Tuesday, July 31, 2012

একদিন সকালে


খবরের কাগজে নাকি আমার মৃত্যুর সংবাদ বেরিয়েছে কাল!
আমি খবরের কাগজ রাখি না, পড়িও না। খবরটা আমি নিজে দেখি নি। তাই বিশ্বাস করব কি না ভেবে ঠিক করতে পারছি না। আমাকে ব্যপারটা বলল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ইমন। আজ সকালে নাস্তা করবার জন্যে যখন ডিম রুটি আর এক প্যাকেট ম্যাচ কিনবার জন্যে রাস্তা পার হচ্ছিলাম আগামসী লেনের সর্বশেষ গলিটা দিয়ে, নিচে জড় করে রাখা এক গাদা ময়লা কংকৃটের টুকরো পেরোতে ছোট এক লাফে সামনে এগোতেই ইমন যেন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে উদয় হল। আর এসে কুশল টুশলের ধারে কাছে না গিয়ে সরাসরি বলে বসলো, ‘কিরে তুই এখানে? কাল যে পেপারে ছাপা হল তুই মারা গেছিস?’ মানে কি জানতে চাইলে সে জানালো কোন একটা দৈনিক পত্রিকায় (যায় যায় দিন বা প্রথম আলো অথবা বাংলাবাজার এ) শেষ দিকে ছোট্ট করে বক্স নিউজ করা হয়েছে যে আমি হৃদযন্ত্রের কৃয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছি। ঘটনাটা কি? ইমন জানতে চায়। আমি তাকে বোঝালাম ঘটনা যাই হোক আমি আসলে মারা যাইনি, মারা গেলে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। ইমনকে তাও পুরোপুরি সন্তুষ্ট মনে হল না। সন্দেহের চোখে ‘ঠিক আছে ভালো থাকিস’ ধরনের কিছু একটা বলে সে চলে গেল হাত মিলিয়ে। আমি আবার ডিম রুটি ও এক প্যাকেট ম্যাচ কিনবার জন্যে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম ধীরে ধীরে প্রচন্ড রাগ ঠেলে মাথার ওপরের দিকে উঠছে। আমার মৃত্যুর সংবাদ আমাকে না জানিয়ে কেন ছাপা হল সেটা ভেবে অসম্ভব বিরক্ত লাগা শুরু হল। ডিমের দোকানীকে অযথাই ধমকে কথা বলে ডিম পঁচা হলে যে আবার ফেরৎ- সেটা চেঁচিয়ে শুনিয়ে দিলাম। ফিরবার সময় দু’জন পথচারীকে সবেগে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলে দেবার জোগাড় করলাম। তার মধ্যে একজন বৃদ্ধ মতন অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাতেই উনি কি চোখে দেখতে পান কি না তা ঝাঁঝের সাথে জানতে চাইলাম।  অন্ধ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি আমার ৩৪ এর বি নাম্বার দালানের তিন তলায় উঠলাম। তালা খুলতে খুলতে ভাবলাম, খবরটা আর কেউ দেখেনি এখনো? আর কেউ দেখলে কি হবে? আমার বন্ধুরা? আগের অফিসের কলিগেরা? যেমন শওকত সাহেব? দারোয়ান মামুন? বা আমার বাড়িওয়ালা সেলিম সাহেব? ভাবতেই হঠাৎ করে চনমনে লাগা শুরু হল। তালা খুলতে খুলতে আমি চোখের সামনে তাদের প্রত্যেকের বিহ্ববল মুখ দেখতে পেলাম। শওকত সাহেব খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে আফসোসের ভংগিতে মাথা ডান বাম নাড়ছেন আর তার সহকারী সাত্তারকে বলছেন, দেখছেন? এরে চিনতেন না? এই যে? মারা গেছে। দেখে সাত্তারও তার মুখভঙ্গীর ভান্ডার থেকে দুঃখ দুঃখ ভাবটা বের করে এনে বলবে, আহারে। জানি এই আফসোস কারই বেশীক্ষণ থাকবে না। তাও কেন যেন ভাবতেই পুলক বোধ করলাম। ডিম ভাংতে ভাংতে ভাবলাম আরো কিভাবে এটা সম্পর্কে খোঁজ নেয়া যায়। মানে আর কেউ জানে কি না। এটা নিশ্চই ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না যে, ভাই আমি যে মারা গেছি সেই খবরটা দেখেছেন? দেখেননি? সে কি দুই