ ছিল তার সাথে তাই ইতমধ্যে তার দলের লোকেদের সভা সমিতি শুরু হয়ে গেছে, আলীম গোমেজের হত্যাকারীদের ফাঁসী চাই, এবং এটা বিরোধী দলের কাজ ইত্যাদি। মাথা থেকে এই জিনিস কিভাবে বের করা যায় সেটা ভাবতে ভাবতে টয়লেটের দিকে রওনা হয়েছি এমন সময় ফোন, এত সকালে? না আসলে প্রায় দশটা বেজে গেছে, মোবাইল তুলে দেখি- রাদী।

হ্যালো?

হ্যালো ভাই, কি ঘুম ভাঙালাম নাকি? শোনেন, আমি সাদী ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি। আপনার বাসা মগবাজারে না? আমি ওইদিক দিয়েই যাব। চলেন যাই। দুপুরে ওদিকেই খেয়ে দুইজন একসাথে অফিস ফিরবোনে।

এতো মহা যন্ত্রণা হল, সাদী হককে চিনি, এবং সৌজন্য করে বলেছি যে একদিন যাব ঘুরতে। সেটা বলা এক কথা, আর সত্যি সত্যি এরকম হুট করে সকালের আরামে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে পত্রিকার পাতা ওল্টানোর বদলে রাদীর কর্ণবিদারী হর্নের বাইকে চড়ে পুরান ঢাকায় চলে যাওয়া আরেক ব্যাপার। কিন্তু বেচারা এত আগ্রহ নিয়ে বলছে-

হ্যাঁ, ওই ইয়ে মগবাজারেই বাসা, দিলু রোডে

ওকে আপনি দিলু রোডের গলির মাথায় দাঁড়ান। রেল লাইনের দিকেও আসতে পারেন। আমি হাতিরঝিলের থেকে বের হব। রেডি থাকেন, আমার সময় লাগবে না কিন্তু।

যন্ত্রণা। যাই হোক, বাসায় আসলে তেমন কোন কাজও নেই। যাওয়া যায়। প্রতিদিন একই রুটিন করে করে একটু হাঁফও ধরে গেছে ইদানীং।

রাদীর বাইকটা দর্শনীয়, এর মালিক আগে ছিলো আমাদের অফিসেরই আরেক ফটোগ্রাফার অপু। তার চেহারা সুরতের সাথে এই জিনিস মানিয়ে যেত। বেশ স্বাস্থ্যবান বাইক, রেনেগেড ক¤পানীর। হালকা পাতলা রাদিকে সেটায় একেবারেই ছোটখাট লাগে। তার পেছনে আমাকে নিশ্চই আরো উদ্ভট লাগছে, এইসব বাইক একেবারেই কমবয়েসী ছোকড়াদের জন্যে। বাইকটা মাঝে মাঝে বিকট আওয়াজ করে, এ ছাড়া তেমন কোন সমস্যা নেই। সেটায় ওর কোমড় ধরে যেতে যেতে সেই ছাত্রজীবনের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। তখন জগন্নাথে পড়ি, একদিন ক্যা¤পাসে গিয়ে শুনি ক্লাস হবে না, কিসের একটা অবরোধ চলছে, অবশ্য এমনিতেও ক্লাস খুব একটা হত না, আর হলেও করতো হাতে গোণা কয়েকজন। তো হঠাৎ ছুটি পেয়ে আমি আর এক ক্লাস মেট- এদ্দিন পর নামটাও ভুলে গেছি। মনে হয় দেবাশীষ- হ্যাঁ, দেবাশীষ, আমি ডাকতাম ‘দেবা’, যাকগে, সে বললো চল বলধা গার্ডেনে ঘুরে আসি। আগে যেহেতু যাইনি, তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম।

তখন বর্ষাকাল। রাস্তায় কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে একাকার অবস্থা। তবে অন্য একটা ভাল দিক হচ্ছে আকাশে মেঘ, সুতরাং এমনিতে যে ভ্যাপসা একটা গরম পড়ে তার বালাই নেই। বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। বলধা গার্ডেনে ঢোকার পরেই মনটা আরো ভাল হয়ে গেল, সেখানে একটা বড়ো নামফলকে লেখা, কোন এক জমিদার (এদ্দিন পর নাম মনে নেই) ব্যক্তিগত শখ থেকে এই বাগান করেছেন, দেশ বিদেশের নাম না জানা কত যে প্রজাতি আছে এখানে। রীতিমত একটা গাছের যাদুঘর বলা যায়। আরেকটা আশ্চর্য তথ্য সেদিন জেনেছিলাম, যে এই বাগানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এসেছিলেন! বাগানে আরো দারুণ দারুণ সব জিনিস ছিলো। সব বাদ দিয়ে গাছ দেখেই আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। নাম জানি  না বেশিরভাগ গাছেরই। অনেকগুলিরই অবশ্য বাকলের ওপর নাম লেখা ছিলো। হঠাত এসময়ে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি শুরু হওয়াতে ছুটে একটা বেশ বড়ো গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম, গাছটার পেছনেই একটা বাঁধানো পুকুর, সেখানেও বেশ কিছু জলজ গুল্ম। দেবাশীষ আর আমি দাঁড়িয়ে আছি কখন বৃষ্টি থামবে তার ঠিক নেই, বড় গাছ হলেও বৃষ্টির তোড়ে ঠিকই এদিক ওদিক থেকে পানি ঝরে পড়ছিলো আমাদের গায়ে। আমরা সেগুলি বাদ দিয়ে পাশ করে কী করব তার আলোচনা করছি। দেবা রাজশাহীর ছেলে। ঢাকায় তার কেউই নেই, এখন আছে তার মামার বাসায়, কিন্তু সেখানে বেশীদিন থাকা যাবে না, এদিক ওদিক কম ভাড়ার মেস খুঁজে বেড়াচ্ছে সে, একটা টিউশনিও দরকার, আমার চেনা কোন টিউশনি আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো ঠিক তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো।

দেবার কাঁধের ঠিক ওপর দিয়ে পুকুরে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। পুকুরের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ভেসে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে! এবং সেটা আর কেউ না, আমার ছোট বোন রাহেলা। তার এসময়ে এখানে থাকা কোনভাবেই সম্ভব না, কারণ রাহেলা বারো বছর আগে পুকুরে ডুবে মারা গেছে! এরকম এক বর্ষার দুপুরে আমি আর রাহেলা পুকুরে নেমেছিলাম, দুজনের কেউই সাঁতার জানি না, একটা কলাগাছ ধরে সাঁতার শেখার চেষ্টা করছিলাম আমি, বড়োদের চোখ এড়িয়ে রাহেলাও আমার সাথে নেমেছিলো এবং এক পর্যায়ে সে হঠাৎ কলা গাছে থেকে হাত পিছলে পরে ডুবে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। আজও সে কথা মনে হলে ভয়ানক এক অপরাধবোধ কাজ করে আমার মধ্যে। সেই রাহেলা, সে এইখানে এই পুকুরের মাঝামাঝি প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমাকে ডাকছে। এবং কেন যেন আমার মনে হল এটা খুবই স্বাভাবিক। ও অবশেষে পানি থেকে উঠতে পেরেছে তাই আমাকে ডাকছে। এখন গেলে তাকে বাঁচানো যাবে। ভাবতে না ভাবতেই সেদিকে পা বাড়ালাম আর তখনি কাঁধে দেবাশীষের হাত পড়লো। প্রবল ঝাঁকুনি দিতে দিতে সে আমাকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে। সম্বিত ফিরতেই দেখি সব স্বাভাবিক। পুকুরে কিছুই নেই। দেবাশীষ বললো আমি নাকি আচ্ছন্নের মত হঠাত পুকুরের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলাম। ঘটনাটা এইটুকুই। কিন্তু এর পরেও অনেকদিন আর ওইদিকে যাই নি। কেন যেন একটা প্রবল আতংক বোধ হত বলধা গার্ডেনের কথা মনে পড়লেই।

ভাই চলে এসেছি।

রাদিও কথায় আবার এখনকার সময়ে চলে এলাম। পুরান ঢাকার একটা সাধারণ গলি, চারিদিকে চাপাচাপি ভীড়, এর মধ্যেই মাছের সাঁজি নিয়ে বাজার বসে গেছে রাস্তার উপরে, একোটা ট্রাক সেখানে ঢোকার চেষ্টা করছে, কিন্তু এক মাছওয়ালার বোয়াল মাছের ঝুড়ির জন্যে ঢুকতে পারছে না। ট্রাক ড্রাইভার আর মাছওয়ালা দু’জনেই গলা ফুলিয়ে চৎকার করছে। সহজে এই ঝামেলা শেষ হবে মনে হচ্ছে না। রাদী এখানে এই গ্যাঞ্জামের মধ্যেই তার বাইকটা এক পাশে পার্ক করে বললো, চলুন, সামনেই, ট্রাকের জন্যে বসে থাকলে আর যাওয়া হবে না।

ট্রাকটা পাড় হতেই রাস্তার ঠিক পাশে একটা নিচু সাদা রঙের গেট। সেদিকেই এগোচ্ছে রাদী। গেটটা বেশ পুরোন হলেও মজবুত তা বোঝা যাচ্ছে, দারোয়ান টারোয়ান নেই, ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। সামনে বেশ খানিকটা ঘাস আর ইটে ঢাকা লন মতন জায়া। সেটা পেরিয়ে দোতলা পুরোনো ধাঁচের বড়ো ঝুল বারান্দা সহ বাড়িটা। অনেক আগের সন্দেহ নেই, তবে যারা বানিয়েছেন বেশ পয়সাওয়ালা ছিলেন তা বোঝা যায়, এবং সেই সাথে ছিলো রুচি। লনটা হেঁটে এসে বেশ ভারি কাঠের পাল্লার একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

কলিং বেল কই? আশেপাশে কিছু না দেখে জিজ্ঞেস করলাম রাদীকে।

আছে আছে, দেখেন, বলে দরজার ওপরের দেয়াল থেকে একটা সরু ছিদ্রপথে নেমে আসা একটা নাইলনের দড়ি হাতে ধরে টান দিলো রাদী। টুং টাং করে কিছু একটা বেজে উঠলো ভেতরে, ঘণ্টা।

সেকি একটু পরে কি খানসামাও বের হবে নাকি? এতো পুরো মধ্যযুগে চলের এসেছি মনে হচ্ছে।

আরে না না, কলিং বেলের আওয়াজটা সাদী ভাই পছন্দ করেন না। উনি একটু নিরিবিলি থাকেন তো।

আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই দরজাটা খুলে গেল।

লালচে দাঁড়িওয়ালা হাসিমুখের এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে- না ইনি তো সাদী হক নন, ভৃত্য গোছেরই কেউ হবেন।

আরে হাশেম ভাই। কবে আসলেন? নিতাই নাই?

