ভদ্রলোকের চাউনিটা অদ্ভূত ধরনের, অনেকটা যেন কেউ তাঁর নিজের লেখা নাটকের
নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন-এমন। কালচে বাদামী গায়ের রঙ, গলায় একটা লালচে ধরনের মাফলার
প্যাঁচানো, ফুল হাতা সাদা শার্টের হাতা গোটানো, তার ওপর কোটি ধরনের একটা গরম উলের স্যুয়েটার।
অনবরত পান চিবুচ্ছেন। নাটকের মেকাপের মতই জায়গামত ঠিক নাকের পাশে একটা ছোট্ট
আঁচিল। মুখে অমায়িক একান ওকান হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি পান্থপথের পার্কটার
পাশে একটা ছোট রেইনটৃ গাছের নিচ থেকে।
‘আপনেই হাদী
শাব?’
‘জ্বী’
‘সাত্তার ভাই
বলছে আপনার কথা, কাগজ আনছেন?’
একবারে কাজের কথায় চলে এলেন ভদ্রলোক, আদতে একজন সিটি
কর্পোরেশেন এর দালাল। যে কোন কাগজ চাই? চারিত্রিক সনদ? জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু সনদ,
বাড়ী ভাড়ার চুক্তি পত্র, কমিশনারের সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, টিন নাম্বারপত্র
সোজা কথা যে কোন ধরনের সিটি কর্পোরেশন সম্পর্কিত কাগজের বিষয়ে উনি মোটামুটি
ধ্বনন্তরি। সাত্তার ভাই আমার কলিগ, উনার কি একটা কাজ এই লোক করে দিয়েছিল, সেই
সূত্রে নাম্বার নিয়ে ফোন দিয়েছিলাম। নিজে চাকরীর পাশাপাশি একটা ছোট্ট ব্যবসা খোলা
যায় কি না সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এনার কাছে আসা। প্রতিষ্ঠানের নামটা খালি ঠিক
করেছি ‘থ্রি ডি বক্স হাউজ’ আসলে এখান থেকে কি করা হবে তা জানি না, এমনভাবে নাম
রাখা যাতে অনেক কিছুই করা যায়, প্রডাকশন হাউজ (ইদানীং এটার বাজার ভালো, হাবিজাবি
কিছু একটা নাম দিয়ে খুলে নিলেই বেশ কিছু কাজ করা যায়) প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি
(সিলেট থেকে বেশ কিছু দেশী প্রডাক্ট লন্ডনে যায় সেগুলির প্যাকেজিং ট্যাকেজিং এর
কিছু অর্ডার বাগাতে পারলে খারাপ হয় না, আমার স্ত্রী রেণুর বাড়ি সিলেট)। যাই হোক, যেটাই করি না কেন এই আবু তাহের নামের ভদ্রলোককে আমার
দরকার।
‘কাগজ এনেছি,
এই প্যাকেটে আছে, দেখেন সব ঠিকাছে নাকি’।
পকেট থেকে একটা পুরোনো তোবড়ানো রিমলেস চশমা বের করে চোখে সাঁটলো লোকটা,
এরপর ঝানু জহুরির মত আমার গোলাপি ফাইলটা
থেকে সব বের করে একে একে চোখের সামনে ধরে ধরে দেখা শুরু করল সে।
‘বুঝলেন হাদী
শাব? দেশটা অবস্থা খুউব খারাপ। চুরে ভইরা গেছে। সব জায়গাত কমিশন’।
কি উত্তর দিব বুঝতে পারলাম না, কারণ এই লোক নিজেই একজন দালাল, সরকারী কাজের
আমলাতন্ত্রের আতংকে সহজে কাজটা করাতেই তার কাছে আশা, এর সাথে এখন দেশ জাতি নিয়ে
কথা বলাটা কৌতুককর হয়ে যাবে। মুখে একটে হেঁহেঁ, তা যা বলেছেন ধরনের হাসি ঝুলিয়ে
দিলাম।
‘চুর, সব চুর,
এই যে আপনে এত ভালা মানুষ, আপনে যান না সিটি কর্পোরেশন, ছুইল্লা দিব বুজলেন?’
‘জ্বী জ্বী,
তা ঠিক, ইয়ে কাগজ সব টিক আছে?’