কলামে বক্স নিউজ... হ্যাঁ হ্যাঁ আমি-ই তো। এটা নিশ্চই বুদ্ধিমানের মত কথা না। তাহলে? এমনিতে ফোন দেয়া যায়। কুশল জানতে। কেউ খবরটা দেখে থাকলে সে-ই বলবে- আরে তুই? (বা তুমি বা আপনি) মারা যাসনি (যাওনি/ যান নি) তাহলে? শুকনা মরিচ খুঁজতে খুঁজতে আমি আজকের দিনের একটা মোটামুটি ছক করে ফেলি। একটা লিস্টি করে নিতে হবে, কাকে কাকে ফোন দেব ও কি বলব। অনেকদিন পর মন বেশ ফুরফুরে লাগা শুরু করল। নিজের মৃত্যু সংবাদ যে এমন মজাদার হবে আগে ভাবি নি। আমি ধীরে সু্স্থে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ডিমভাজি খেতে থাকি ও  কাদেরকে ফোন দেয়া যেতে পারে সেই তালিকা মাথায় সাজানো শুরু করি। প্রথমে আবদাল। ব্যটার চেহারা কেমন হবে ভেবে তক্ষুনি হেসে ফেল্লাম। এমনিতেই তার মধ্যে সবসময় প্রবল আতংক কাজ করে। তার একটা অদ্ভুত ধারনা আছে যে শহরের কোথাও কোন একজন গুপ্ত ঘাতক তাকে মেরে ফেলার জন্যে অপেক্ষা করছে। কেন কোন গুপ্ত ঘাতক তাকে মেরে ফেলবে এটা অবশ্য সে-ও জানে না। তার কথা ইচ্ছে করে মারবে না, অন্য কাউকে মারতে গেলে ভুল করে তাকে মেরে ফেলবে। সে তাই তার আশেপাশের প্রায় সব মানুষদের সন্দেহের চোখে দেখে। আচ্ছা আবদাল গেল তারপর? মাহমুদ? উম... ...মাহমুদ... হতে পারে। এরপর সাদিক, মুন্তাসির... না মুনতাসির না। জয়ন্ত। হ্যাঁ আপাতত এ-ই। আসলে আমার পরিচিত লিস্টি অত বড় হবেও না আসলে। প্লেট ধুতে ধুতে  মনে মনে ইমনকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যেই দিনটা এমন দারুণ দিকে মোড় নিল হঠাৎ। ধীরেসুস্থে বসে আবদালের নাম্বার ডায়াল করলাম আমার পুরোনো ঘটঘটে এনালগ ফোনে...। রিং হচ্ছে... আবার... হচ্ছে... ... এবং হচ্ছেই। ব্যটা ধরছে না। আবার ডায়াল দিলাম... ... ... আবার রিং হচ্ছে...
নাহ... ধরছে না। মজাটা বোধহয় নেয়া গেল না। যাক গে আবার ফোন দেয়া যাবে। লিস্টের নাম্বার দুইএ যাওয়া যাক। মাহমুদ। মাহমুদ একটা বিদেশী সফটোয়ার ডেভেলপমেন্ট ফার্মে কাজ করে। যতবারই দেখা হয় ততবারই সে আমাকে শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে বলে। আমি প্রতিবারই হুঁ হাঁ করে কাটিয়ে দেই। ফোন দিয়ে দেখা যাক...
রিং হচ্ছে...
আবার...
-          হ্যালো?’
মাহমুদের বিরক্তি জড়ানো কন্ঠ শোনা গেল।
-          হ্যালো।
-          কি রে কি অবস্থা?
-          এইতো
-          টিএন্টি নাম্বার দেখলেই আজকাল ধরি না রে। কে না কে। খালি তোরটা সেইভ করা আর তুই ছাড়া তো এই নাম্বার থেকে আর কেউ ফোন করবে না তাই ধরলাম। অনেক ঝামেলায় আছি রে। কি বলবি বল।
অনেকটা দমে গেলাম, না। ও আমার সংবাদটা জানে না। বোঝাই যাচ্ছে
-          কি রে? কথা বলিস না ক্যান?
-          হুঁ এই তো, কেমন আছিস জানতে ফোন দিলাম।
-          আর থাকা, শেয়ারে নেমে রাম ধরা খাইলাম। তুই ভালই করছিস ইনভেস্ট না করে। শালার, পুরা মানিক চিপা। উঠাইতেও পারতেছিনা, বেইচা দিতেও পারতেছি না আর... ... (এরপর প্রায় আধা ঘন্টা আমাকে মাহমুদের শেয়ার বাজার ধরা খাবার গল্প শুনতে হল, সত্যি বলতে আমার মেজাজ মহা খাপ্পা হয়ে গেল। একে সে অকারণ বকরবকর করে যাচ্ছে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আর দুই, সে আমার নিউজটা দেখে নি...)
-          মাহমুদ