এই তো কয়দিন আগেই আসলাম, নিতাই গেছে একটু বাইরে, আসেন আসেন। সাহেব অপেক্ষায় আছেন।

বাসার ভেতরে ঢুকতেই একটা পুরোনো ধরনের মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগলো। ঠিক মিষ্টি না, অনেকটা আমাদের পত্রিকা অফিসের সেমিনার রুমে আর্কাইভ করা পুরোনো কাগজ রাখা থাকলে যেমন একটা ঘ্রাণ হয় সেরকম। বেশ লম্বা করিডোর, এবং তার দেয়াল ভর্তি আজব সব মুখোশে।

রীতিমত বাতিকগ্রস্থ কালেক্টর মনে হচ্ছে ভদ্রলোক? বললাম।

তা বলতে পারেন, আর প্রায় সব মুখোশেরই একটা না একটা দূর্দান্ত গল্প আছে। জিজ্ঞেস করে দেখবেন।

আমার কেন জানি মনে হল সাদি হক লোকটা একটু বানিয়ে বলা টাইপের। সেই যে আগে একবার দেখা হয়েছিলো। যে গল্পটা বললো সেটা ওই প্রেক্ষাপটে বেশ অন্যরকম মনে হলেও পরে ঢাকায় এসেই মনে হল কি গোঁজামিল ধরনের একটা গল্প বলে দিল। তবে ভদ্রলক বলেন খুব সুন্দর, এতে কোন সন্দেহ নেই।

এভাবে মিনিট পাঁচেক টানা হাঁটার এবং একইরকম পরপর দুটো করিডোর পার হয়ে একটা বড় রুমের মাঝে এসে পাওয়া গেল ভদ্রলোককে। চুল দাড়ি সব সেই আগের মতই সাদা তাই বয়স বেড়েছে কিনা বোঝা কঠিন।

আরে এসো এসো রাদী। কী খবর? মেহমান কেমন আছেন? ওয়েইট, আপনাকে কি আমি চিনি? হুম দাঁড়ান দাঁড়ান বলতে হবে না, সুন্দরবন, রাইট?

বাহ, লোকটার স্মৃতিশক্তি ভালো বলতে হবে। আমি রাস্তায় দেখলে তাঁকে চিনতাম হয়ত, কারণ তাঁর সাদা দাঁড়িগোঁফ আর একটা বেরেটা ক্যাপ মিলিয়ে বেশ ইন্টারেস্টিং চেহারা। কিন্তু আমার মত বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা হুট করে দুই বছর পর চিনে ফেলা বেশ ভালো স্মৃতিশক্তির প্রমাণ দেয়।

জ্বী জ্বী, আরে আপনি চিনতে পেরেছেন। চিনতে পেরেছেন বলেই লোকটাকে নিয়ে এতক্ষণ যা ভাবছিলাম তা সব ভুলে মাফ করে দিলাম। না  হয় বলেনই কিছু গল্প, তাতে তো আর কারো কোন ক্ষতি হচ্ছে না।



সুন বসুন, যাক এভাবে দেখা হয়ে গেল, ভালই হল। কী খাবেন? চা- আই মিন চা তো বটেই। কী রকম চা? র’ টি, মিল্ক টি, নাকি অন্য কোন ফ্র্যাগ্রেন্স? এসময় ঘরের সেই ঘণ্টাটা আবার বেজে উঠলো।

ওই যে চা বানানোর লোক চলে এসেছে। বললেন সাদী হক

নিতাই? যোগ করলো রাদী

হ্যাঁ।

মিল্ক- মানে দুধ চা হলেই হবে, চিনি কম। বললাম

ওকে। নিতাইকে ডেকে চায়ের বন্দবস্ত করে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন এবারে।

হ্যাঁ রাদী। শোন, সেই বলধা গার্ডেনের ঘটনাটা। জানো কী ঘটেছে? থানার ইন্সপেকটর এনামুল আমাকে কল করেছিলেন। বললেন ডেডবডির সাথে নাকি একটা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া গেছে। তার দু’ হাতের মুঠোয় ধরা ছিলো একটা তাবিজ ধরনের কিছু।

তাবিজ?

হ্যাঁ, ঠিক আমাদের দেশের কমন তাবিজ না। একটু অন্য রকম। আমাকে সে হোয়াটস অ্যাপে সেটার একোটা ছবি পাঠিয়েছে। দাঁড়াও, তুমি আবার সেট পত্রিকায় দেবার কথা ভেবো না। এই দ্যাখো।

জিনিসটা তাবিজের মতই, তবে চারকোণা বা নলের মত না। যেরকম আমাদের দেশে হয়। এটা অনেকটা পঞ্চভূজের মত। আর তার ঐপরেই কী সব খোদাই করা।

এটা দেখেই এনামুল মনে করল আমাকে দেখানো দরকার। ওই যে সেই নরবানর রহস্যের পরে সে এ ধরনের কিছু পেলেই আমাকে জানায় পরামর্শের জন্যে। কী জানো? এটা দেখে কিন্তু আমারো মনে হচ্ছে এর সাথে একটা হোকাস পোকাসের যোগ থাকতে পারে। যদিও জিইসটা কী এবং কেনই বা চার্কি সাহেবের হাতে ধরা ছিলো তা জানি না। যাই হোক, একটা ছোট রহস্যের আঁচ যেহেতু পাওয়া গেছে আমি তাই একটু পরেই বেরুতাম অকুস্থলে যাবার জন্যে। কী মনে করো? সময় আছে যাবে? বলধা গার্ডেন?

যাব মানে? অবশ্যই। বললো রাদী

আর আপনি?

পরের প্রশ্নটা আমাকে করলেন সাদী হক।

হ্যাঁ ইয়ে, ওই-

ও কোন কাজ থাকলে বাদ দিন।

না না, চলুন। আমি আমার নিজের সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথাটা চট করে এখন আর বলতে গেলাম না।

 

সিবিলী

অনেক দিন পর বলধা গার্ডেনে আসা। গেটের সামনে দেখি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর দুইজন সেন্ট্র্রি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কথাবার্তায় জানা গেল ইনিই ইন্সপেক্টর এনামুল। সাদী হককে যিনি তাবিজের ছবিটা পাঠিয়েছিলেন। আমাদেরকে সাদী হক বুদ্ধি করে বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন, সাংবাদিক পরিচয়টা আর বললেন না। তাহলে হয়ত এখন রীতিমত কর্ডন করা জায়গাটায় আমাদের ঢুকতে দিতো  না। আমি ভয় পাচ্ছিলাম আশেপাশে চেনাজানা কোন রিপোর্টার না আবার দেকে ফেলে। তবে খুব একটা লোকজন নেই। সম্ভবত এই নিউজটা ইতিমধ্যে নতুন কোন নিউজের আড়ালে চলে গেছে। যাকগে, গার্ডেনে ঢুকেই জায়গাটা কেমন যেন ছোট ছোট মনে হল, অনেকদিন আগে দেখা কোন জায়গা সময়ের সাথে সাথে মনের মধ্যে কেন যেন বড় হতে থাকে আকারে। গেট পার হয়ে ঢুকতেই সেই বিশাল সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো, এবারে জমিদারের নামটা পড়লাম, জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরী। কি শৌখিন লোকই না ছিলেন। তাঁদের মূল জমিদারী ছিল সেই গাজীপুরের দিকে। পরবর্তীতে ধামরাই টামরাই ইত্যাদি জায়গাতেও জমিদারী সম্প্রসারণ করেন, এই শৌখিন উদ্যানটা করেন ১৯০৯ সালে। গাছপালার অসংখ্য প্রজাতি নিয়ে এই বাগানটা বেশ সমৃদ্ধ। এর আবার দুটো অংশ আছে, একতা সিবিলি, আরেকটা সাইকি, সিবিলি হল প্রাচীন এক গ্রিক প্রকৃতির দেবি মাতৃকা রূপ। আর সাইকি হল আত্মার সুবুদ্ধি টাইপের কিছু একটা, সেটা বোঝা গেল না। সেখানে ঢোকারও অনুমতি নেই আপাতত।

মূল উদ্যানে ঢুকতেই আমার সেই অস্বস্তিকর স্মৃতিটা মনে পড়লো। তবে আজ আর সেদিনের মত বৃষ্টি নেই। বেশ ঝকঝকে রোদ। আর এসেছি অন্য একটা কাজে তাই যতটা ভেবেছিলাম অতটা বাজে লাগছে না। জক্সগুলে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। অরণ্যের মধ্য দিয়ে একটু বেমানান লাগছে, কি আর করা।

সাদী হক ভদ্রলোকের হাঁটা চলা দেখতে দেখতে মনে হল তাঁর বয়স কত? বেশ চটপটে নড়াচরা। দেখে ত ষাটের নিচে মনে হয় না। সে হিসেবে যথেষ্ট ফিট আছেন ভদ্রলোক। গার্ডেনে ঢুকেই ইন্সপেক্টর এনামুলের সঙ্গে সোজা হাঁটা দিয়েছেন পুকুরের কাছে। ডেডবডিটা যেখানে পরে ছিলো সেটা একটু ঢালু ধরনের জায়গা, এবং সেটা ধীরে ধীরে নেমে গেছে সেই অত বছর আগে দেখা পুকুরটার দিকে! মানে, সম্ভবত আমি সেদিন ঠিক এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম। আশেপাশে তাকিয়ে সেই গাছটা খোঁজার চেষ্টা করলাম, নেই। এত বড় একটা গাছ, হয়ত কেটে ফেলা হয়েছে। যাই হোক, সাদী হককে দেখলাম ডেডবডিটা যেখানে ছিলো সেখানে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখলেন, তারপরে বরাবর পুকুরের দিকে নেমে গেলেন। সেদিক থেকে আবার ডেডবডির কর্ডন করা জায়গাটা উঁকি দিয়ে দেখলেন। রাদির দিকে তাকিয়ে দেখি তার রীতিমত হাত নিশপিশ করছে ছবি তলার জন্যে।

-           কী, ক্যামেরাই তো আনোনি। এখন আক্ষেপ করলে হবে?

