Wednesday, September 12, 2012

সাহস

ভোরবেলার এই সময়টা অদ্ভুত ধরনের। নেসার উদ্দিন প্রতিদিনই মনে মনে এটা নিয়ে ভাবেন। ভোরবেলায় কোনভাবে যদি ৬ টা বেজে পনের মিনিটের মধ্যে বের হওয়া যায় তবে রাস্তাঘাটে জ্যাম প্রায় থাকেই না, মালিবাগের সকালের ট্রেনের সিগনালটা থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের স্কুলে তখনো খুব বেশী ছাত্রছাত্রী আসা শুরু করে না, ট্রাফিক পুলিশগুলিও অনেকটা অলসভাবে তাকায়, সিগনাল ভাংলেও না দেখার ভান করে। কিন্তু যেই ৬ টা পনেরোর একটু বেশী হয়ে গেল সাথে সাথেই কোত্থেকে হাজার খানেক লোক যেন একসাথে হুড়মুড়িয়ে রাস্তায় নেমে আসে। মানে ওই দুই এক মিনিটের এদিক ওদিক হলে অফিসে পৌঁছানোতে প্রায় আধা ঘন্টার একটা এদিক ওদিক হয়ে যায়। নেসার উদ্দিন তাই যে কোন ভাবে সোয়া সাতটার আগে বের হবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ অনেক দেরি হয়ে গেল। বেলা ৮ টাতেও তিনি মালিবাগ রেইল ক্রসিং পার হতে পারেননি। দেরি হবার কারণটা যতবারই ভাবছেন ততবারই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সকালে বাসা থেক বের হয়ে রিক্সা করলেন, রিক্সাওয়ালা তাগড়া জোয়ান, অনেকটা রাশিয়ান সৈনিকের মত। রাশিয়ান সৈনিকদের তিনি কখনো সামনাসামনি দেখেননি, তাও কেন যেন মনে হচ্ছে একে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতেই মানাত। গলির রিক্সাওয়ালা প্রায় সবাই চেনা, একে আজ নতুন দেখলেন। রিক্সায় বসতেই রিক্সাওয়ালা রীতিমতন এক্রোবেটিক ভাবে চালানো শুরু করল। সাধারণতঃ এমন দেখলে নেসারুদ্দিন রিক্সাচালকদের হাল্কা ধমক দেন কিন্তু এর চালানোতে বোঝা যাচ্ছে সে এভাবে বেশ দক্ষভাবে চালাতে পারে। সকাল সকাল দারুণ গতিতে চলতে পেরে বেশ চনমনে হয়ে উঠতে লাগলেন নেসার উদিন। এমনি সময় হঠাৎ কোত্থেকে সামনে একটা ট্রাকের উদয়। সেই ট্রাকের কোন নড়াচড়া নেই। অধৈর্য হয়ে রিক্সাওয়ালা ট্রাকের মত আজদহা একটা গাড়িকে রিক্সার বেল দিতে লাগলো, ট্রাকের কারণে বিরাট জ্যাম, পেছনে আস্তে আস্তে লাইন লেগে যাচ্ছে। ঘটনা কি দেখার জন্যে আরো অনেকের মত উৎসুক নেসার সাহেব রিক্সায় কিছুটা দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। ব্যাপার দেখে হতভম্ব হতে হল। ব্যাপার কিছুই না-পুলিশ। এক মটর সাইকেলে তিনজন পুলিশ সামনের জন এস.আই আর পেছনে দু'জন সেপাই - তার  মধ্যে একজন ট্রাকের দিকে থৃ নট থৃ রাইফেল বিপদজন ভঙ্গিতে ধরে আছে। এস.আই সাহেব কানে মোবাইল ফোন নিয়ে হাসিমুখে কারো সাথে কথা বলছেন আর তাদের মটরসাইকেলটাই আসলে গোটা রাস্তার এক পাশ আটকে ট্রাকটাকে থমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না। ব্যাপার একটু পরে বোঝা গেল। পুলিশেরা ট্রাকের থেকে চাঁদা তুলছে। এবং সেই কারণে তারা গোটা গলিটা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। নেসারুদ্দিন হঠাৎ রেগে গেলেন, কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বল্ল,