-          কি?
-          রাখি রে- বলেই ঠকাস করে ফোনটা ক্রেডলে ঠুকে দিলাম।
মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হয়ে আছে।
ঠিক বুঝতে পারছিনা পরের ফোনগুলো করা ঠিক হবে কি না।
আর কে... আর কে... লিনা?... লিনাকে ফোন দেব? বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এতদিন পর। এমন একটা বাজে কারণে। রীতিমত অসুস্থ দেখাবে কাজটা। নাহ। হেঁটে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। ৩৪ এর বি বাড়িটার নাম কা ওয়াস্তে এক চিলতে বারান্দা। এদিকে এখনো কিছুটা খোলা আছে, তবে বেশিদিন থাকার না আর। অলরেডি ডেভেলপমেন্ট এর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে ছায়ানীড় ডেভেলপার্স, যেন স্বপ্নের ছোঁয়া। বিল বোর্ডে দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা ঘাসযুক্ত প্রান্তরে সদ্য বিবাহিতা এক দম্পতি স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে। সেই ঘাসের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে আইফেল টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। রীতিমত উত্তরাধুনিক বিলবোর্ড, ডিজাইনার মনে হয় শেষের দিকে দিগন্ত ভরাতে আইফেল টাওয়ারটা বসিয়েছেন। অথবা স্বপ্ননীড় এর মালিক এমন কিছু চেয়েছেন। সাইটে এখন পায়েলিং চলছে বিরাট এক লোহার পিলারকে শর্বশক্তিতে ‘ও আমার দেশের মাটি’র ভেতরে পোঁতা হচ্ছে। কিছু চিমসা মুখের লেবার গা হাত পায়ে কাদা মেখে কাজটা দেখছে। তাদের পরণে লুঙ্গী গেঞ্জী হলেও হাতে রাবারের বিদেশী গ্লোভস আর মাথায় হলুদ একটা হেলমেট। নিরাপত্তার চুড়ান্ত। পেছনে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে কালোর মধ্যে সাদায় লেখা ‘নিরাপত্তাই প্রথম’। সাইটের ঠিক মাঝেই একটা প্রাচীন আমগাছ ভীতভাবে দাঁড়িয়ে, সে নিশ্চই বুঝতে পারছে যে কোন সময় তাকে কেটে ফেলা হবে। আমগাছটার ওপর একটা কাকের বাসা, তাতে বাবা অথবা মা কাকটা তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে, নিশ্চই সেও বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। বাসাটায় কয়েকটা নীলচে ডিমও দেখা যাচ্ছে। এসব কিছু দেখতে দেখতে আমি আমার নিজের মৃত্যু সংবাদ ভুলে যাই। প্রতিদিনকার মত সেই বারবার দেখা ঘটনাগুলির ধারাবাহিকতা বজায় আছে কি না সেটা বরং খুঁজে বার করতে থাকি। যেমন রাস্তার ওপাড়ে ফুটপাথের ধারে বসা অন্ধ ভিখারীটা আজকেও বসেছে কিনা, ডাস্টবিনের কাছে সেই কোথাকার কোন বাড়ির এক পিচচি কাজের মেয়ে নাকে কাপড় চাপা দিয়ে ময়লার ব্যগটা ঠিক ১২ টায় ছুঁড়ে মারলো কি না। কান ইয়ার ফোন গোঁজা থুতনীতে দাঁড়ি নিয়ে সেই চ্যাংড়ার দলটা হৈ হৈ করে চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ধরালো কি না। সামনের গোলাপী দালানের ছাদে সেই তরুনী উঠে কানে সেলফোন গুঁজে পায়চারী করতে করতে কথা বলল কি না। এসব দেখতে দেখতে আমি এবার অনেকটাই আমার মৃত্যুর কথা ভুলে যাই। এই এতসব ঘটনার মাঝে আমার মৃত্যুসংবাদটা চাপা পড়ে যাওয়াতে বরং খুশি-ই হই। এ শহর কত যত্নে আমার মৃত্যুসংবাদ সবার থেকে আড়াল করে ফেলল তা ভেবে রীতিমত কৃতজ্ঞ বোধ করতে শুরু করি। নিচ একটানা ডেকে যাওয়া বাবা কাকটার দিকে তাকিয়ে বলি- অনেক ধন্যবাদ।
০৫।০৫।১২