-           আরে ক্যামেরা আনা যাবে না তো। আমরা তো রিপোর্টার হিসেবে ঢুকিনি। এখন এমনিতেও তোলা যেত না। কিন্তু কী দারুণ ভিউ দেখুন। সেদিন দেখিনি। চলুন সামনের সোমবারের আয়োজন এ বলধা গার্ডেন নিয়ে একট ফিচার করি।

‘আয়োজন’ হল আমাদের পেপারের সোমবারের পাতা। ওটা আমি-ই স¤পাদনা করি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। তা করাই যায়। কত কী নিয়ে ফিচার করছি। আর এটাতো রীতিমত করার মত একটা জায়গা।

-           হ্যাঁ, করাই যায়। ভাল কথা। তোমার ওই সাদী ভাই এমনিতে করেন কী? মানে ওনার চলে কিভাবে?

-           হাহাহা, উনি জীবনে করেন নি এমন কাজ কমই আছে। তবে এখন কিছুই করেন না, শুধু এইসব অতিপ্রাকৃত সিম্বলিজম, অকাল্ট জিনিসপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। আর ওই যে দেখলেন তাঁর পৈতৃক বাড়ি। অরকম আরো চারটা বাড়ি আছে তাঁর ঢাকায়। সেগুলোর ভাড়া পান। আর টিকাটুলির যে বিখ্যাত রজনী হোটেল সেটাও ওনাদের। ওদিকে বিপতœীক, বেশ আগে বিয়ে করেছিলেন, ছেলে মেয়ে হবার আগেই স্ত্রী মারা গেছেন।

-           বাপরে! তা এরকম ব্যাকাপ থাকলে আমিও হয়ত এইসব তুকতাক নিয়ে কাটাতে পারতাম। হাহাহা।

কথাটা রাদীর মনে হল খুব একটা পছন্দ হল না। বোঝা গেল তুকতাক বলায় সে একটু অফ খেয়েছে।

-           চলো রাদী, চলুন ভাই, এখানে কাজ শেষ। সাদি হক ফিরলেন।

-           কি, আপনার সেই সুন্দরবনের মত কোন ঘটনা নাকি? না চাইতেও গলায় বোধহয় হালকা একটা খোঁচা ছিল সেটা টের পেলেন সাদী হক।

মুচকি হেসে উনি কিছু বলার আগেই ইন্সপেক্টর এনামুল বললেন,

-           সাদী ভাই, আমি তাহলে যাই। বিরাট বিপদে আছি।  এনারা এই এলাকার বেশ প্রভাবশালি লোক। রাজনীতিতে তো নেমেছেন বেশিদিন  হয়নি। কিন্তু তাদের ব্যবসা সূত্রে আগে থেকেই বিরাট সব কানেকশন। ডাক্তারের রিপর্টে এখনো নরমাল ডেথ, কিন্তু কয়েকজন যেন জোর করে এটাকে হত্যা মামলা বানাবে। আসলে প্রতিক্ষকে ফাঁসা ফাঁসির একটা কালচার তো আমাদের মানবজাতির আছেই। যাকগে। ঠিক আছে কষ্ট দিলাম। আমাকে আবার এখন চার্কি সাহেবের বাড়ি যেতে হবে। পরবারের সদস্যদের সাথে কিছু  কথা আছে। আর ভাই-

বলে সাদী হকের দিকে ঝুঁকে ইন্সপেক্টর সাহব কি যেন একটা বললেন। ব্যপারটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগলো। নিশ্চই কারণ আছে। সাদী হক কানে কানে শুনেই অবশ্য তাকে মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলেন। আর আমাদের শুনিয়ে বললে,

-           আরে না না ওনারা আমার বন্ধু মানুষ, আর আমার কাজের সাথেই আছেন, কাউকে কিছু বলবেন না। হাহাহা।

যাক ব্যাপারটা ব্যলান্স করলেন উনি।

গেট থেকে বেরিয়েই সাদি হক এবারে আমার দিকে তাকালেন।

-           হ্যাঁ, সুন্দরবনের কথা বলছিলেন। না এখনো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। অলৌকিক কিছু পাই নি। তবে ভালমত খেয়াল করলে কিন্তু লৌকিক সব জিনিস থেকেই অনেক কিছু বোঝা যায়। এই যেমন একটু খেয়াল করেই বুঝতে পারছি আপনার এই বিশেষ উদ্যানটায় কোন একটা অস্বস্তিকর স্মৃতি আছে, এবং সেটা বেশ অনেক দিন আগে ঘটেছে।

রীতিমত ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে গেলাম। কারণ এই জিনিসটা আমি কাউকে বলিনি। উনি কিভাবে বুঝলেন?

-           মানে?

-           মানে প্রথমেই যখন আপনাকে বললাম আপনি বেশ অনিচ্ছা দেখালেন এবং তারপরেই রাজি হয়ে গেলেন। যদিও আপনি আজ ঘুরতেই এসেছেন। এরকম অবস্থায় যে কোন সংবাদপত্রের লোক বা যে কেউ চাইবে জায়গাটা দেখতে, হ্যাঁ মৃতদেহ পড়ে ছিল এমন জায়গা অবশ্য অনেকেরই দেখতে ইচ্ছে নাও করতে পারে। তবে গেট দিয়ে ঢোকার পর থেকে আপনার গতি আস্তে আস্তে বেড়ে গেল লাগলো। আর হঠাৎ করে মৃতদেহ যেখানে পড়ে ছিলো তার সামনে এসে আপনার চলাফেরাও পালটে গেল। কিছু একটা এদিক ওদিক খুঁজছিলেন বারবার। তার মানে অনেক দিন পর ঘটনাক্রমে আপনি আসতে চান না এমন জায়গায় এসে গেছেন এখন এসেই পড়েছেন যখন তখন পুরোনো কোন একটা স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছেন।

হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। যা বলছেন তা সবই ঠিক, কিন্তু উনি দেখলেন কখন?

-           হাহাহা ঘাবড়াবেন না। স্মৃতিটা কি সেটা অবশ্য আমি এখনও বুঝতে পারিনি।

-           আপনি তো একেবারে শার্লক হোমস ভাই। বললাম।

-           ডিস্কাউন্টেড বলতে পারেন।

-           ভাল কথা রাদী, আমি এনামুল সাহেবের সাথে একটু ---- চার্কি সাহেবের বাসায় যাচ্ছি। তাঁর পরিবারের সাথে কিছু কথা বলবো। তোমার সাথে পরে কথা হবে। সরি আজ বাড়িতে ভাল রান্না ছিলো, খাওয়াতে পারলাম না। পরে আরেকদিন সময় কওে এসো ওনাকে নিয়ে আড্ডা হবে।

ফেরার পুরো সময়টা একটু লজ্জ্বা লজ্জ্বা নিয়ে রাদীর পেছনে বসেছিলাম। বেশ বুঝতে পারছি রাদি মনে মনে বিরাট খুশী হয়েছে এরকম একটা পঁচানি খাওয়ায়। ভাগ্য ভালো যে এখন জানতে চায়নি কী ঘটেছিলো এখানে।

 

সাইকি

- কী হয়েছিলো ভাই উদ্যানে? ছোট ভাইকে বলা যাবে নাকি যাবে না? বলে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিলো রাদি।

সেই সন্ধ্যায় ওপরের ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি আমরা, জানতাম একটা টিপ্পুনি অপেক্ষা করছে।

- বলা যাবে না কেন? আসলে সেটা আমি মনে করতে চাইছি না, সেটার সাথে একটা মৃত্যুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

- বলেন কী? সরি সরি, কেউ ওখানে মারা গেছিলো?

- আরে না না। সেরকম কিছু না। নাছোড়বান্দা রাদীকে অবশেষে পুরোটা বলতেই হল। বেচারা শুনে একটু কেমন হয়ে গেল। মজা করতে চেয়েছিলো বলে আবারো সরি টরি বললো।

- শুনুন, আমার মতে আপনি এই ঘটনাটা সাদী ভাইকে বলেন।

- ওনাকে? কেন?

- আরে উনি তো এইসব নিয়েই গবেষণা করেন। এরকম একটা অলৌকিক দৃশ্য আপনি কেন দেখলেন সেটা উনি শুনে ভেবে বলুন কী ঘটেছিলো। হতেও পারে এতদিন পর সেটার জট ছাড়বে।। আর কে জানে এর সাথে এই এখনকার ঘটনার কোন যোগ আছে কি না।

- হুম, খারাপ বলোনি। বলবো, এরপর কোনদিন দেখা হলে বলবো।

- আরে কোনদিন মানে? আজকেই চলুন। আমি কল দেব?

- আরে না না, পাগলামি কোরো না, তো। এত জরুরী না।

- আরে আপনার জন্যে না তো, কেন জানি মনে হচ্ছে এটা শুনলেই উনি এখনকার কেসের সাথে ঠিক একটা যোগ বের করতে পারবেন এটার।

- তাই বলছো? আচ্ছা কল দাও। যদি এতে একটা মৃত্যু রহস্যের জট ছোটে মন্দ কী?

ফোন করে রাদি বেশ কিছুক্ষণ হ্যাঁ, হ্যাঁ করলো, এবং ফোনটা আমাকে না দিয়েই রেখে দিলো, বললো-

- সাদী ভাই এখন একটু ঝামেলায় আছেন, বললেন বেশ কিছু ফলো আপ আছে কেসের। আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল সেই তাবিজ বা কবচ ধরনের জিনিসটার একটা হদিস মিলেছে!

- বল কী? কী জিনিস সেটা?

- বললেন সেটা আরেকটু জেনে জানাবেন। ভাল কথা, ফ্রি থাকলে কালই একবার যেতে বলেছেন তার বাসায়। যাবেন নাকি? আমার মতে আপনি সামনাসামনি আপনার ঘটনাটাও বললেন?