' স্যার দেহেন আইনের লুক হয়া কি করতাছে- আপ্নেগো সামনে, আম্নেরা কিছু কন না কেন? আমগো দ্যাশে হইলে ধইরা পিডাইতাম। আমরা পুলিশ পিডাই। হেদিনো পিডাইছি।
নেসারুদ্দিন ভাবলেন তার দেশ কোথায় তা জিজ্ঞেস করবেন কিন্তু তার আগে সামনের ঝামেলাটা নিয়ে কিছু করা দরকার। কিন্তু কি করবেন? পুলিশ পিটানো এই শহরে সম্ভব না। তিনি মনে মনে ভাবলেন যে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। যথাসম্ভব শুদ্ধভাবে বলছেন- 
'আপনারা আইনের লোক হয়ে কী করছেন এসব? ছাড়ুন আমাদের যেতে দিন'  
কিন্তু ভরসা পাচ্ছেন না। এদের দেখে মনে হচ্ছে না তারা শুদ্ধ ভাষার কেয়ার করবে। তার বদলে নেসার সাহেবকে অপমান করে কিছু বলার সম্ভাবনা আছে। তাহলে কি করবেন? এখান থেকে বাঁজখাই গলায় চেঁচাবেন? যে, এই যে ভাই এই যে পুলিশ ব্রাদার! কি হচ্ছে এখানে? ব্রাইবারি? জনসমক্ষে? পেয়েছেন কি আপনারা? তখন হয়ত পেছনের থেকেও কেউ কেউ সমর্থন দেবে। তিনি পেছনে তাকালেন- না কারো এদিকে কোন মন নেই। ঠিক পেছনে এক ভদ্রলোক তার ছোট মেয়েকে স্কুলে দিতে যাচ্ছেন। তাঁর এই ঘটনা খেয়াল করার কোন কারণ নেই। তিনি মেয়ের সাথে কিছু একটা মজার কথা বলছেন। মেয়েটা হাসছে। তার পেছনে এক তরুন চোখে প্রমান সাইজের কালো চশমা আর কানে ইয়ার ফোন গুঁজে ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। এর পঞ্চ ইন্দৃয়ের মধ্যে দুইটা আগে থেকেই বন্ধ। নেসারুদ্দিনের অসহায় লাগলো। কেউ কি কিছু বলবে না? তিনি নিজে বলবেন? তার সেই সাহস আছে- অন্তত তিনি বিশ্বাস করতে চাইছেন যে সেই সাহস তার আছে। কিন্তু তার পরবর্তীতে কী হবে সেটা কল্পনায় ভাবেতে গেলেই বুক ধুকপুক টের পাচ্ছেন। আর কিছু বলতে গেলে তার জের ধরে অন্তত ঘন্টাখানেকের একটা ঝামেলায় পড়তে হবে তার হাতে সময় নেই। ট্রাকওয়ালারা কী করছে? টাকাটা দিয়ে দিলেই তো হয়। এবার তার ট্রাকওয়ালার ওপর মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করলো। পুলিশ অফিসারকে এখনো দেখা গেল কানে ফোন নিয়ে হাসিমুখে কথা বলছে কারো সাথে। যেন সেও ব্যাপারটা দেখছে না। মুল ভূমিকা পালন করছে সেপাইরা। তারা কোড ল্যাঙ্গুয়েজে চোখ পাকিয়ে ট্রাকওয়ালাকে কিচু বলেই যাচ্ছে। ট্রাকওয়ালা বারবার পেছনের দিকে ইঙ্গিত করছে। হয়ত অন্য কেউ টাকা টা নিয়ে আসবে। নেসারউদ্দিন রাগে ক্ষোভে ফূঁসতে লাগলেন। পাশের টং দোকানে যে ভদ্রলোক চা খেতে খেতে পেপার পড়ছিলেন তিনি এদিকে একবার তাকিয়ে আবার পেপারে মুখ লুকালেন- স্বগতক্তির ঢংয়ে বললেন- 
হায়রে দেশ।
 ভাবখানা এই তিনি পেপার পড়ে এই মন্তব্য করেছেন।
উফ কেউ কি নেই এদের কিছু বলে?
ঐ মিয়া!