শহরে-নগরে


চণ্ড রোদ
শহর ঢাকায় পুরো দাবদাহ। সরলরেখার মত টানা রাস্তার দিকে নিষ্পলক তাকালে হঠাৎ ঘোর লাগে, মনে হয় যেন আঁকা বাঁকা কালো কোন থির ক্লান্ত নদী সোজা বয়ে গেছে। কিলবিলে মানুষগুলো হঠাৎ হয়ে ওঠে কচুরিপানা, বাসগুলো সব ভটভটি ট্রলার, প্রাইভেট কারগুলো ছোট কোষা নৌকা। রঙ্গিন বিলবোর্ডগুলো হঠাৎ বর্ণিল মেঘ হয়ে যায় অদ্ভুত এক বিষাদ নেমে আসে অকারণ। কূৎসিত কাকগুলো বউ-কথা-কও এর মত রূপসী সাজে উড়তে থাকে।

ঘোর কেটে যেতে অবশ্য সময় লাগে না। সব আবার আগের মত সহজ স্বাভাবিক হয়ে আসে। ডানদিকে হোটেল শেরাটনের সারি দেয়া মুঘল কায়দার জানালা বামদিকে সাকুরা বারের থাই অ্যালু গ্লাসে আটকা পরা উলটো দিকের তুলো মেঘ। তার ঠিক ওপরে আকাশের অনেকখানি ঢেকে দিয়ে একটা বিলবোর্ড; তাতে কিছু রঙচঙ্গে তরুনি হাতে কোকাকোলার বোতল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমরা সেল হয়া যাইতাছি বুঝলি?’ আবদাল প্রায়ই বলত কথাটা।
আসলেই কি তাই? শহর ঢাকার কোটি খানেক মানুষ দিয়ে কি ‘আমরা’ বোঝায়? কি জানি। আবদালের সাথে প্রায়ই এ সব নিয়ে তর্ক হত। যথারীতি এক পর্যায়ে আমার হার হত; যদিও দু’জনেই জানতাম এ সব হারজিত কতটা অর্থহীন। তর্ক শেষ হবার পর দু’জনেই আবার চুপ হয়ে যেতাম যেন কোথাও কিছু ঘটেনি কখনো।

আবদাল অবশ্য বেশিক্ষন চুপচাপ থাকতে পারতো না- গান ধরত। সেসব গানের কোন অর্থ হয় না। শুধু কিছু নাদ যেন এলো তালে ওঠা নামা করছেবদালের গলা ভাল বলে সবকিছু উৎরে যেত। ঢাকার সীসাজীর্ণ বাতাসে ওর গান অনায়াসে মিশে যেত। সন্ধ্যা নামতে গেলে ও চোখ কুঁচকে ফিরোজা-লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ত-

‘বলত এই সন্ধ্যাটা এমন মন খারাপ করে দেয় কেনো?’