- সেকি? আবার? তার চেয়ে না হয় ফোনেই-

- আরে রহস্যটার সমাধান যদি সামনা সামনি জানা যায়।

- হুম, আচ্ছা দেখি। পর পর দুদিন সকালে বের হওয়াটা একটু বেশি হয়ে যাবে, রিয়া নির্ঘাত খেপবে। কতদিন ধরেই ও কোথাও একোটু ঘুরতে যেতে বলছে। আমি সময়ই দিতে পারছি না এমন একটা ভাব। এখন পর পর দু’দিন সকালে এক বুড়োর কাছে ছুটছি জানলে রাগ করবে। মুখে বললাম- আচ্ছা জানাচ্ছি তোমাকে রাতেই।

- সেদিন আর কাজে মন বসলো না। বার বার রাহেলার কথা মনে পড়ছে। কতদিন হয়ে গেছে। অথচ মনে হচ্ছে এই -সেদিনের কথা। রাতে ঘুমানোর সময় রিয়া ঠিকই আমার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো-

- কী ব্যাপার, অফিসে কোন সমস্যা?

- আরে না না, বেচারির সাথে অনেকদিন তারমানে অফিস ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা হয় না। কত ব্যাস্ত হয়ে গেছি আমি। আসলে এত ব্যস্ত তো নই।

- মুখটা হাসি হাসি করে বললাম, না রিয়া, কিছু হয় নি। আমার ছোট বোনের কথা মনে পড়ে গেছে হঠাৎ।

- ও

বলে চুপ করে গেল রিয়া। সে কিছুটা জানে ঘটনাটা, তাই আমাকে এ নিয়ে কখনই সে আর ঘাঁঁটায় না। ওকে একটু চাঙ্গা করতে এবারে সাদী হকের পুরো ঘটনাটা বললাম। শুনে উঠে বসলো রিয়া। সে একসময় ডিটেকটিভ গল্পের পোকা ছিলো। এরকম কেউ সত্যি সত্যি আছে আর আমি তাকে চিনি শুনেই সে মহা উত্তেজিত। পারলে কালই চলে যায় আমার সাথে। ঠিক করলাম ওকেও একদিন নিয়ে যাব। নিশ্চই ভাল লাগবে রিয়ার। অনেকদিন পর কাজের কথার বাইরে একটা অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করে দুজনেই বেশ নির্মল চিত্তে ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন আবার সেই মাহুতটুলির বাসায়। ঢুকেই সরাসরি হলঘরটায়, আগেরদিন খেয়াল করিনি, সাদী হকের মূল হলঘরটায় বেশ বড় একটা কাঠের লাইব্রেরি আছে। থরে থরে বই সাজানো। দেখলেই পড়তে ইচ্ছে করে, ভদ্রলোক প্রচুর পড়েন বোঝা যায়।

আসুন আসুন, সরি পর পর দুদিন কষ্ট করে আসলেন। আজ দুপুরে খাওয়া মাস্ট। নিতাইকে বলে দিয়েছি, আজকেও ভাল রান্না হবে। পুরান আমাদেও রজনী হোটেলের স্পেশাল কাচ্চি।

-সাদী ভাই কাচ্চি রাখুন। কী ঘটেছে আপডেট দিন।

হ্যাঁ, শোন, এই চার্কি পরিবার সম্পর্কে আমি আগে থেকেই কিছুটা জানতাম। আমাদের এই ওল্ড টাউনে আমরা স্থানীয়রা অনেক আগে থেকেই একে অন্যের খোঁজ খবর রাখি। তা ওদের বাসায় যেতেই কাল দুই একজন পরিচিতও বেরিয়ে গেল। মৃতদের বাড়ি, যাথারীতি থমথমে। রাজনৈতিক নেতা কর্মীরাও আছে, তারা এটাকে হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে ছাড়বে। যাই হোক কথা হল মূলতঃ আলিম সাহেবের ম্যানেজার রাসেলের সাথে, সেই ছিলো আলিম সাহেবের ডান হাত। ঠিক ম্যানেজার না, বলতে পারো পরিবারেরই সদস্য। তারা তিন পুরুষ ধরে আছে এই চার্কি পরিবারের সাথে, আলীম সাহেবকে সে কাকা বলে ডাকতো। আলীম সাহেব নিঃসন্তান, এই রাসেল অনেকটা তার ছেলের মতই বড় হয়েছে। এর সাথেই মূল কথা বার্তা হল। সেও তেমন কিছুই বলতে পারলো না। আর মিসেস চার্কি শোকে মূহ্যমান ছিলেন, কথা বলতে চান নি।

-হুম, তো এতে তো কোন কছুর কনারা হল না। তার কোন শত্রু টত্রু?

-হ্যাঁ, তাও জিজ্ঞেস করা হয়েছে। এনামুলকে তারা আগেই বলেছে যে রাজনৈতিক শত্রুর তো অভাব নেই, ব্যবসা সূত্রেও বেশ কিছু রাইভ্যালও আছে। কিন্তু একেবারে মেরে ফেলার মত শত্রুর নাম কেউ বলতে পারলো না। এদিকে তার মোবাইল ফোনটাও সেদিন বাসায় রেখে বের হয়েছিলেন। এবং সেটা ট্র্যাক করেও তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। লাস্ট কল উনি করেছিলেন বাসায় তাঁর বউকে। তারপরেও কল লিস্ট ধরে এখন সবাইকে জেরা করছে এনামুল।

-আচ্ছা, একটা একেবারে মৌলিক প্রশ্ন করি যদি কিছু মনে না করেন। থাকতে না পেরে বললাম।

-অবশ্যই অবশ্যই।

-আমরা কেন ধরে নিচ্ছি এটা একটা হত্যাকাণ্ড?

-ওহ্ সরি বলাই হয়নি। ডাক্তারি রিপোর্ট এসেছে। এতে বলা আছে হার্ট এটাক হয়েছিলো, তবে তার দু' হাতের চামড়াতে সদ্য হওয়া কিছুটা ঘায়ের মত দাগ পাওয়া গেছে।

-সেকী? তবে সেটা তো আরো অনেক কারণেই হতে পারে?

-তা পারে।

-সাদী ভাই, সেই কবচটা?

-ইয়েস, এটার জন্যেই আমার একটা বলতে পারো ষড়যন্ত্র থিওরী মাথায় দানা বাঁধছে। শোন। কাল কবচের সিম্বল গুলির একটা আমার কাছে একটু পরিচিত লাগলো। সন্দেহ দূর করতে প্রথমে গুগল করে নিলাম, কিন্তু মিললো না যা ভাবছিলাম, এরপর আমার সেই সিম্বল বিশারদ নুরু ভাইকে সেটার ছবি পাঠালাম, এবং যা ভেবেছিলাম তাই, এটা পুরোনো আর্মেনিয়ান পেত্রোগ্লিফ।

-পেত্রোগ্লিফ কি জিনিস? জানতে চাইলাম।

-হায়েরোগ্লিফের মতই, যেটা পাথর কুঁদে আঁকা হত, সেরকম একটা প্রতীক।

-দাঁড়াও দাঁড়াও, কোথায় সেই আর্মেনিয়া আর কোথায় এই নারিন্দার আলিম চার্কি। তার হাতে এই জিনিস কোত্থেকেই বা আসলো, আর কেনই বা আসলো?

-রাদী, আর্মেনিয়া কিন্তু আমাদের ঢাকা থেকে খুব দূরে নয়।

-মানে?

-ঢাকায় কি পরিমাণ আর্মেনিয়ানরা থাকতো তা জানো না? আর্মানিটোলা তো তাঁদের নামেই, আর একটা বিরাট জিনিস চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, বলধা গার্ডেনের ঠিক উলটো পাশেই নারিন্দা গোরস্থান, বা এখন বলে খ্রিস্টান গোরস্তান। সেটা তো আর্মেনিয়ানদেরই। আর্মানিয়া থেকে তুর্কিদের দিয়ে উৎখাত হবার পরে তারা বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। একটা বড় অংশ চলে আসে বাংলাদেশে। তারা বৃটিশদের মত আসেনি, এসেছিলো এখানেই থাকতে। ব্যবসা বাণিজ্য করতে।

-ওকে, তো কী দাঁড়ালো সব মিলে? এখানে আলিম সাহেব কোত্থেকে এলেন?

-ভুলে যেওনা আলিম সাহেবের পরিবার অনেক পুরোনো ব্যবসায়ী, এবং শোনা যায় তাদের পরদাদা, মানে কিনা গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার আর্মেনিয়ানদের সাথে ব্যবসা করতেন। এও শোনা যায় কোন এক আর্মেনিয়ান বড় ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসা করে পরে সেই ব্যবসাটি-ই কিনে নিয়ে তাদের এই সম্পত্তি।

-ওকে, তা বুঝলাম, মেনে নিলাম সেসময়ের একটা কবচ বংশানুক্রমে তার হাতে চলে এসেছে। -তাহলে সেটা মৃত্যুর সময় তার হাতে কেন?

-তা জানি না, তবে ওই সিম্বলের মানে করলে সেটা অনেকটা ভূত তাড়ানোর মন্ত্র টাইপের একটা কিছু। মানে ধরো- দূর হয়ে যাও অভিশপ্ত আত্মা। এইরকম কিছু।

-কিছু মনে করবেন না, আমার কিন্তু বেশ লাগছে আপনার এনালাইসিস, অনেকটা ফেলুদা ফেলুদা।

-কাল বললেন শার্লক হোমস, আজ একেবারে বাঙালী?