‘হ হ, একটা
ভাড়ার রশিদ লাগব বুজলেন? আছে?’
‘ভাড়ার রশিদ
তো নাই, আমি তো আসলে নিজের বাসার ঠিকানাই দিয়েছি’।
‘তাইলে বানায়ে
দিমুনি। আমার কাছে রিসিট আছে, আপনে খালি বাড়িওয়ালার মত কইরা একটা সাইন দিয়া দিয়েন,
ঠিকানা অর্জিনাল ?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ,
আমাদের নিজেদের বাসা’। বলেই মনে হল ভুল করলাম না তো,
আরো এক্সট্রা কিছু খসলো মনে হয়। বাড়িওয়ালা বলে ধরে নিলে বিল বাড়িয়ে দেবে না তো
ব্যাটা?
‘তাইলে সমস্যা
নাই, বুজলেন?’
বুজলেন বলাটা লোকটার মনে হয় বদভ্যাস, একেবারে সেই নব্বই দশকের বিটিভি নাটকে
দেখা টিপিক্যাল নাটকের চরিত্র। মনে হয় যেন সিটি কর্পোরেশনের দালাল চরিত্রে অভিনয়
করতে রীতিমত রিহার্সেল করে এসেছে। যাই হোক সেদিনের মত ফোন নাম্বার দিয়ে চলে এলাম।
ট্রেড লাইসেন্স টা হয়ে গেলে একটা ধাপ আগানো যায়।
যাবার সময় আবু তাহের জানালেন মাত্র তিনদিনের মধ্যে তিনি কাগজ দিয়ে দেবেন।
শুনে খুব একটা গা করলাম না। এই শ্রেনীর লোকজনের তিন দিন সাধারণত তিন মাসের আগে শেষ
হয় না। এডভান্স হিসেবে দেয়া পনেরশ টাকা পুরাই গচচা গেল কি না বরং সেটাই ভাবছি।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক তিন দিনের মাথায় আবু তাহেরের ফোন,
‘হাদী শাব,
কাজ তো শেষ’।
‘বলেন কি?
আপনি কই?’
‘আমি তো এই আপনার কাগজ হাতে নিয়া ফোন দিলাম, কাগজ নিবেন আজকা?’
‘আজকে? আজকে
তো টাকা সাথে নাই ভাই।‘
‘আরে কাগজ আগে
নেন, টাকা তো আর মাইরা দেবেন না, হ্যা হ্যা হ্যা’বলে খুবই
মজার একটা কথা বলে ফেলেছেন এভাবে হাসা শুরু করল লোকটা।
একেবারে সময়মত কাজ দিয়ে দিচ্ছে এটা দেখেই অবাক হয়েছিলাম, এদিকে আবার বলছে টাকা
পরে দিলেই হবে, অদ্ভুত ব্যাপার। যাই হোক অফিস থেকে বের হয়ে সেই পান্থপথের মোড়ে গেলাম, সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে সেই একই গাছের নিচ
থেকে বের হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন আবু তাহের। হাতে একটা ট্রান্সপারেন্ট ফাইল।
‘হাদী শাব, এই
যে আপনার কাগজ, বিরাটা গ্যাঞ্জাইম্যা কাজ বুজলেন, সবগুলা চুর। আপনার কম্পানীর ইংরেজী
নাম দেইখাই বুজছে মালদার পার্টি, আরো ট্যাকা চায়, আমি কইলাম অত বড় পার্টি না, তাও
কি ছাড়ে? কয় কাগজ নাকি ভুয়া, কন তো কি অবস্থা? সব চামার, দালালি খায়া খায়া পেটকা
মশার মতন হয়া গেছে তাও থামে না’।
‘ও আচ্ছা
আচ্ছা’।
‘আমিও ঘাউড়া রাঘা
মাছ, কাজ বাইর কইরা ছাড়ছি বুজলেন?’
‘তাই ত দেখছি’
‘দেখেন কাগজ
ঠিক আছে নাকি।‘
ফাইল খুলে দেখলাম সব ঠিকই আছে। সবুজ একটা ফোল্ডার ধরনের লাইসেন্স বুক,
সেটাতে সরকারী ছিল ছাপ্পর মারা। এখন কি করব বুঝতে পারছি না।
‘আচ্ছা টাকাটা
তাহলে কালকেই...’