কে জানে বাপ কেন, আর তাতে কি-ই বা যায় আসে? মুখে বলি-
‘কি জানি’
আবদালও এরপর আর উচ্চবাচ্য করতো না।
বড়জোড় সাতটা (pm)-আমরা  উঠে পড়তামহাঁটতে হাঁটতে কারোয়ান বাজার (নাকি কাওরানবাজার?) সেখান থেকে একটু হেঁটে পেছনে-জনতা টাওয়ারের পেছনেএটা নাকি একটা স্পট। কি না পাওয়া যায়। টাকা দিলে মানুষের বাচ্চা ভি। আমরা এখানে কেন আসি আমরা জানি না। মাঝে মাঝে ভাবি- এইবার একটা মার কাট লাগিয়ে দেব। একের পর এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট লিখে পত্রিকায় প্রতিবেদনে এই শহরের দুর্গন্ধময় দিকটা সব সুক্ষ রুচির গোলাপী শিক্ষিতদের সামনে মেলে ধরি। (গোলাপী শিক্ষিত শব্দটা আবদালের দেয়া, এ ধরনের আরো কত শব্দ যে ও বানিয়েছে।) আসলে কিছুই করা হয় না। শুধু ভাবনা চিন্তাই সার।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে মাছের আড়তের আঁশটে গন্ধ মাখা রাস্তাটায় চলে আসি। ডানে আকাশ্চুম্বি বিজিএমইএ’র বিল্ডিং-বেগুনবাড়ি খালের মাঝখান থেকে খাড়া উঠে গেছে, যেন আদিকাল থেকেই ওটা ওখানে ছিল, ওখানেই থাকবার কথা। খালটাই যেন হঠাৎ পথ ভুলে এদিকে ঢুকে গেছে।

‘খালগুলাই অবৈধ বুজলি?’ বলে আবদাল।

হবেও তাই, এই ঝাঁ চকচকে ফরেন-গন্ধী সেন্ট্রাল এসি ও চিকেন ব্রোস্ট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, সিনেপ্লেক্স, নকিয়া এন সিরিজ- ইত্যাদির মধ্যে জ্বলজ্যন্ত একটা খাল কিভাবে ঢুকে পরে?

সামনে হাতিরঝিল এর নিকষ কালো পানির ওপরে কিছু উঁচু বাশের তৈরি ঘরবাড়ী। এগুলিও অবৈধ- এদের রাজউক থেকে প্ল্যান পাশ করানো নেই। তার ঠিক উলটো পাশে হোটেল হিল্টনের জন্য ‘সাইট ফর’ সাইনবোর্ড টানানো। আর ঝিলের সামনে বিরাট এক সাইনবোর্ডে গুগল আর্থ থেকে নামানো  ঢাকার ম্যাপ এ চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বর্ণনা। ঢাকাই নবাবদের হাতিদের গোসলখানায় এবার বৈধ রাস্তা হতে যাচ্ছে। টানা রাস্তা উঠে যাবে ওই যে সোজা একচোখা দানোর চোখের মত লাল রঙ্গা রামপুরা টিভি টাওয়ারের বাতিটা দেখা যাচ্ছে- সেই দিকে

আমরা বাঁয়ে তাজউদ্দিন সরণিতে ঢুকে পরি। এসকয়্যার এর শো-রুমের সামনে সেই পাগল মহিলাটা এখনো আছে। নিবিষ্ট মনে সারাদিনের কুড়োনো ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ের টুকরোগুলো সেলাই করে যাচ্ছে। গত ৬ বছর ধরে একে এক জায়গাতেই এভাবে দেখছি। প্রতিদিন একইভাবে কাপড় সেলাই করে। এতদিনে বিরাট এক শামিয়ানা হয়ে যাবার কথা। দিনেরটা সে দিনেই কোথাও ফেলে টেলে দেয় বোধহয়। একে সুঁই সুতো কে কিনে দেয় সেটা আমার খুব জানবার ইচ্ছা করেআবদালকে বলতেই ও সোজা মহিলার দিকে এগিয়ে গেল।

‘কাপড় বেচবেন?’ জানতে চায় আবদাল।

মহিলা শুন্য চোখে তাকায়, বিড়বিড় করে কি একটা বলে আবার সেলাই করতে থাকে- যেন শুনতেই পায়নি

‘আপনারে এইসব কাপড় দেয় কে?’ আবদাল আবার জানতে চায়।

মহিলা সেই একইভাবে সেলাই চালিয়ে যায়। আবদাল আর কিছু জানতে চায় না। আমরা আবার হাঁটতে থাকি।