-ইয়ে সরি, আমি মজা করছি না। আসলেই বলছি।

-ওরকম হলে খারাপ হত না, স্বার্থপরের মত কাউকে কিছু না বলে একেবারে শেষে এসে ম্যাজিকের মত সবাইকে বসিয়ে বলে দিলাম কী ঘটেছে। হাহাহা, কিন্তু সত্যি কথা হল সেটা এত সহজ না। চট করে রহস্যের সমাধান করা যায় না, সবার সাহায্য লাগে, যেমন এখন আপনারাও ভাববেন, কী হতে পারে, আর সেইভাবে আমরা একটা তদন্ত চালাবো, ঘরে বসে বসে এই পর্যন্ত এসে ভাবাই যায় কোন এক প্রেতাত্মাকে দেখে সেই কবচটা বের করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে হাঁটু মুড়ে ওভাবেই মারা গেছেন আলিম সাহেব। কিন্তু প্রেতাত্মাায় বিশ্বাস করতে হবে যে তাহলে।

-সাদী ভাই, দেখুন এটাও কিন্তু একটা দারুণ ক্লু। তার মানে এরকম কোন প্রেতাত্মা আছে যাকে চার্কি পরিবার, বা আলিম সাহেব ভয় পায়, এটা জানতে হবে এগজ্যাক্টলি। আর নির্দিষ্ট করে বলধা গার্ডেনের ওই জায়গাটার কোন বিশেষত্ব আছে কিনা. রাদি বললো

-এই দ্যাখো, সরি সরি সরি, সাদী ভাই আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি, যে জন্যে ওনাকে আবার টেনে আনলাম আজকে, কাকতালীয়ভাবে বেশ অনেক বছর আগে ওই বিশেষ জায়গাটায় ওনার একটা অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, বলেন ভাই।

যতদিন পরেই হোক, রাহেলার ঘটনাটা যতবারই বলতে যাই অস্বস্তি লাগে, অপরাধবোধ চলে আসে, তারপরেও যতটা সম্ভব খুলে বললাম।

পুরোটা শুনে থম মেরে থাকলেন সাদী হক, এরপর বললেন,

-প্রথম অংশটা দুঃখজনক, পরেরটা আশা জাগানিয়া।

-মানে?

-মানে কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার ঘটনাটার সাথে আমাদের এখনকার ঘটনার মিল আছে। ভদ্রলোক তাঁর গোল ফ্রেমের চশমার ভেতর থেকে চকচকে চোখে চেয়ে আছেন।

-বলেন কী? কিভাবে?

-আগে বলুন ওইদিন আপনি ওই জায়গাটায় কী খুঁজছিলেন?

-একটা গাছ।

-গাছ?

-হ্যাঁ, একটা গাছ ছিলো, যেটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর আমার বন্ধু।

-এবং তখন বৃষ্টি পড়ছিলো?

-হ্যাঁ, তুমুল বেগে।

-গাছের নিচে দাঁড়িয়েও আপনার ভিজে যাচ্ছিলেন?

-না ঠিক ভিজে যাচ্ছিলাম না, তবে গায়ে পানি আসছিলো।

-গাছটা দেখতে কেমন?

-মানে?

-যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিলেন সেটা দেখতে কেমন?

-কেমন আবার, গাছ যেমন হয়, আসলে মনে নেই, তবে অনেক বড় ঝোপানো টাইপের। এদ্দিন পর সেটা মনে আসছে না।

-সেটা সেদিন গিয়ে পাননি?

-না, জায়গাটা ওটাই। কিন্তু আর পাইনি।

-চলুন।

-কোথায়?

-আবার ওখানে, একটা জিনিস একটু দেখতে হবে। মনে হচ্ছে কয়েকটা ডট দেখতে পাচ্ছি, কানেক্ট করার পালা।

-সাদী ভাই, কী বুঝলেন একটু বলবেন? উনি তাঁর মৃত ছোট বোনকে কেন দেকেছিলেন?

সেটা তো জানি না। তবে আমি একটা হাইপোথিসসি দাঁড়া করার চেষ্টা করছি। চলো যেতে যেতে বলি। নিতাই! গ্যারেজের চাবিটা দাও তো!

সাদি হক তাঁর পুরোনো মরিস মাইনরে আমাদের নিয়ে যেতে যতে বলতে লাগলেন-

দেখুন পুরোটাই ধারনা, হয়ত সেটা ঠিক হবে না, তবে পর পর দুটো কাছাকাছি ঘটনা চাইলে জোড়া দেয়া যায়। আপনি আপনার বন্ধুকে নিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে ওখানে গিয়েছিলেন, রাইট?

-হ্যাঁ।

ভদ্রলোক কী বলছেন বোঝার চেষ্টা করছি।

-আপনার বোন যেদিন পানিতে ডুবে মারা যায় সেদিনও এরকম বৃষ্টি ছিলো।

-হ্যাঁ।

-ঘটনাটা ঘটে পুকুরে?

-হ্যাঁ, ওখানেও একটা পুকুর ছিলো?

-হ্যাঁ।

-তার মানে আবহটা এমন ছিল যে আপনার অবচেতনে চেপে রাখা একটা পুরোনো দুঃখের স্মৃতি এতে আপনার সচেতন মনে উঠে আসতে পারে?

-মানে?

-মানে আমাদের যে কোন স্মৃতিই কিছু না কিছুর সাথে এসোসিয়েটেড। ধরুন ছোটোবেলায় আপনার খালা ভাল আচার বানাতেন, গ্রামের বাড়ি গেলেই সেটা খাওয়া চাই, সেটা খেতেন কোন খড়ের গাদায় বসে। এই স্মৃতিটা আপনার খুব পছন্দের স্মৃতি। অনেকদিন পরে কোথাও খড়ের গাদা দেখলেন, ঠিক যেমনটা ছোটোবেলায় দেখেছিলেন, মন সেই ইমেজটা পাঠিয়ে দিল আপনার অবচেতনে যেখানে এর সাথে এসোসিয়েটেড হয়ে আছে আচার। বাসায় ফিরেই আপনার মনে হল কতদিন খালার বানানো আচার খাই না। অথচ কেন হঠাত এটা মনে হল আপনি জানেন না, মুখে আমরা তখন বলি, কেন জানি আজ খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে।

-ইয়ে, এখানে আচার টাচার কোত্থেকে-

-আহ্‌ ওটা কথার কথা বলছি। আমার প্রবল বিশ্বাস ওইদিন ওই আবহাওয়া, ওই পুকুর আপনার মনের ভেওরের সেদিনের স্মৃতিটাকে বের করে এনেছে, সেই স্মৃতির প্রায় সব উপকরণই আছে খালি মিসিং ছিলো আপনার ছোট বোন। আপনার অবচেতন তখন তাকে বের করে আনলো। আপনি তাকে দেখলেন। তবে যেরকম স্পষ্ট দেখেছিলেন তাতে স্বাধারণ কল্পনায় দিনের বেলা এমন হবার কথা না। যদি না-

-যদি না?

-যদি না আপনি কোন হ্যালুসিনেটিং ড্রাগ নিয়ে থাকেন।

-কী বলতে চাছেন? ড্রাগ? আমি?

-আহা, আপনি ড্রাগ নিতেন তা বলছি না। এখানেই প্রয়োজন পড়ছে সেই জায়গাটায় যাবার। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এখানে গাছটার কোন একটা ভূমিকা ছিলো। এরকম একটা কাছাকাছি ঘটনা আগেও একটা কেসে হয়েছে, তাই মনে হচ্ছে।

-সেকি? সেটা কেমন।

-চলুন নেমেই বলি।

দেখতে দেখতে চলে এসেছি আবার। মনটা কেমন দ্রবীভূত হয়ে আছে, তবে এটা ঠিক এরকম একটা ব্যখ্যা শুনে মনটা একটু নির্ভার লাগছে যে আমি তাহলে ভূত দেখিনি? ভয়টা একটু কম লাগছে।

জায়গাটায় পৌঁছে দেখি গার্ডেন আজ থেকে আবার সবার জন্যে খোলা হয়ে গেছে, খালি ওইদিকটা একটু ঘেরাও দিয়ে রাখা। যদিও লোকজন খুব একটা নেই।

-হ্যাঁ, এই জায়গাটা, দেখিয়ে বললাম।

সাদী হক এদিক ওদিক তাকিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলো। একটা ছোট বাঁক ঘুরতেই পুকুরের ঠিক আগে একট নতুন ছোট ঘর দেখা, ঠিক ঘর না, শেড। বৃষ্টি বা রোদ থেকে বাঁচতে চারদিক খোলা একটা ঘর মতন। সেটার ঠিক পাশেই একটা ছোট ঝোঁপানো গাছ। সাদী হক ঠিক তার নিচেই কী যেন খুঁজছেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দেখে যান।

এগিয়ে দেখি ঝোপঝাড়ের মধ্যে প্রায় দেখা যায় না এমন একটা গাছের কাণ্ড।

-সম্ভবত এই হল আপনার সেই গাছ। কেটে ফেলা হয়েছে। আপনি এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলনে। এই ঘরটার আড়ালে পড়ে গেছে জায়গাটা।

-ঠিক তাই মনে হচ্ছে আমারও। ওখানে দাঁড়ালেও পুকুরটা ওভাবেই দেখা যায়।

তবে দেখুন ঠিক তার পাশেই এর থেকে একটা শাখার মত বের হয়েছে, মানে পূনর্জন্ম হয়েছে গাছটার। এই ছোট ঝোপানো গাছটা ওটারই পরের প্রজন্ম। এটা কী গাছ সেটাই হল এখন প্রশ্ন। দাঁড়ান একটা ছবি তুলে নেই, বলে মোবাইল ফোনটা বের করলেন তিনি। ওদিকে আজ চান্স পেয়ে ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে রাদি। সাদী হক তার ছবিটা কাউকে পাঠালেন মনে হল।

-চলুন বাইরে একটু চা খাওয়া যাক। ছবিটা আমার পরিচত এক বোটানির প্রফেসরকে পাঠালাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাম কবির স্যার। দেখা যাক উনি চেনেন কিনা।

চা খেতে খেতেই হঠাত উদ্যানের গেটের দিকে একজনকে দেখে হাত নাড়লেন সাদী হক, বেশ লম্বাচওড়া সুন্দর চেহারার এক যুবক, সাথে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা, যুবককে দেখে মনে হল আমাদেরকে এখানে যেন আশা করেনি সে। তারপর হেসে এগিয়ে এলো।

-আরে কেমন আছেন? আপনি এখানে? বলে সাদী হকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।

-হ্যাঁ, আমারো একই প্রশ্ন যদিও- ভাল কথা, পরিচয় করিয়ে দেই, ইনিই আলিম চার্কি সাহেবের বডিগার্ড কাম ডান হাত রাসেল।

এর সাথেই তার মানে আগে কথা হয়েছিলো সাদী সাহবের।

যুবক বেশ সপ্রতিভ চেহারার,

-সেদিন আসলে এত ভীড়ের মধ্যে এলেন আর এমন একটা সময়ে, একেবারেই আপ্যায়ন করা হয় নি আপনাকে। কাকীও পরে আক্ষেপ করছিলো।

-বাদ দিন, ওটা আপ্যায়নের সময় না, তা হঠাৎ এখানে কী মনে করে?