নেসার সাহেব চমকে তাকালেন, তার রিক্সাওয়ালা!

ঐ পুলিশ ভাইয়েরা, ব্যপারটা কি অইলো? সাইড দিবেন না নিহি? 

- নেসার সাহেব মনে মনে প্রমাদ গুণলেন। তিনি মুখে এমন একটা ভাব ফটানোর চেষ্টা করলেন যে রিক্সাওয়ালার বক্তব্যটা একন্তই তার ব্যক্তিগত

কহন থিক্কা সাইড মাইরা খাড়ায়ে আছেন। পিছে জ্যাম লাইগা গেছে। সাইডে গিয়া কথা কন। 

নেসার সাহেব নিশ্চিত ছিলেন এবারে পুলিশের থেকে কেউ নেমে এসে তার রিক্সাওয়ালাকে মার লাগাবে বা ধরে নিয়ে যাবে বা... কিছু একটা করবে। কিন্তু পুলিশের দলে এখনো তাপ উত্তাপ নেই। শুধু এক সিপাই গলা উঁচিয়ে বলল

'কি'ছে?'

কি'সে মানে ? আম্নেরা কাম থাকলে এক সাইডে খারান পুরা রাস্তা আটাকায়া দিছেন জ্যাম লাইগা গেছে দেহেন না?

পুলিশেরা বোধহয় একটা ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেল। এস আই তার অন্তহীন ফোনালাপ থামিয়ে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকালো। কিছুই না বলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। নেসার সাহেবের রিক্সাওয়ালাও এক দৃষ্টে এস.আইয়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে । চারিদিকে নিঃশব্দ উত্তেজনা। পুলিশ এবার কী করে দেখার জন্যে সবাই তাকিয়ে, টং দোকানের পত্রিকাওয়ালা পেপারে মুখ ঢেকে চশমার ওপর দিয়ে সটান এদিকে তাকিয়ে। মেয়ের বাবা আড়চোখে দেখার চেষ্টা করছে। তরুন সেই একই রকম। 

ওই ট্রাক সাইড কর! এস.আই নীরবতা ভাঙ্গলেন। 

এবং রিক্সাওয়ালার থেকে চোখ সরালেন।

ট্রাক সাইড কর  ব্যাটা জ্যাম লাগায়ে দিসোস। কাগজ নিয়ে নাম, আর এদিক সাইড কর। 

ট্রাক সাইড করা হল, মটরসাইকেল নিয়ে তিন পুলিশ সাইড হল। নেসার সাহেবের রিক্সাওয়ালা স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বের হয়ে গেল। নেসার সাহেব চুপ করে বসে থাকলেন নিরাপদ দুরত্বে এসে পিছনের রিক্সাগুলিতে বিভিন্ন আলোচনা শোনা গেল। দূর্নীতি, গুড গভর্নেন্স, ইত্যাদি কি কি শব্দও দু' চারটা কানে এল তার। কিন্তু থম মেরে থাকলেন নেসার সাহেব। পুলিশকে তিনি কেন কিছু বললেন না সেটা ভেবে মেজাজ খারা লাগল। তার যে সাহস নেই তা তো না। তাহলে?

আম্নেরা ডরাইল্লা।

নেসার সাহেবের রিক্সাওয়ালা বল্ল।

পুরা ডরাইল্লা, আমগো গেরামে অইলে এতক্ষনে হালাগো মাথা ফাডায় দিতাম।  

রাশিয়ান সৈনিট টাইপ ফিগারে দৃঢ় চোয়ালের রিক্সাওয়ালা তার দিকে ঘুরে বলে। নেসার সাহেব একবার ভাবেন জিজ্ঞেস করেন যে তাদের গ্রাম কোথায়। পরে ভাবলেন থাক কী হবে জেনে?
১১.০৯.১২

2 comments:

  1. যে ভদ্রলোক চা খেতে খেতে পেয়াপার পড়ছিলেন , পেয়াপার thik korey niben please, Chomotkar choto golpo, Aro post pabo asha kori .

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ঠিক করা হচ্ছে (ব্লগের টাইটেল এ ক্লিক করলে আরো গল্প পাবেন)

      Delete