সেই চেনা রাস্তা।
ভাগ্যকূল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, ২টাকা মিনিটে কথা বলার নির্ভরতা, আদর্শ ভল্কানাইজিং, চিরবিদায় স্টোর (সামনে দাঁড়া করানো একটা স্যাম্পল কফিনসাইনবোর্ড এর নিচে ছোট করে লেখা- ২৪ ঘন্টা খোলা।)একটু সামনে নকশি কাটা ফুটপাথের কনকৃট ব্লক ঢেকে দিয়ে পড়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা কাঠগোলাপ, ভুমি জরিপ অধিদপ্তরের ভেতর থেকে ঝাঁকরে উঠেছে গাছটা। ঝালমুড়ি বিক্রেতা ছেলেটা পসরা ফেলে গ্রিলের দোকানের ছেলেটার সাথে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মেতেছে। সাতরাস্তা মোড় চলে এলাম। আমি প্রায় দিনই এখানে এসে সত্যি সত্যি সাতটা রাস্তা আছে কিনা সেটা মেলাবার চেষ্টা করি। এই ছেলেমানুষি চেষ্টার কোন যুক্তি নেই তারপরেও- সবসময়ই মনে একটা ক্ষীণ আশা থাকে যে একদিন মিলে যাবেই শৈশবের কোন একদিন আমি কিভাবে যেন একদিন সাতটা রাস্তা মিলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই এখোনো মনে হয় আমি গোনায় কোন একটা ভুল করছিহঠাৎ কোন দিন আবার গুনে মিলয়ে ফেলতে পারব।

ঘরফেরতা গাড়ীঘোড়ার ভীড় ক্রমেই বাড়ছে। ঠিক মোড়টার মাঝখানে দাঁড়ালে কেমন দিশাহারা লাগে। এতোগুলো রাস্তা থেকে এতোরকমের গাড়ী আসে।  আবদাল এইরকম ব্যস্ত রাস্তা পার হবার একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছে- কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকো গাড়ীগুলো তখন বুঝে নেবে সাবধানতা যা নেবার তাকেই নিতে হবে। তারা তখন তোমাকে বাঁচিয়ে গাড়ী চালাবে। আবদাল হঠাৎ আড়াআড়ী ভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হয়, একটা পাঁচটনি ট্রাক সজোরে হর্ন বাজাতে বাজাতে প্রানপন ব্রেক করে। মুখ বের করে ঘর্মাক্ত ড্রাইভার বিশ্রী খিস্তি ঝাড়ে। আবদাল ওই পাড়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সেগুলো শোনে। আমি ধীরেসুস্থে রাস্তা পার হই। আবদালকে এ ব্যপারে কোন প্রশ্ন করি না। এটা ওর জন্য নতুন কিছু না। জিজ্ঞেস করলে বলবে-

‘এইভাবে করলে মাঝে মাঝে বোঝা যায় যে বেঁচে আছি বুঝলি?’

আমি এ ব্যপারে ওকে দোষ দি’ না। আমিও তো মনে মনে ওই সাতটা রাস্তা মেলাতে চাই কারণ নইলে ঠিক টের পাই না বেঁচে আছি কি না। আমার চেষ্টাটা নির্দোষ আর সেটা করি মনে মনে এই যা।

আমরা আবার হাঁটতে থাকি।

আবার সেই চেনা রাস্তা।
পলিটেকনিক, বিজি প্রেস, লাভ রোড, তিব্বত, নাবিস্কো...
হলদে সোডিয়ামের আলোয় পিচের বর্ণ কেমন যাদুকরি সোনালী হয়ে ওঠে এবার মাঝখানের চুনসাদা রেখাগুলো (দিনের প্রচণ্ড রোদে যেগুলো এঁকেবেঁকে গেছে) দেখে হঠাৎ জলসর্প বলে ভ্রম হয়। জেব্রাক্রসিংগুলো যেন তিরতিরে ঢেউ। এবার আর ঘোর কাটে না। ল্যাম্পপোস্ট গুলো হঠাৎ মাছ ধরার জালি নৌকা হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশটা যেন কোন বৃদ্ধ জেলে। হাত নেড়ে নেড়ে অন্য নৌকাদের পথ দেখাচ্ছে। আশপাশের ইন্ডাস্টৃগুলো হঠাৎ গাছপালা বলে ভ্রম হয়। গোটা রাস্তাটা নদী হয়ে যায় আবার

আমরা সেই নদীতে হাঁটতে থাকি।



০৬.০৫.০৬