-স্যার মারা যাবার পর মাঝে মাঝেই আসি, মনটা খারাপ লাগে, আর বিশেষ করে কাকী বারবারই আসতে চাচ্ছিলেন এখানে। হয়ত জানেন না, আমাদের পরিবার অনেক আগে থেকেই এনাদের সাথে আছেন। আমার বাবাও আলীম স্যারের বাবার ব্যবসার ম্যানেজার ছিলেন।

-তাই নাকি? আচ্ছা এর পর আর কোন কারণ বের করতে পেরেছিলেন কেন উনি এখানে এসেছিলেন?

-না, কোন আইডিয়া নেই। হয়ত একটা রহস্যই রয়ে যাবে এটা।

সাদী হক কিন্তু আমরা কী কী ভাবছি তার কিছুই একে বললেন না। চা খাবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে চলে গেল রাসেল। সে যেতে না যেতেই সাদী হকের মোবাইলে মনে হল সেই গাছ বিষয়ক প্রশ্নের জবাব এসে গেল। মোবাইলে কিছু একটা দেখে নিয়ে বললেন-

-হুম, যা ভেবেছি ঠিক তেমন না হলেও কিছুটা মিলেছে। এটা একটা ‘মাঞ্চিনিল’ ধরনের গাছ।

-সেটা আবার কী?

-খুবই বিষাক্ত একটা গাছ আছে দক্ষিণ আমেরিকার, মাঞ্চিনিল, আরেক নাম 'মৃত্যু-বৃক্ষ'। প্রচণ্ড বিষাক্ত। তবে স্যার বললেন এটাই সেই গাছই কিনা বোঝা যচ্ছে না, তবে মিল আছে।

-বলেন কী? এখানে এই গাছ?

-আসলে এখানে তো অসংখ্য গাছ জড়ো করা হয়েছিলো সেই প্রথম থেকেই। হয়ত এই ধরনের একটা গাছও সংগ্রহে রাখার জন্যেই আনা হয়েছিল। পরে তো কেটেও ফেলা হয়েছে। নিশ্চই বিষাক্ত জেনেই সেটা আর রাখা হয়নি। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা মাঞ্চিনীল না, ওই ধরনের কিছু একটা হয়ত ওরকম বিষাক্ত না। স্যার বললেন এটা সামনাসামনি দেখলে আরো ভাল বলা যাবে।

-তো কী দাঁড়ালো সেখান থেকে? প্রশ্ন করলাম।

-তা জানি না, তবে এই ধরনের বিষাক্ত গাছের নিচে যদি বৃষ্টির সময় দাঁড়ান তবে সেটা খুবই বিপদজনক। কারণ তখন পানির সাথে গাছের রস মিশে এসে পড়বে আপনার গায়ে এবং সাথে সাথে চামড়ায় ফুসকুড়ি পড়ে যাবে, সেই সাথে উল্টোপাল্টা দেখার ও সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এর কিছু অজানা ড্রাগের কল্যাণে।

-আলীম চার্কির চামড়ায় যেমন ছিল?

-আর আমি সে কারণেই দেখেছিলাম রাহেলাকে?

-হতে পারে।

এবারে আমার কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিতে লাগলো। একটা গাছ তবে এতটা কাণ্ড ঘটাতে পারে?

-তারমানে সেদিনও কি বৃষ্টির সময় আলীম সাহেব এই গাছের নিচে এসে এরকম উল্টোপাল্টা কিছু দেখেন? আর তার পরে সেখান থেকে আতংকে মৃত্যু?

-হতেই পারে, কিন্তু এটা বললে সবার কাছে হাসির পাত্র হবার সম্ভাবনা আছে, আমাদের লাগবে নিরেট প্রমাণ। যে এমন কেউ আছে কিনা যে গাছটার এই দ্রব্যগুণ সম্পর্কে জানতো ও একেবারে সঠিক সময় লোকটাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে ভূতের ভয় দেখিয়েছিলো, যাতে লোকটা মরেই গেল।

-তাহলে সেই সূত্র ধরে আমরা যদি এখন মোটিভ খুঁজতে যাই? মানে উনি এভাবে মারা গেলে তাঁর খুব কাছের কার কি কোন উপকার আছে?

-সো ফার, নো মোটিভ।

-তার মানে আবার সেই অন্ধকারেই?

-তা কেন? মোটামুটি বাতাসের ওপর ভর করে জোড়াতালি দিয়ে আমরা একেবারে একটা গাছকে খুনি হিসেবে দাঁড়া করিয়ে দিলাম এই বা কম কী?

-হাহাহা, যা বলেছেন।

-চলুন কথা বাদ, বাড়ি চলুন, আপাতত কাচ্চি চলুক। বাকিটা বুঝতে একটু মাথা খাটাতে হবে।


বিষবৃক্ষ

প্রতিবারেই সাদী হকের মুখে যখন এ ধরনের কোন কিছু শুনি শোনার সময় বেশ বিশ্বাসযোগ্য লাগে, যতই সময় পার হয় ততই সেটা আস্তে আস্তে গল্প গল্প লাগা শুরু হয়। এবারেও তাই মনে হচ্ছে। কী সব বলে দিলেন। তবে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যাচ্ছে না, কারণ এই অদ্ভুত উপায়েই লোকটা বেশ কিছু কেস সমাধান করেছেন। নিহিলিন ক্লাবের মূল উদ্দেশ্যই হল এই ধরনের আপাত দৃষ্টিতে অলৌকিক সব কিছুকে একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার ছকে ফেলে সমাধান করা। গাছটার কথা শোনার পরে অফিসে ফিরেই বেশ কিছু খোঁজাখুঁজি করলাম বিষাক্ত গাছ নিয়ে। উনি খুব একটা ভুল বলেন নি, মাঞ্চিনিল নামের একটা বিষাক্ত গাছের কথা পাওয়া যাচ্ছে। আর সেটা মিলিয়ে যেই ঘটনা উনি ফেঁদেছেন তা হতেই পারে। কিনুত তাতে করে রহস্যের জট ছুটছে না। ঘটনাটা বেশ ভাবাচ্ছে আমাকেও। তাকে নিজেই ফোন করবো কিনা ভাবছি এমন সময় রাদীর আগমন অফিসে।

-তারপর ভাই, কী অবস্থা?

-আমার অবস্থা বাদ দাও। কেসের কী অবস্থা?

-হাহাহা দেখেছেন? এখন বুঝেছেন কেন আমি সাদী ভাইয়ের সাথে সাথে লেগে থাকি? এটা অনেকটা নেশার মত। রহস্যের জট না ছোটা পর্যন্ত মাথা আর ঠাণ্ডা হয় না। ভাল কথা ভাই, সেই যে বলেছিলাম ওই উদ্যান নিয়ে একটা ফিচার বানাই, সেটা ঠিক করেছেন?

-হ্যাঁ, আমি বরং এটার সাথে মিলিয়ে আর্মানিটোলার ইতিহাস ও ঢাকার পুরোনো কিছু পরিবারের ইতিহাস মিলিয়ে কিছু করতে চাই। আরেকটু পড়ে নেই। অলরেডি খুবই চমৎকার কিছু জানতে পেরেছি, যেমন আমরা যে খাজা পরিবার, আই মিন পুরোনো ঢাকার নবাব পরিবারের নাম জানি তাঁদের খাজা পদবিটাও এসেছে কোজা থেকে সেটা দুই আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীর পদবী। আমাদের এই চার্কি পদবীও কি তেমনই? তাই হবে। ভেবে দেখো ব্যবসা করতে করতে ব্যবসা তো নিজেদের হাতে এলই এমনকি পদবীও। খুবই অদ্ভুত।

-সাদি ভাইয়ের সাথে কথা হল আজ, বললেন বয়স্ক এক আর্মানিয়ান বংশধর এখনো আছেন আর্মানিটোলায়, তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেসের ব্যাপারে কথা বলতে, বলনে বেশ কিছু দারুণ আপডেট আছে।

-কী আপডেট? সেটা চাইলে সামনাসামনি শুনতে পারেন, ইন ফ্যাক্ট সামনাসামনি দেখতেও পারেন, কারণ সাদী ভাই বলেছেন আজ রাতে কেসটার একটা সমাধান হতে পারে, আপনি কি তার সাক্ষী হতে চান কিনা?

-বলো কী? এতো একেবারে ডিটেকটিভ গল্পের ক্লাইমেক্স?

-বলতে পারেন।

-ঘটনা কী?

-ঘটনা কী জানি না, তবে সাদী ভাই সন্দেহ করছেন যদি আদৌ কোন মানুষ এর পেছনে প্রভাব ফেলে থাকে তবে সে আজকে একবার সেই জায়গায় যাবে।

-সেকি? কেন?