‘আরে দিয়েন
দিয়েন, টাকা পরে নেওয়া যাইব। আজকা আসেন আমার বাসায় আসেন, এই সামনেই ফৃ স্কুল স্টৃট
এর গলিতে, চা খায়া যান?’
‘না না
ধন্যবাদ আজ না ভাই, আপনি কাজটা করে দিয়েছেন – অনেক
ধন্যবাদ ভাই’
‘আরে আসেন
এইখানেই বাসা...’
অনেক কষ্টে তার অযাচিত আপ্যায়নটা এড়াতে পারলাম, দালাল মানুষ আবার কই ধরে
নিয়ে কি হয় কে জানে, বলতে কি বেশ অস্বস্তি-ই লাগছিলো এমন সহজে কাজ হয়ে যাবে আর
লোকটা যেন একটু বেশী-ই খাতির করছে।
‘চুরে ভইরা গেছে দেশটা বুজলেন? আইচ্ছা আবার দেখা হইব হাদী শাব’ শেষে এই কথা
বলে কাঠালবাগান ঢালের দিকে চলে গেল আজব লোকটা। আমি অবশ্য পরদিনই তার বাসার ঠিকানায়
আমাদের অফিসের পিওনকে দিয়ে তার পাওনা টাকাটা পাঠিয়ে দিলাম, টাকা পেয়ে আবার তার
ফোন, বিরাট অনুযোগের সুরে বল্লেন কেন আমি নিজে এসে চা খেয়ে গেলাম না, উনি এতে অনেক
রাগ করেছেন, টাকাটা ওনার নাকি নেবার ইচ্ছেই চলে গেছে। কথাবার্তার শেষে আমার ইনকাম
ট্যাক্স নিয়ে যে কোন ঝামেলায় যেন তাঁকে জাস্ট একটা ফোন দেই এই বলে আবার বিদায়
নিলেন, সে সাথে দেশের ‘চুর’ দের থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ ফৃ দিলেন। শেষ দিন
পর্যন্তও লোকটাকে আমার কাছে কোন নাটকের চরিত্র বলে মনে হল, যে তার চরিত্র ফোটাতে
মাঝে মাঝে অতি অভিনয় করে ফেলছে। যাই হোক থ্রি ডি বক্স হাউজ যথারীতি আমার আরো অসংখ্য
প্রজেক্ট এর মত পড়ে রইলো। রেণুর কাছে
আমার এই প্রজেক্টগুলি এখন কৌতুকের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মজা আরো বারে যখন এই নামে
তখন অতি উৎসাহে একটা ওয়েবসাইট এর ডোমেইন কিনে ফেলেছিলাম, সেটার কোন কিছুই হয়নি
কিন্তু বছর বছর যখন সেটার আর টাকা দিতে হয় তখন, রেণু আমাকে তা নিয়ে কী বলে তা এখানে
বলা যাচ্ছে না-তবে তার সেন্স অফ হিউমার ভালো। সেই লাল মাফলেরের আবু তাহেরকে প্রায়
ভুলেই গেছি।
হঠাৎ একদিন প্রায় বছরখানেক পর আমার ছোট খালুর ফোন, পুরান ঢাকায় তাঁর কী সব
কাগজের কার্টন ফ্যাক্টরি। তার নাকি খুব দ্রুত একটা ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে- এই
খালু যথেষ্ট ঘোড়েল লোক, তিনি নিজেই জানেন বাংলাদেশে কিভাবে কাজ করতে হয়। তিনি আমার
কাছে কেন এই কথা বললেন ভেবে অবাক হলাম। রেণূকে বলতেই সে তার স্বভাবসুলভ এমন একটা
কথা বল্ল যে মনে হল এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। যাই হোক। সাথে সাথে আবু তাহেরের
কথা মনে পড়লো। ফনের কন্ট্যাক্ট এ খুঁজে তার নাম্বারটা পেয়েও গেলাম। এই নাম্বার
এখনো তার থাকলে হয়। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর কমবয়সী একটা ছেলে ধরল বলে মনে হল
'হ্যালো, কে'?
'হ্যালো স্লামালাইকুম, আবু তাহের সাহেব আছেন?'
'হ্যাঁ কে'?
'আমার নাম শামসুল হাদী, উনি আমাকে একবার একটা ট্রেড লাইসেন্স করে দিয়েছিলেন,
সেই ব্যাপারে একটু কথা ছিল'
'আব্বা? আব্বার তো ইশটোক হইছে'
'কি?!'
'ইশটোক করছে'
'বলেন কি, কবে?'
'এইতো ছয় মাস, প্যারালাইজড হয়া গেছে'।
'সে কি? এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বল্ল?'
'ডাক্তার বলছে রেস্ট নিতে।'
'ও..., তাহলে, মানে উনি ঠিক হবেন না ?'
বলেই বুঝলাম বোকার মত কথা বলছি। এটা কোন
প্রশ্ন হয়নি, আর ভদ্রলোকের রীতিমত একটা স্ট্রোক হয়ে সে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে সেটা
ছাপিয়ে আমার মন পড়ে আছে লাইসেন্সটা তাহলে কিভাবে করা যায় সেটা নিয়ে। বেশ অপরাধবোধ
হতে থাকলো। সেটা কাটানোর জন্যেই কি না জানি না বলে বসলাম,
'‘আপনাদের বাসাটা কোথায়? উনাকে দেখতে আসতাম’।'
ভদ্রলোকের ছেলে তাদের বাসার ঠিকানা বল্ল, শুনেই মনে হল এই ঠিকানা আমার
ট্রেড লাইসেন্স এই দেয়া আছে। সময় করে
একবার দেখতে যেতে হবে। আর দেখতে গেলে অবস্থা বুঝে কিছু সাহায্যমূলক দান ধরিয়ে দেয়া
যেতে পারে। অপরাধবোধ অনেকটা কমে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো।
পরদিনই অফিস থেকে বের হয়ে সোজা
কারওয়ানবাজার পার হয়ে ফৃ স্কুল স্টৃটের গলিতে পৌঁছে গেলাম, খুঁজে খুঁজে ৫৭/৪
বাসাটা বের করলাম। পুরোনো দোতলা বাসা, নীচুমতন রংচটা নীলচে একটা লোহার গেট, তার
ওপর ঝাঁপিয়ে নেমেছে একটা করমচা গাছ, গাছে পাতার অনেকটা আড়ালে পড়ে গেছে কলিং বেলের
সুইচ। বেশ কিছুক্ষণ চাপার পর বোঝা গেল সেটা নষ্ট, কারণ দূরে জানালার ফাঁক দিয়ে
একটা বছর পনের’র বাচচা ছেলে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল।
‘কারে চান?’
‘আবু তাহের
সাহেবের বাসা না এটা?’
‘ও আপনেই ফুন
দিসিলেন?’
‘ও ফোনে
আপ...তোমার সাথে কথা হয়েছে?’
‘জ্বি আসেন, ভিত্রে
আসেন।‘
মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকতেই একটা বাচচা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো, কোণায়
করমচা গাছের গোড়ায় সেটা একটা পাটের রশি দিয়ে বাধা,
‘লায়ন স্টপ!’ বলে ছেলেটা
ধমক দিতেই সেটা কুঁই কুঁই ধরনের আওয়াজ তুলে থামলো। বোঝা গেল লায়ন সাহেবের মালিক এই
বাচচা ছেলেটাই।
‘কি নাম
তোমার?’
‘সাদিক হোসেন’
‘ডাক নাম কি?
সাদিক?’
‘জি না, শুভ'
‘স্কুলে পড়?’
‘হুম, এই যে
এইদিকে আসেন, আব্বা এইদিকে-' বলে সে একটা খোলা বারান্দামত জায়গা পার হয়ে অন্ধকার
ধরনের একটা রুমের দিকে নিয়ে গেল আমাকে। এ সময় বারান্দার কোণা থেকে উৎসুক একজন
তরুনী বা মহিলা বয়সী কারো মাথা যেন সাঁট করে সরে গেল বলে মনে হল। দিনের বেলাও ঘরটা
অন্ধকার, হঠাৎ ঢুকে বুঝতে পারলাম না কোনদিকে যেতে হবে।
‘কে হাদী শাব?’ সেই গলা,
কিন্তু কেমন বিকৃত লাগলো।
‘জ্বী তাহের
ভাই’
‘শুভ, লাইটটা
দাও তো আব্বু।'
শুভ বাধ্য ছেলের মত অন্ধকারেই মুখস্থ কোন জায়গায় হাত চালিয়ে খুট করে লাইট
জ্বালালো। ঘরের মধ্যে একটা প্রমাণ সাইজের খাটে কাঁথা মুড়ি দেয়া মানুষ শুয়ে আছে।
কাঁথার ফাঁক দিয়ে শুধু তার মুখ দেখা
যাচ্ছে। চেনা মুখ, কিন্তু ভদ্রলোকের ডান দিকের ঠোঁট আর চিবুক নীচের দিকে কেমন ঝুলে
গেছে। এমনই কিছু আশা করেছিলাম যদিও তারপরেও কেমন অদ্ভূত লাগলো।
‘হাদী শাব
বসেন, দেখতে আসছেন খুশী হইছি অনেক। আমি তো জইব হয়া বয়া আছি। কথা কইতেও কষ্ট হয়।‘
‘কথা বলবেন
না, দরকার নাই।‘
'কোন সমস্যা নাই, শুভ, আব্বু ওনারে কিছু খাইতে দাও, তোমার মায়েরে বল। সে করে
কি? দেখে নাই মেহমান আসছে? এখনও খবর নাই?'
'তাহের ভাই ব্যস্ত হবেন না, আপনার কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলছে?'
'আরে ডাক্তার আর কি কইব? চুর শালারা, চুরের চেয়েও খারাপ বুজলেন? ট্যাকা ছাড়া
কুন কতা নাই। ইস্ট্রোক করসি বাদে গ্রিন রোড হাসপাতালে নিসিলো, তারা ফিরায়া দিল,
ভাবেন একবার, আমার ঐ পিচচি পোলাডা ও সিএনজিতে কইরা আমারে টাইনা নিছে, ও কি বুজে?
এরপর আরেকটা হাসপাতালে গেলাম তারা ইমার্জেন্সিতে ফালায়া রাখলো আড়াই ঘন্টা, আমার তো
নাই সেন্স। তারা প্রথমদিনের কেবিন ভাড়া ছাড়া আমারে ভর্তি-ই করাইবো না। দেখেন তো,
মানুষ মইরা যায় যাক, তাগো ট্যাকা আগে দিতে হইব। চুরের বাচচা চুর। পরে আমার ইস্ত্রি
ট্যাকা নিয়া গেল বাদে ভর্তি হইলাম, বুজলেন?'
'আসলে কি করবেন, বাজে অবস্থা হাসপাতালগুলির...।'
'চামার চামার! পইড়া লিইখা চামার হইতেসে। যত পড়ালেখা তত শয়তানি। তত মাইনষের
কিরিনচি বুদ্ধি। যাকগা বাদ দেন। আপনি দেখতে আসছেন আমারে, কি যে খুশী হইছি হাদী
শাব- বুজলেন?'
এমন সময় শুভ একটা পুরোনো
প্লাস্টিকের ট্রে তে এক গ্লাস শরবত আর পিরিচে দুটো কলা নিয়ে ঢুকলো।
‘দেখ, কি
দিছে, বুদ্ধি আসে নি মাথায় কোন, ওই ঘরে না চানাচুর আছে? সেইটা দেয় নাই যে? শরবতের
সাথে কলা কেউ দেয়?’ বোঝাই যাচ্ছে ছাপোষা তাহের সাহেব বাসায় রীতিমতন ছোটখাট
হিটলার।
‘আহা বাদ দেন
তো, আমি এসেছি রোগী দেখতে, যাই হোক আপনাকে কদ্দিনের রেস্ট এ থাকতে বলেছে ডাক্তার?’
‘বলছে তো পুরা
ঠিক হব না, ডাইন দিকটা জইব হয়ে থাকব’ তাহের সাহেব উঠে বসে কাঁথা
সরালেন, তাঁর ডান হাতটা খুবই অদ্ভূতভাবে তাঁর কাঁধের সাথে ঝুলে আছে, যেন ওটা তাঁর
শরীরের কোন অংশ না। শরবতে চুমুক দিতে দিতে সেটা দেখে শরবত কেমন বিস্বাদ লাগলো।
তাহের সাহেব হঠাৎ সামনে ঝুঁকে ষড়যন্ত্রীর মত গলা নামিয়ে বললেন,
'হাদী শাব। কোন কাজ
টাজ আছে নাকি? খুবই বিপদে আছি বুজলেন?’
‘সে কী আপনি
কিভাবে কাজ করবেন?’
‘আরে সব তো
আমার হাতে, খালী ফুন দিমু আর কাজ কমপ্লিট। আছে নাকি কাজ? হাদী শাব, অসুখের পর থেকে
কি যে খারাপ অবস্থা, ছেলেটারে স্কুল থেকে ছাড়ায়া দিতে হইছে। ঘরে ঠিকমত বাজার করার
উপায় নাই। কি যে করব বুঝি না, আমার পার্টনার যে ছিল তার কাছে ষাইট হাজার টাকা
পাইতাম, আমার এই অবস্থায় একদিনও দেখতে আসে নাই, ফোন দিলে ধরে না।'
বলতে বলতে তাহের সাহেব হাঁউমাউ করে কেঁদে দিলেনন। মুখের একদিক বাঁকা থাকায়
ভদ্রলোককে বিচিত্র লাগলো। ভয়ানক অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে মনে তাঁকে সাহায্য করার কথা
ভেবে এসেছি তারপরেও এই দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে গেলাম। মনে হল না আসলেই ভাল ছিলো।
‘তাহের ভাই,
তাহের ভাই ঠিক হন, এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না।' বলে মনে হল কথাটা ফিল্মি হয়ে
যাচচ্ছে, তাও এই মুহূর্তে এটা ছাড়া আর কি-ই বা বলব?
‘ভাঙ্গি নাই
ভাই, ভাঙ্গি নাই, কিন্তু আমার পোলাটার কি হইব? ও স্কুলে না গেলে তো আমার বাইচা
থাকার মানে নাই। জমানো ট্যাকা ভাঙ্গায়া খাইতেসি, আমি কি করব বুঝি না, আল্লা এমন বিপদে
ফেল্ল আমারে।‘
'ইয়ে তাহের ভাই, একটা কাজ মনে হয় আছে’।'
ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে উঠলো হঠাৎ। আমি খালুর সেই কাজটার অফার তাকে
জানালাম।
‘ধইরা রাখেন
হয়া গেছে, কাগজপাতি রেডি করেন, আমি আপনারে ফোন দিয়া যেখানে বলব সেগুলি পাঠায়া
দিবেন। আপনে যে কি উপকার করলন ভাই’।
‘আমি আসলে
কাজটার জন্যে আসি নাই, আপনার খারাপ অবস্থা জেনে দেখতে এসেছি’। অনেকটা
কৈফিয়তের সুরে বললাম।
‘সেইটা আমি
জানি ভাইসাব, আমি মানুষ চিনি। আপনে ভালা মানুষ না হইলে আপনারে এত পাত্তা দিতাম না।
এই আবু তাহের মানুষ চিনে বুঝলেন?’
ভদ্রলোকের থেকে বিদায় নিতে ভদ্রতাবশত সেই বিস্বাদ শরবত অনেক কষ্টে আধা গ্লাস খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর হাত মেলানোর ফাঁকে আমার আনা সাহায্যের পাঁচশো টাকা তার হাতে গুঁজে দিতে প্রথমে আপত্তি জানালেও
‘ভরসা রাখেন ভাইজান, ধরেন কাজ হয়া গেসে।
‘জ্বী জ্বী অবশ্যই’
‘চুরে দেশটা ভইরা গেসে বুজলেন?’
এ কথার কি জবাব দেব না বুঝে সে আগের মত বোকাটে একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে
এলাম। করমচা গাছের নীচে শুভ বসে লায়নের মাথায় হাত বুলাচ্ছে, লায়ন আমাকে দেখে চাপা
গরগর গোছের একটা শব্দ ছাড়লো। ছেলেটার পড়াশোনা আটকে গেছে, শুভ আমার দিকে তাকালো না।
কেন যেন মনে হল ইচ্ছে করেই না দেখার ভান করল। কাঁঠালবাগানের ঢাল বেয়ে নামার সময় ঠিক বেঠিক, নীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে আবু তাহের লোকটার বয়ান মাথায় ঢুকাতে গিয়েও ঢোকালাম না। আপাতত খালুর কাজটা হয়ে গেলেই হল। দেশ নিয়ে পরে ভাবা যাবে আবার।