-অত শত জানি না। আপনি গেলে চলেন। থাকছেন ইন্সপেক্টর এনামুল, সাদী ভাই, সাথে আমি। আপনার কথা বলিনি, তবে প্রথম থেকেই যখন আছেন আমার মনেহয় উনি না করবেন না।

বেশ একটা উত্তেজনা বোধ করছি রাদী।

আমিও।

-দাঁড়াও, রিয়াকে বলে নেই।

-রিয়া পারলে ফোনের মধ্যেই উড়ে চলে আসে। সেও যেতে চায়, তবে এখন সেটা চট করে করা যাবে না তা সেও জানে। একই সাথে সাবধান করতেও ভুললো না, কী না কী ঘটে, কিসের মধ্যে গিয়ে পড়ছি কে জানে, শুনে আমারও একটু ভয় ভত করছে যদিও, তাও পুলিশ টুলিশ থাকবে যখন তখন আর ভয় পাচ্ছি না।

যা আছে কপালে ভেবে দ্রুত হাতের কাজ শেষে করে আবার সেই রাদীর রেনেগেডে চেপে বসলাম। গন্তব্য বলধা গার্ডেন, মাঞ্চিলিন তলা, সময় রাত ১১ টা।

যা ভেবেছিলাম সতর্ক আয়োজন তার চেয়ে বেশী। এনামুল সাহেব সিভিলে আছেন, সাথে সেই সেন্ট্রি দুজনো বিরক্ত মুখে বসে আছে, বেচারার বোধহয় এভাবে কাজ করে অভ্যস্ত না। পুলিশ হয়েও চোরের মত সবাই ঝোপঝাড়ে ঘাঁপটি মেরে বসে আছে, আর এদিকে বেশ মশা। কিন্তু শব্দ করে মারারও উপায় নেই। রাতের অন্ধকার কিন্তু খুব বেশী না আজ, আকাশে বেশ বড়সর একটা চাঁদ আছে। এটা বরং ভয়েরই ব্যাপার। সাদী হক প্রথমেই সবাইকে বুঝিয়ে বলেছেন কী করতে যাচ্ছি। আমাদের দু’জনকেই বেশ অনেকবার মানা করলেও আমরা এই দৃশ্য মিস করতে চাচ্ছিলাম না, উনি বললেন, একেবারে শব্দ না করে থাকতে আর আদৌ কেউ এলে আমরা যেন কিছু না করি।

ওনার ডিডাকশনটা একেবারেই সহজ। যদিও বেশ কটা ‘যদি’র উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যেমন- যদি আদৌ কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে আলিম সাহেবকে এখানে এই বিষবৃক্ষের নিচে এনে থাকে, এবং যদি সে কিছু একটা প্রমাণ এখানে ফেলে যায় তবে এখন যখন কোন সতর্কতা নেই তখন সে সেটা সরিয়ে ফেলতে আসতে পারে। এটাই। হয়ত সারারাত এমনি-ই বসে থাকতে হবে। উদ্যানে কোন সিসি ক্যামেরা এখনো নেই, নইলে হয়ত ক্যামেরা ফুটেজ আমাদের কিছুটা সাহায্য করতো। ডানে বামে তাকিয়ে দেখি, পুলিশ ইন্সপেক্টর এনামুল একেবারে ঘাপটি মেরে বসে আছে, নিশ্চই অস্ত্র শস্ত্র আছে সাথে, সেন্ট্রি দুজনকে দেখা যাচ্ছে না, রাদি আমার ঠিক সাথেই। আর সাদী ভাই বসে আছেন আরেকটু সামনে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর আমার সত্যি মনে হল পুরোটাই স্বপ্ন, কেন আমি এখানে চলে এলাম, আর এরকম করে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে থাকলাম তা ভাবতেই হাসি পেল। আসলে সাদী হক লোকটার মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে, আর সেই সাথে এরকম অদ্ভূত জমাটি রহস্য গল্পের মত ঘটনাটা আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু অন্যরকম উত্তেজনার তৈরী করেছে।

- ‘ক্যাঁআআআচ’ করে করে একটা হালকা শবদ হওয়াতে ভাবনায় বাধা পড়লো। সবাই তটস্থ- কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা লক্ষ্মী প্যাঁচা উড়ে গেলো ওপর দিয়ে। হাহাকারের মত ছোট্ট এক পশলা বাতাস এসে আশে পাশের ঘাসের জঙ্গলে একটা সুক্ষ্ম শোঁ শোঁ শব্দের সৃষ্টি করলো। উত্তেজনায় সবাই টানটান, সত্যি সত্যি কেউ চলে আসবে এটা ভাবিনি, সম্ভবত কেউই ভাবে নি, শুধু সাদী ভাই ছাড়া।

এবং হ্যাঁ। কালোর মধ্যে আরো গাঢ় কাল পোচের একটা অবয়ব নিয়ে কেউ একজন হেঁটে আসছে। বেচারা ঘুণাক্ষরেও নিশ্চই ভাবেনি আমরা এতজন এভাবে বসে আছি। অবয়বটা আসতেই এনামুল সাহেব নড়ে উঠবে কিন্তু সাদী ভাই দেখলাম হাত তুলে অপেক্ষা করতে বললেন। এখন না, উত্তেজনায় আমার বুক ঢিবঢিব। রাদীরও নিশ্চই তাই। কিন্তু, কিন্তু এ সময়ে তো অনেক কারণেই একজন মানুষ এখানে আসতে পারে। পারে কী? কী জানি। উদ্যানের দারোয়ানেরা এসময় তাদের পাশের কোয়ার্টারে চলে যায়। তাদের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছেন এনামুল সাহেব, সংকেত দিলেই তারা যেন গেট টেট আটকে ফেলেন। তবে আমার ধারনা এই লোকটা অন্য কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে।

এখনো সবাইকে অপেক্ষা করতে বলছেন সাদী ভাই, লোকটা হেঁটে আমাদের দিকেই আসছে। একবার মনে হল সোজা আমার দিকে আসছে, কী করবো বুঝতে না পেরে সাদী ভাইয়ের দিকে তাকাতে যাব ঠিক তখনই লোকটা দিক পালটে সেই নতুন বানানো শেডের দিকে চলে গেল, কিছুক্ষণ ঝুঁকে কিছুই একটা খুঁজলো, সম্ভবত পেয়েও গেল। এবং তারপরেই বের হয়ে এল, এইবার। ঠিক যখনি সে আমাদের সামনে দিয়ে আবার যেতে লাগলো এইবার সাদী ভাই সিগন্যাল দিলেন। সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই। বিরক্ত মুখের সেই সেন্ট্রি দুইজন অবশেষে স্বরূপে আবির্ভূত হতে পেরে বিরাট খুশী মনে হল। তারাই প্রথমে লোকটাকে আঁকড়ে ধরলো। উত্তেজনায় আমরাও ছুটে গেলাম, যদিও আমার মনের মধ্যে একটা চিকন সন্দেহ ছিল যে দেখা যাবে নিতান্তই সাধারণ কাউকে ভুল করে ধরে পরে পস্তাবো সবাই।

লোকটা ছাড়া পাবার জন্যে বেশ অনেক্ষণ টানা হ্যাঁচড়া করে শেষে ক্ষান্ত দিয়ে বসে পড়লো, আর ততক্ষণে সাদী ভাই তার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ঠিক তার মুখ বরাবর ফেললেন-

রাসেল!

-কেমন আছেন? যা খুঁজতে এসেছিলেন পেয়েছেন? নাকি কাকার কথা মনে করে এই রাত বিরেতে এখানে দুঃখ করতে এসেছেন।

-মানে? কী বলছেন আপনারা?

-চলেন চলেন, যা বলার জায়গামত বসে বলবেন, থানায় চলেন।

-কেন কিসের অভিযোগে? রাতের বেলা একটা উদ্যানে ঢোকার জন্যে?

-তা একটা ট্রেসপাসিং এর কেস তো দেয়াই যায়, তবে বাকি কথা আমরা পরে বলছি, এই ওনাকে নিয়ে যাও। বলে ইশারা করলেন এনামুল সাহেব।

-কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। রাদীরও সম্ভবত একই দশা।

সাদী ভাই খালি বললেন- চলে আসুন থানায়, আমি এনামুলের সাথে যাচ্ছি।

রাত প্রায় বারোটা, এরকম সময়ে থানায় আসার অভিজ্ঞতা নেই, ঢুকেই অবশ্য মনে হলো না রাত হয়েছে। একেবারে জমজমাট। এরকম একটা দূর্ধষ জট পাকানো কেসের সম্ভাব্য আসামীকে যে আমরা এমন করে ধরে ফেলেছি সেটা ভেবেছিলাম দেখেই সবাই হই হই করে উঠবে, কিন্তু বাস্তবতা হল আরো অনেকেই অন্যান্য অনেক কেস নিয়ে ব্যস্ত। এক বোরকা পরা মহিলাকে দেখলাম বাচ্চা কোলে বসা, ওদিকে এক সি এন জি ওয়ালাকে ধরে নিয়ে এসেছে পুলিশ কি এক অপরাধে, সে বার বার পুলিশের পায়ে পড়তে চাইছে। এরকম আরো বেশ কিছু থানার কর্মকাণ্ড পাশে রেখে আমরা এনামুল সাহেবের রুমে রাসেলকে নিয়ে ঢুকে বসলাম। রাসেল কেমন যেন চুপ করে গেছে। সুন্দর চেহারাটা কেমন বিমর্ষ হয়ে আছে। তার সাথে থাকা ঝোলা ব্যাগ ইতিমধ্যেই জব্দ করেছে পুলিশ। ভেতর থেকে বের হল- না কোন অস্ত্র না, একটা উইগ। ষাটের দশকের ঢেউ খেলান চুলের সাথে জুলপি জুরে দিয়ে যেমন হত তেমন। অবাক কাণ্ড।

ঠিক তখনই হেসে উঠলো রাসেল।

-কী করবেন এবার? আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? নিজের পরচুলা নিতে বাগানে গিয়েছিলাম এটা? জানেন না বোধহয় আমি অনেক আগে থেকেই থিয়েটার করি। কাকা মারা যাবার আগেরদিন থিয়েটারের লোকদের সাথে ওখানে ঘুরতে গিয়ে ব্যাগটা ফেলে এসেছিলাম। সেটা আজ ফেরা পথে -মনে হল নিয়ে আসি।

সাদী হক স্মিত হেসে একবার এনামুল আরেকবার রাসেলের দিকে তাকালেন।

-ডিয়ার রাসেল, প্রথমত মনে করার কোনই কারণ নেই যে আমরা একেবারে কিছুই না জেনে আন্দাজে হুট করে গিয়ে তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে আলিম চার্কি সাহেবের মৃত্যুতে ভূমিকা রাখার জন্যেই ধরা হয়েছে। এত রাতে তুমি তোমার উইগ আনতে গিয়েছিলে কারণ এই উইগ দিয়েই তুমি তোমার পিতামহের চেহারায় তার সামনে এসে তার মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করেছিলে, তাই না রাসেল আগামিনাস সার্কি?

-অবাক হয়ে তাকালাম সাদী হকের দিকে, এটা আবার কার নাম?

চমকে সাদী ভাইয়ের দিকে তাকালো রাসেল।

-এই কেসটা আসলেই অভিনব বুঝলে রাদী? কয়েক পর্যায়ে এটার জট ছোটাতে হয়েছে। তবে সত্যি বলতে একেবারে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও আমার কাছে সব পরিষ্কার ছিলো না। আমি আমার এনালাইসিসটা বলি, সেই ক্লিশে গোয়েন্দা গল্পের মতই আরকি, হাহাহা। ভুল হলে শুধরে দেবার জন্যে আছে সার্কি সাহেব।

-ঢাকায় প্রথমদিকে যে সব আর্মানিয়ান পরিবার ব্যবসা করতো তাদের একটা বড় পরিবারের নাম পদবী ছিল সার্কিস, তারা মূলত পাটের ব্যবসা করে প্রচুর ধন সপত্তির মালিক হয়। তাদের দ্বিতীয় পুরুষ যোসেফ সার্কিস সাথে প্রথমে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেয় গরীবুল্লা নামের এক লোক। সে ছিল বেশ চতুর ও লোভী। সেই তুলনায় তার মালিক যোসেফ ছিল সরলমনা। দিনে দিনে তার বিশ্বস্ত হয়ে একদিন সুযোগ বুঝে তার বিরাট সব আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়ে সে নিজেই তার সব কিছু কিনে নেয়, এবং পরে যখন যোসেফ সেটা জেনে ফেলে তখন তাকে সুকৌশলে হত্যা করে। ব্যবসার প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়ে নিজের পদবী পালটে এক সময় লোকমুখে নিজেই হয়ে যায় গরিবুল্লা সার্কি, সেখান থেকে চার্কি। আমাদের আলীম সাহেব তারই বংশধর। এখানে আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, সেটা হল, সেই যোসেফ সার্কিস এর একটা ছোট ছেলে ছিলো, সবাইকে সুকৌশলে একটা ঘরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় গরীবুল্লা, যাতে পরে সেটাকে দূর্ঘটনা বলে চালানো যায়, কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে সে মারতে পারেনি। তাকে আগেই নিজের কাছে এনে রেখেছিলো সে। এবং নিজের পালক পুত্রের মতই আদরে বড় করে। সে কখনই নিজের বাবা মায়ের এই ঘটনা জানতে পারেনি। সে বড় হয়ে বিয়েও করে এখানেই, এবং বংশ পরম্পরায় তারা এই পরিবারের সাথেই থেকে যায়। খুবই নাটকীয় কিন্তু এরকমই ঘটেছে। আর ওদিকে গরীবুল্লাহ অপরাধবোধের কারণে শেষ বয়সে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই সে তার সেই মনিবের প্রেতাত্মাকে দেখতে পেত। সে বেশ তুকতাকে বিশ্বাস করত, তাই তখনকার এক বিখ্যাত গণকের শরনাপন্ন হয় সে, সেই গণকও ছিল ঢাকায় আসা এক আর্মেনিয়ান। আসলে বেশ কিছু স্থানীয় তাবিজ কবচ ব্যবহারের পরেও সেই ভূতের থেকে রেহাই না মেলায় তার মনে হয়েছিলো ওই দেশের ভূতের দাওয়াই ওই দেশের কাউকে দিয়েই করতে হবে। সেই গণক তাকে দেয় এই পেত্রোগ্লিফ প্রতীক ওয়ালা কবচ। এটা আসলে প্রাচীন আর্মেনিয়ান একটা লিপি, মানে হল, অশুভ দূর হোক। কবচ রাখার পর তার এই ভূত দেখা কমেও গিয়েছিলো, মনের ব্যাপার আরকি, যাকে বলে প্লাসিবো ইফেক্ট। তবে শেষে বয়সে কবচটা হারিয়ে যায় আর তারপর থেকে তিনি আবার সেই ভূত দেখা শুরু করেন, শেষমেশ একদিন বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে!

আশ্চর্যজনকভাবে সেই কবচটা তার মৃত্যুর পরেই পাওয়া যায়, এবং সেভাবে বংশ পরম্পরায় সেটা আলীম সাহেবের হাতে আসে, এবং নিয়তির ফের, আলীম সাহেবের বাবাও কোন একটা কারণে আত্মহত্যা করেন। এরপর সেটা এসে পরে আলীম সাহেবের হাতে, এবং তিনি যেন মনে মনে জানতেন।

-বলেন কী? বলল রাদী। এসব আপনি কিভাবে জানলেন?

-সেই যে বললাম এক বয়স্ক আর্মেনিয়ান এখনো বেঁচে আছেন এখানে, এই ঘটনা নাকি আরো অনেকেই জানতো, তারা প্রায় সবাই মারা গেছে। আর তার চেয়ে জোরালো রেফারেন্স পেয়েছি একেবারে সরাসরি আলীম সাহেবের স্ত্রীর থেকে। আলীম সাহেব মাঝে মাঝেই ডায়রি লিখতেন। সেই ডায়রিটা আলীম সাহেবের স্ত্রী আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। সেখানেই সেই যোসেফের ঘটোনাটা বলা আছে। আর সব যে তিনি রাসেলকে দিয়ে যাবেন সেটাও বলা আছে।

ওদিকে রাসেল যেন কিছুই শুনছে না এভাবে থানার দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদী ভাই টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলেন, তারপর আবার শুরু করলেন-

-ওদিকে গরিবুল্লার বংশধর যেমন আলীম চার্কি, তেমনি সেই যোসেফের বংশধর বা তৃতীয় পুরুষ হলেন আমাদের এই রাসেল।

-তার মানে রাসেলের বর্তমান মুনিব আসলে তার দাদার হত্যাকারী, এবং এই সব স¤পত্তি আসলে এক সময় এদেরই ছিলো!

-আর সেজন্যেই আমি তাকে খুন করেছি? কিভাবে? হাস্যকর সব কথা বলছেন। কবে কোন আমলে কী হয়েছিলো সেটা নিয়ে এখন কী যায় আসে?

-আসে যায়, যদি তার সাথে যোগ হয় লোভের।

-মানে?

-মানে সম্প্রতি তুমি কোন একভাবে জানতে পেরেছিলে যে সেই পুরোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আলিম সাহেব তার সম্পত্তির একটা অংশ তোমার নামে দিয়ে দেবেন, আর খুব সম্ভব আসল ঘটনার প্রায় পুরোটা তিনিই তোমাকে বলেছিলেন। সেখানে থেকে তোমার আশ্রয়দাতাদের প্রতি একটা ঘৃণা তৈরী হবার সাথে সাথে তোমার মাথায় অদ্ভূত বুদ্ধিটা আসে। এবং তার জন্যে তোমার আর তর সইছিলো না, পুর্বপুরুষেরা কে কেমন ছিল তা অন্য কথা কিন্তু এই লোক কিন্তু তোমাকে আসলেই স্নেহ করতেন।

এই পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে ডুকরে উঠলো রাসেল। দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। রীতিমত নাটকীয় অবস্থা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, এবারে সার্কিস বংশের তৃতীয় পুরুষ উলটো অনুশোচনায় আক্রান্ত। এরকম সত্যি ভাবা যায় না। আমরা তাকে এনামুল সাহেবের হাতে রেখে এসে ওভাবেই বের হয়ে গেলাম। বোঝাই যাচ্ছে বাকি সব কাজ এখানে থেকে বুঝে নিতে পারবে তারা

সাদী ভাই, এটা কি আসলে হত্যাকাণ্ড? সেটা আইনের লোকদেরই ভেবে বের করতে দাও। আসলে এমনিতে এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন তবে আমার মনে হয় রাসেল নিজেই সবকিছু খুলে বলবে।

আপনি এরকম নিশ্চিত হয়ে ওকে জেরা করলেন কিভাবে?

-ওই যে বললাম সেই বুড়ো আর্মানি ভদ্রলোক, আর ওদিকে স্বয়ং মিসেসে চার্কি- বা মিসেস আলীমের দেয়া ডায়রি। উনিও আমার ধারনা কোনভাবে সন্দেহ করেছিলেন রাসেলকে।

-কিন্তু রাসেল আসলে কিভাবে করলো কাণ্ডটা?

-দেখো সেটা ও-ই ভালো বলতে পারবে, তবে খুব সম্ভব সে তার সেই পরদাদার একটা ছদ্মবেশ নিয়েছিলো, মানে ভূত সেজেছিল আর কোন একটা কথা বলে কাকাকে ওইখানে ডেকে পাঠিয়েছিলো। আলীম সাহেব জানতেন তাদের বংশের এরকম একটা পাপ আছে, আর সেটা তাদের দুই পুরুষ ধরে তাড়া করে ফিরছে। শেষ বয়সে যোসেফ সার্কিস এর হাতেই তাদের সবাইকে একে একে মরতে হবে। তাই বেশ কিছুদিন ধরেই সেই কবচটা নিয়ে ঘুরতেন।

-আর সব মিলে এখানে আমাদের সেই খুনি গাছের তাহলে ভূমিকা কী?

-সেটা এখনো বুঝতে পারছি না, সম্ভবত সে নির্দোষ, কাকতালে মিলে তার নিচেই ঘটনাটা ঘটেছে। তবে আমার বিশ্বাস ওই সময়ের বৃষ্টিতে আলীম সাহেবের সামনে আর্মানি ভূতটাকে আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য করাতে তার ভূমিকা ছিল, আর সেই সাথে তার হাতের ফুসকুড়ি দাগের।

-বাপরে, এ নিয়ে তো রীতিমত একট বড় রহস্য গল্প লিখে ফেলা যায়, বলে উঠলাম।

লিখে ফেলুন না, বলেই তাঁর ব্র্যান্ডেড স্মিত হাসিটা দিয়ে মরিস মাইনরের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন সাদী হক, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন

- চাই কি কোন একটা ছোটদের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশও হয়ে যেতে পারে, ভুলেও বড়দের পাতায় দেবেন না যেন। তারা সাথে সাথে ভুল খুঁজে বের করবে।

তিনজনই একসাথে হেসে উঠে নাটকের শেষ দৃশ্যের মত সেই রাতের মত শেষ হল আমাদের অভিযানের।

মেহেদী হক

২০২০ কিশোরবাংলা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত