Saturday, May 6, 2017

প্রিয়তির জন্যে একদিন

প্রিয়তি আজ আসবে।
প্রায় দশ দিন পর।
কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আরো বেশী। রাস্তা পার হতে হতে অয়নের বেশ ফুরফুরে লাগা শুরু হল। বাসা থেকে বের হবার সময় খেয়াল করে নি বাইরে আসলে বেশ ঠাণ্ডা শুধু একটা হাফ হাতা সোয়েটার পরে বের হয়ে এসেছে সে। প্রিয়তিকে আনতে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে যেতে হবে। রাস্তাটায় বেশ ঠাণ্ডা পড়বে-তা পড়ুক। যা ইচ্ছে তাই হোক। এদ্দিন পর সবচেয়ে প্রিয় মুখটা দেখা যাবে, যত ইচ্ছে ঠাণ্ডা লাগুক। রাস্তার ওপাড়ে বাসস্ট্যান্ডে বিরাট ভীড়। একদল লেবার শ্রেণীর লোক চেঁচামেচিতে নরক গুলজার করে তুলছে। পাশেই একটা ছোটখাটো পরিবার দাঁড়িয়ে। কর্তা দেখতে বেশ ঢ্যাঙ্গা, খাকি রঙ্গা একটা কোট পড়ে আছেন, বোঝাই যায় শীতকালীন কোটপ্যান্ট। বছরে একবার বের করা হয়। এ সময়টা মধ্যবিত্ত কেরানী টাইপ লোকজনদেরও ঘরের একমাত্র কোট প্যান্ট বের করে পড়ে শিড়দাঁড়া সোজা করে হাঁটতে দেখা যায়। ভদ্রলোক রাস্তার দিকে উৎসুক-চিন্তিত চোখে তাকিয়ে আছেন। সিএনজি খোঁজার চেষ্টা করছেন, পেছনে বোরকা পড়া এক মহিলা দুটো বাচচা মেয়েকে আগলে দাঁড়িয়ে। বলে দেবার দরকার নেই এরা ভদ্রলোকের স্ত্রী ও মেয়ে। বোরকার মধ্য থেকে ভদ্রমহিলার চিন্তাক্লিষ্ট চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। ঢাকার নরক রাস্তায় অসহায়ের মত তিনি তাঁর দুই মেয়েকে আঁকড়ে ধরে আছেন, যেন ওরাই তাকে এর থেকে বাঁচাবে। অয়ন অলস চোখে তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মোবাইলে তাকালো, আটটা বেজে সতেরো। আজকাল আর ঘড়িও পড়া হয় না, মোবাইলেই ঘড়ি দেখে সবাই। এমন কী অয়ন এ-ও খেয়াল করেছে দোকানপাটেও  আজকাল দেয়াল ঘড়ি প্রায় থাকেই না। ছোটবেলায়  বিকেল পাঁচটায় স্কুল ছুটির পরে বাসায় আসবার পথে বিভিন্ন দোকানের পেছনের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ি দেখতে দেখতে আসাটা তার একটা শখ ছিল। আজো হঠাৎ মনে হলে সেভাবেই দোকানে তাকায় সে। তাদের বাসার গলির খুব কম দোকানেই ঘড়ির দেখা পাওয়া যায় এখন। বাসের খোঁজে রাস্তার ডানদিকে তাকালো অয়ন। না, দেখা নেই। শুধু একটা লং রুটের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। বেশ বড়। তবে তেমন একটা হাই ক্লাস না। ছাদে বাঁশের খাঁচা টাচা দেখা যাচ্ছে। স্টপেজের কাছে আসতেই গেট থেকে শুকনা শাকনা একটা ছেলে গলা বড়িয়ে ডাকা শুরু করলো গাইবান্ধা গাইবান্ধা! এই ভাবে যে লোকাল বাসের মত করে গাইবান্ধায় লোক ডাকা হয় জানা ছিলো না অয়নের। এবং তার পরের অংশটা আরো অবাক করার মত। ঠিকই কোত্থেকে এক দঙ্গল (ওই বাসের সাথে 'যায়' এমন) মানুষ আশে পাশের ফুটপাত থেকে গজিয়ে উঠে লাফিয়ে উঠতে শুরু করলো বাসে। তার ঠিক পাশেই এতগুলি গাইবান্ধাগামী যাত্রী বসে ছিলো বোঝাই যায় নি। সেই দিনমজুর গ্রুপটাকে দেখা গেল বিভ্রান্ত হয়ে বাসটার দিকে তাকাচ্ছে। দলপতি গোছের লোকটা এগিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো শুকনা শাকনা ছেলেটা হাত নেড়ে তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গী করলো। এরা কোথায় যাবে বোঝা গেলো না। অয়ন এবারে নড়েচড়ে উঠলো, হাল্কা বেগুনী ধরনের ফাল্গুন ৮ বলে একটা বাস দেখা যাচ্ছে। এটা উত্তরা যায়। যদিও সিট পাবার সম্ভাবনা নেই। সেই খিলক্ষেতে পাড় হলে পাঁচ ছয় মিনিটের জন্যে হয়ত বা বসা যেতে পারে। যাই হোক ঘুরে কাউন্টারের দিকে তাকাতেই দেখে সেই বোরকা-স্যুট দম্পতি উৎকন্ঠিত মুখে টিকিট কিনতে দাঁড়িয়ে গেছে। কর্তার পকেট থেকে কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট বের হতে কাউন্টারের লোক ভাংতি নাই বলায় এই সুযোগে অয়ন এগিয়ে গেলো। স্যুট পড়া ভদ্রলোক অকারণেই তার স্ত্রীকে ধমকানো শুরু করলো কেন সে ভাংতি রাখে না ইত্যাদি বলে। আরো কিছু উত্তরা বা বিশ্বরোডগামী মানুষজন আসা শুরু করতে হঠাতই চেঁচামেচি বাড়তে থাকে। অয়নের ভয়ানক বিরক্তি লাগা শুরু হয়। আজ প্রিয়তি আসবে। আজ এমন না হলেই কি হত না? আশেপাশের এইসব চেঁচামেচি, একদল দিনমজুরের লাফিয়ে গাইবান্ধাগামী বাসে ওঠা। স্যুট পড়া লোকটার ভাংতি না থাকা সব কেমন বিসদৃশ লাগে তার। প্রিয়তি আর সে- এসবের মাঝে এইসব হতশ্রী মুখগুলি একেবারেই ভালো লাগছে না।
বাস চলে এসেছে। কোনমতে হাঁচড়ে পাচড়ে মানুষদের ভীড় ঠেলে সেদিকে এগোয় অয়ন। গেটে এক দঙ্গল মানুষ। কিন্তু বাইরে থেকে বেশ দেখা যাচ্ছিলো ভেতরটা ফাঁকা। ঠেলে ঠুলে দু' তিনজনের পা মাড়িয়ে অয়ন পেছনের দিকে এগোয়। সামনে একটা সিট খালি দেখা যাচ্ছিলো কিন্তু মহিলা সিট- আর কেউ বসে নি, এমন অবস্থায় সেখানে বসাটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু বলে ধরে নেয় অয়ন। আর একেবারে পেছনে পাঁচজনের সিটে দিব্যি চারজন পা ছড়িয়ে আয়েশীভাবে বসে এমন একটা ভাব ধরে আছে যেন এটা চারজনেরই সিট। এ ধরনের অবস্থায় এইসব সিটে বসলে ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না। চেহারায় প্রবল বিরক্তি নিয়ে কেউ হয়ত চেপে বসতে দেয় কিন্তু তারপর ইচ্ছা করে শরীর চাপ বাড়াতে থাকে। বোঝানোর চেষ্টা করে যে ব্যাটা তুই এসে সবার কষ্ট বাড়ালি। সিটটায় তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে অয়ন কোন লোকটাকে চাপতে বলা যায়। সবচে' ডানে বসে আছে এক বছর আঠারোর ইয়ো টাইপ তরুণ। মুখে ভঙ্গীতে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে আসলে বাসে চড়ার যাত্রী না। ঠ্যাকায় পড়ে চড়েছে। তার পাশে টাক মাথা লোক মুখ হাঁ করে ওপরের দিকে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার পাশে নিরীহ এক ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী (হাতে একটা ড্রিল মেশিন আর পকেটে টেস্টার দেখা যাচ্ছে) একেবারে বামে চাদর পড়া এক মুসুল্লী চাচা বাইরের দিকে মাথা বের করে বসে। অয়ন চাচা আর মিস্ত্রী ভাইয়ের মাঝে বসার সিদ্ধান্ত নিল। কিছু বলার আগেই মিস্ত্রী ভাই নিজের থেকেই সরে জায়গা করে দিল। মনে মনে বেশ খুশী হল অয়ন, কিন্তু বসেই মিস্ত্রী লোকটার গায়ের ঘামের গন্ধে গলা আটকে গেলো। কী যন্ত্রণা। প্রিয়তির কাছে যাবার জন্যে বের হবার আগে নতুন কেনা এক্স বডি স্প্রেটা মেরে এনেছে। এখন এই গন্ধের সাথে কোনভাবে মিশে গেলে। আজ সব কিছুই নোংরা হচ্ছে, বাজে হচ্ছে। মনটা বিগড়ে যাচ্ছে অয়নের।
-উত্তর বাড্ডা! 
কন্ডাকটর ডেকে ওঠে, আর ঠিক সেই সময় সামনের ডানদিকের কোনার লোকটা উঠে পড়ে। অস্বাভাবিক দ্রুততায় অয়ন ছিটকে সেই সিটে গিয়ে বসে - যাক বাবা। অন্তত ঘামের গন্ধ থেকে রক্ষা। ডানে তাকিয়ে দেখে সহযাত্রী এক তরুণী। কানে ইয়ারফোন গুঁজে হাতের দামী মোবাইলে গুঁতোগুঁতি চালাচ্ছে, পাশে যে অয়নের মত একটা মোটামুটি চলেবল ছেলে এসে বসেছে সেদিকে খেয়ালই নেই। অয়ন একটু শক্ত হয়ে গেলো। আরেকটু বাম দিকে সরে বসলো। মেয়েটা যেন কখনই না ভাবে সে ইচ্ছা করে তাকে দেখেই এসে বসেছে। আর কোন সিট ফাঁকা হলেই সেখানে উঠে যেতে হবে। মেয়েটার দিকে আবার তাকায় অয়ন, মেয়েটা অবশ্য দেখতে খারাপ না- 
-টিকিটটা দ্যান! 
কন্ডাকটার, ব্যাটার টাইমিং। না, এমনিতেও মেয়েটার দিকে তাকানো ঠিক হচ্ছে না। সে আজ প্রিয়তিকে দেখতে যাচ্ছে। যত্তসব। বাইরে তাকায় অয়ন। নতুন বাজার, এমেরিকান এম্বাসি চলে এসেছে। মোবাইল কেঁপে উঠলো হঠাৎ, প্রিয়তি- ওর এস এম এস। 
chle esci prae, sthe jhamela.
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। মানে সাথে তার ওর অফিসের কোন কলিগ আসছে। প্রিয়তি একবার বলেছিল এমন কিছু হতে পারে। যত্তসব।
OK, amio almost near. রিপ্লাই দেয় সে।
অন্য রোমান্টিক কিছু লেখার সাহস হচ্ছে না। পাশে ওই মেয়ে, আর ওদিকে প্রিয়তিও নির্দোষ এস এম এস করেছে, মানে তার পাশেও সম্ভবত কেউ আছে। যাই হোক। তাও তো, আজ ওকে দেখতে পাবে অয়ন। আবার মন ভালো হওয়া শুরু করল। হঠাত গাড়ির সামনের দিকে হাউকাউ শোনা গেল এমন সময়। উঠে সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না অয়নের। মরুকগে। সে প্রিয়তির মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। কি অদ্ভূত, মাত্র দশদিন না দেখে প্রিয়তির মুখ সে ভুলে গেছে? চোখ বুজে মনে করতে চেষ্টা করতে থাকে সে। নাঃ কিছুতেই মনে পড়ছে না। মোবাইল থেকে বের করে দেখাটাও ঠিক হবে না, পাবলিক বাস। কেমন হল ব্যাপারটা? প্রিয়তির চেহারা মনে নেই কেন? ভ্রু কূঁচকে সামনের দিকে তাকায় অয়ন। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। কোন একটা লোকালের ড্রাইভারের সাথে মুখ খিস্তি শেষ করে আবার বাস ছেড়েছে ড্রাইভার। রিয়ার ভিউ মিরর এ ড্রাইভারের নির্লিপ্ত মুখটা দেখা যাচ্ছে। আবার পাশে তাকায় অয়ন, মেয়েটা। চোখ বুজে গান (সম্ভবত) শুনছে। এর চেহারা কি প্রিয়তির মত? এমন চিবুক, নাকের পাটা, আই ল্যাশ- না, আবার এর দিকে সে তাকিয়ে আছে। কি বিশ্রী অবস্থা। তবে মেয়েটা কিছুটা হয়ত প্রিয়তির মতই। কারণ প্রিয়তির চেহারা মনে পড়েছে অয়নের।
খিলক্ষেত। সামনের কিছু সিট খালি হয়েছে, এগিয়ে বসবে? থাক, আর পাঁচ ছয় মিনিট লাগবে। বেশী আগে চলে এসেছে। সাড়ে নয়টা এখনো বাজে নি। যাকগে। কিছুক্ষণ না হয় বসে থাকবে এয়ার পোর্টে। খিলক্ষেত পার হয়ে বাস প্রায় ৭০ কিলো বেগে টান দিয়েছে। এই রাস্তাটা বাসগুলি অনেক দ্রুত যায়। এখানে কোন স্টপেজ নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বোজে অয়ন।
-এক্সকিউজ মি।
মেয়েকন্ঠ, তার পাশের মেয়ে, চোখ খুলে দেখে মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছে,
-'শিওর শিওর।'
বলে তাকে বের হবার জন্যে পা সরিয়ে আড়াআড়ি করল অয়ন। মেয়েটা কই নামবে? সামনে এয়ার পোর্ট। ও না চলেই এসেছে প্রায়। তার ও নামতে হবে, মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখতে আরো দারুণ লাগছে, লালাভ চুল, শরীরের গড়ন- যত্তসব। আজ প্রিয়তি আসবে, আর- যত্তসব। সটান আবার সিটে বসে পড়ল অয়ন। এবার কৌতুহলে গলা উঁচিয়ে দেখল মেয়েটা কী করে, মেয়েটা গিয়ে সামনে সিটে বসলো! মানে কি? এটা রীতিমত অপমান। মানে তার সাথে বসে কি সমস্যা হচ্ছিলো? এটা বরং সে নিজে করবে ভেবেছিলো, আরেক সিটে যেয়ে বসা। রাগে গা জ্বলা শুরু করলো।
-ইয়ারপোট। কন্ডাকটর হাঁকলো এবার।
মাথা গরম করে নেমে গেল অয়ন।
ভীড়া ভীড়াক্কার। আজ সবই উল্টোপাল্টা হচ্ছে। নীচ দিয়ে রাস্তা পাড় হবার জন্যে দাঁড়াতেই এক ট্রাফিক পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে মুখের বাঁশি ফুঁকে কী জানি ইঙ্গিত করলো। একটু পরে বোঝা গেল, নীচ দিয়ে পার হওয়া যাবে না। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে যেতে হবে। কি যন্ত্রণা! হঠাত দুইদিন পর পর বাতিক ওঠে এদের। অয়ন যাবে রাস্তার ওই পারে আর ফুটওভার ব্রিজ হল সেই প্রায় একশো গজ দূরে। কিচ্ছু করার নেই, একাধিক পুলিশকে দেখা গেল নিচ দিয়ে পার হতে চাওয়াদের বাঁশি বাজিয়ে নিরস্ত্র করতে। ঝামেলার দরকার নেই। অয়ন মানুষের নদীর স্রোতের মত লাইনটায় আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো। যতই চেষ্টা করছে আজ মেজাজ গরম করবে না, ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। চোখ বুজে প্রিয়তির মুখটা ভাবার চেষ্টা করতে লাগলো। সেটা করতে গিয়ে এক বুড়োর পা মারিয়ে দিল, বুড়ো ভাললোক তাই কিছু বললো না।

এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামতেই ধক করে নাকে একটা গন্ধ লাগলো কোথাও কিছু একটা পোড়ানো হচ্ছে, কী পুড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। আর আজ কোন একটা ট্রেইন লেট। যা-তা অবস্থা। প্যাঁচপ্যাঁচে ভীড়। সামনেই এক দঙ্গল লেবার দাঁড়িয়ে- সেকি এটা ত সেই লেবার দলটাই। এরা তাহলে ট্রেনে করে যাচ্ছে? যাক মরুক গিয়ে। ডান বামে তাকাচ্ছে অয়ন, একটু ফাঁকা কোথাও পাওয়া যায় কি না, নেই প্রতিটা পিলারের গোড়ার বেঞ্চে ঠাসাঠাসি কর লোক বসা।
বাবা কিছু দ্যান।
গায়ে হাত দিয়ে টানছে এক মহিলা ভিখিরি, ভিখিরির এক পা ফুলে হাতির পা, গোদ রোগ। এই ঘিনঘিনে প্রাণীটা গেয়ে হাত দিয়ে টানছে? হঠাত চিতকার করে ভিখিরিকে বকতে শুরু করল অয়ন,
'গায়ে হাত দাও ক্যান? ফাজিলের ফাজিল!!' রাগ বের হবার একটা সুযোগ পেয়েছে। ভিখিরিটা একটূ অবাক হয়ে অন্য দিকে তাকালো। ওদিকে আরেক বাচা মেয়ে বসে বসে আপনমনে খেলছে, চিতকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এসে সে ভিখিরির গলা জড়িয়ে ধরলো। এর বাচ্চা হবে হয়ত। মনে মনে একটু দমে গেল অয়ন, এভাবে চেঁচানো ঠিক হয়নি। সে আসলে এত খারাপ মানুষ না। ধুর।

আবার ঘড়ি দেখে অয়ন, পৌনে নয়টা। প্রায় এল বলে ট্রেন। টুট টুট শব্দে আবার এস এম এস
r 10 mnts
প্রিয়তি।
এদিক ওদিকে তাকিয়ে পরে উপরে যে আরেকটা স্টেশনের ফুট ওভার ব্রিজ আছে সেখানে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল অয়ন। উপরে কিছু সন্দেহজনক জটলা দেখা গেল। আবার ছিনতাইকারী না তো? নাহ, এই আলোতে ভ্রা মজলিসে এমন হবে না। জটলার একটায় দুই তরুণ আর এক তরুণী দাঁড়ানো তাদের পাশাপাশিউ থাকারই সিদ্ধান্ত নিল অয়ন। নিম্ন শ্রেণির সবাই। হয়ত একান্তে কথা বলার এটা একটা জায়গা তাদের। সবাই যে স্টেশনে ট্রেনের জন্যেই আসে তা তো না।

ওপর থেকে ট্রেন লাইন দেখতে বরাবরই দারুণ লাগে, কি অসম্ভব ঋজু কিছু লাইন, কিন্তু কি অনায়াসেই না আবার মনে হচ্ছে দূরে বেঁকে গেছে। ছোটোবেলায় মনে হত হাঁটতে থাকলে নিশ্চই একসময় যেখানে লাইনগুলি মিশে গেছে সেখানে যাওয়া যাবে।
গাঁজার গন্ধ! কেউ এখানে গাঁজা টানছে!, যত্তসব। আশাপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই, নীচে পায়ের কাছে আবার কি একটা নড়ে উঠলো। একটা মানুষ! চাদর টাদর মুড়ে ঠায় পড়ে ছিলো। অন্ধকারে দেখাই যায় নি। চাদরের দলার একদিকে হঠাত একটা ছোট্ট লাল আগুন বিন্দু দেখা গেল সেটা মুহূর্তেই আরো প্রকট ভাবে জ্বলে উঠলো, মানে গাঁজায় টান দিচ্ছে। যত্তসব, ভেবে ব্রিজের অন্যদিকে হাঁটা দিল অয়ন, নেমেই দাঁড়াবে সে।
নামতেই আবার সেই ধোঁইয়ার গন্ধটা পেল, এবার আরো তিব্র, এদিকেই কোঠাও কিছু পুড়ছে, খুঁজে পেতে দেখলো এক গাদা শুকনো পাতার জঞ্জাল জড়ো করে পোড়ানো হচ্ছে, শীতের ঝরা পাতা, রেলস্টেশনের টুকটাক নোপ্নগ্রা কাগজ পাতি। যেদিক থেকে টেরন আসার কথা সেদিকে তাকায় অয়ন। আবার ঘড়ি দেখে। এখনো আসছে না। ১২ মিনিট চলে গেল। আবার এস এম এস
'crossing'
গেল, আরো দেরি হবে। এদিকে আগত ট্রেনে করেই কমলাপুর গামী একদল সুযোগসন্ধানী লক দাঁড়িয়ে, বেশীরভাগই টিকিট কাটেনি। তার মধ্যে এক বুড়ো লোক চার খাচি দেশী মুরগী নিয়ে দাঁড়ানো, মুরগিগুলো নেতিয়ে আছে, শুধু একটা মোড়গ তারস্বরে বিপ্ল ঘোষোণা করে যাচ্ছে, বুড়া পাত্তা দিচ্ছে না। ট্রেনে সে এই সব নিয়ে অল্প সময়ে কিভাবে উথবে সেটা একটা দেখার মত বিষয় হবে। তবে নিশ্চই সে জানে কি করতে হয়। অসহ্য লাগছে, প্রিয়তি কখন আসবে? আশে পাশে চায়ের দোকানের খোঁজে তাকালো, হঠাত দেখে সেই গোদ রোগী! সে এই পাড়ে কিভাব আসলো? ও না এ আরেকজন। এদের কি টিম কাজ করে নাকি? নিশ্চই দেখা যাবে একদল বাজে লোক কিছু গোদ রোগী জোগড় করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় এসে রেখে যায়। আবার সময়মত তুলে নিয়ে যায়, বিরাট ব্যবসা। হঠাত করে অয়নের পুরো শহরের ওপর, তারপর দেশের ওপর মেজাজ বিগড়ানো শুরু করলো। এ দেশে... ট্রেনের শব্দ!
আসছে, হ্যাঁ এটাই প্রিয়তির ট্রেন। কোন বগিতে কে জানে। বিরাট আজদহা ট্রেন ধাতুতে ধাতুতে কর্কশ নিনাদ তুলে অনিচ্ছায় থামলো। আর সাথে সাথেই উঁই ঢিবি থেকে নামা পোকার মত পিল পিল করে মানুষ নামা শুরু করলো। এর মধ্যে কাউকে খুঁজে পাওয়া সমস্যা। এস এম এস আবার-
-sathe ratul sir. onno dike jao
কী যন্ত্রণা! এখন এদ্দুর  এসে লুকিয়ে থাকতে হবে, ওর সাথে কেউ আছে, তো তাতে কী হল? কয়দিন পরে বিয়ে তাদের। রাগে গজরাতে গজরাতে আবার ব্রিজের ওপরে ওঠে অয়ন। মোবাইল বের করে লেখে
-ami bridge e
হঠাত আবার গাঁজার গন্ধ! সেই গাঁজাখোর, এখনো টেনে যাচ্ছে, ব্রিজ ধরে এক গাদা মানুষ উঠে আসছে সেদিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। ওপর থেকে পিলপিলে মাথা গুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় অয়ন- এই দেশে আর না। বিয়ের পর প্রথম সুযোগেই ভাইয়ার কাছে চলে যেতে হবে, ভাইয়া টেক্সাসে থাকে, আগেও বেশ কয়েকবার বলেছিলো যেতে। এবারে মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছিলো। চিন্তিত মুখে প্রিয়তির খোঁজে আবার ভীড়ের দিকে তাকায় অয়ন।


Wednesday, May 3, 2017

আইপিএল

মোড়টা পেরিয়ে রাস্তাটা যেই একটু বাঁক নিয়েছে তার পাশের লাইটপোস্ট টাতে বাতি নেই আজ প্রায় মাস খানেক। কারো তা নিয়ে মাথা ব্যাথাও ণেই, ওইটুকু পথ পার হতে পকেট থেকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়েই কাজ চলে যায়, অফিস ফেরতা গৃহী মানুষ, গার্মেন্ট শ্রমিক খলখলে কিশোরী তরুণী বিনা আলোতেই দিব্যি মোড়টা পার হয়, নির্জন হলেও মোড়ের কোন বদনাম নেই। আজ সেই মোড়েই মোটামুটি আলো ঝলমলে অবস্থা। কোত্থেকে এক নাম নিশানা ছাড়া উটকো মানুষ সটান পড়ে আছে। থেকে থেকে দুই হাত পা দুইদিকে ছড়াচ্ছে আর গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।
আশেপাশের ভীড় থেকে মোবাইল ফোনের ডিজিটাল টর্চ জ্বালিয়ে সবাই তাকে দেখার চেষ্টা করছে।

-'মিরগি' বিজ্ঞের মত মন্তব্য ঝাড়ল এক মধ্যবয়স্ক।

-'জুতা হুঙ্গা, চামড়ার জুতা হুঙ্গা'- আরেকজন কে বলে উঠলো

উতসাহী বেশ কয়েকজন তাদের ময়লা কাদায় মাখা চামড়ার জুতো খুলে গোঙ্গাতে থাকা মানুষটার নাকের সামনে ধরলো। কেউ কেউ তার মানিব্যাগ নিয়ে সেটাও ধরে রাখলো লোকটার গ্যাঁজলা ওঠা নাকের সামনে। লোকটা একটু পরে পর ঘর ঘর করে শব্দ করছে। ভীড় ক্রমাগত বাড়ছেই।
এবারে আস্তে আস্তে বাড়ছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, ভিডিওও করছে মনে হয় কেউ কেউ। এমন সময় গলির কোণা দিয়ে ভীড় এড়িয়ে সুরুত করে পার হবার চেষ্টা করছিলেন পাশের জামে মসজিদ বায়তুস সুজুদ , বরকতপুর, নামাপাড়ার ঈমাম রশিদ হুজুর। হঠাত দুই মধ্যবয়সী তাকে ধরে ফেলল,

-'হুজুর, এই মানুষটা পইড়া আছে কোত্থেকে জানি। মসজিদ থেকে কিছু একটা করেন।'

-'মসজিদ থিকা কী করব? এইটা কি মসজিদের কাজ? কোইত্থেকে কী খায়া পইড়া আছে দেখেন
আগে, দেইখা মনে হয় মদ গাঞ্জা খাইসে- অস্তাগফিরুল্লা।'

-জ্বি না, এইডা মিরগি- বলল সেই আগের গম্ভীর দাড়িওয়ালা লোকটা।

পড়ে থাকা লোকটার চেহারা আসলেও ভদ্রস্থ না। মলিন একটা শার্ট- হয়ত সেটা একসময় সাদা ছিল। আর নীচের অংশ আরো ভয়ানক- লুঙ্গী! মানে নীচের শ্রেণির। এর দায়িত্ব কে নেবে?

-'দেখেন কোন মোবাইল টোবাইল, কাগজ কুগজ আছে কি না।' বল্লেন ঈমাম সাহেব।

-'না নাই'।
ভাল মত খুঁজে টুজে বলল দুই তরুণ-গার্মেন্ট কর্মী হবে হয়ত।

-'ঈমাম সাব আপনে একজন মুরুব্ব...'
কেউ একজন বলতে শুরু করতেই তাকে মাঝপথে থামিয়ে হুজুর বলে উঠলেন,

-'আরে মুরুব্বী কী করবে? এলাকায় আরো বড় মুরুব্বী আছে তো। আইচ্ছা আমি এলান করায়ে দিতাসি মসজিদ থিকা।'
বলেই আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত মসজিদের দিকে চলে গেলেন হুজুর।

মানুষজন যাচ্ছে আসছে যাওয়া আসার পথে লোকটাকে উঁকি মেরে দেখছে, এক দঙ্গল বাচ্চা কাচ্চাও জুটে গেছে, তারা একটু পর পর বয়স্কদের ঝাড়ি খাচ্ছে, একটু দূরে সরে যাচ্ছে আবার উৎসুক মুখে সামনে আসছে। মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ অস্ফুটে বলছে

-'আল্লাগো, বাঁইচ্চা আছে ব্যাডায়?'

'-কী ব্যাপার, এখানে এত ভীড় কেন?'
চৌকস পোশাকের, এ পাড়ার গরীব গুরবোদের সাথে মেলে না এমন পোশাকের এক কম বয়স্ক দম্পতি রিক্সা দিয়ে মোড় পার হতে গিয়ে ভীড় দেখে বিরক্তিতে বলে উঠলো

ভীড়ের মধ্য থেকে কয়েকজন চাপা গলায় বলতে লাগলো
- 'বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা।' কেউ জবাব দেবার আগেই মসজিদের মাইকিং শোনা গেল-

-'একটি ঘোষণা একটি ঘোষণা, নামাপাড়া শহীদুলের মোড়ে নাম পরিচয় বিহীন একটা মানুষ পড়ে আছেন, কোন হৃদয়বান ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেন। লোকটি অজ্ঞান হয়ে আছে। সে এই এলাকার কেউ না। একটি ঘোষণা...'।

স্মার্ট মধ্যপ্রদেশে স্ফীত সুখের উদয় হচ্ছে এমন চেহারার সুবেশী ছেলেটা মনে হল আরো বিরক্ত হল ঘোষণা শুনে।

-'আহ কেউ একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না, কতক্ষণ ধরে পড়ে আছে এই লোক?'

- 'এক ঘন্টা হইয়া গেছে- কে জানি বলল'

-'এক ঘন্টা?-মেয়েটা এবারে মুখ খুল্ল
- ও গড।' বাক্য শেষ করল সে।

কই দেখি তো, বলে এগিয়ে এল এবারে ছেলেটা বিরবির করে কী জানি একটা বলল এলাকা নিয়ে। এইরকম এলাকায় তার থাকার কথা না বা এই ধরনের কিছু।

-'হুম, একেবারে স্ট্রিট বেগার টাইপ। ওকে সবাই সরেন। সিমস লাইক এপিলেপটিক কেইস, দাঁড়ান।আমি একটা ছবি তুলে নেই। '

মেয়েটাও রিক্সা ছেড়ে নেমে এল, মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল- 'গ্রেট, আমিও এটাই ভেবেছিলাম, তুমি জলদি ফেইসবুকে দাও, তোমার যে পরিমাণ ফলোয়ার, আমি দিলে কিছু হবে না, নাইলে আমি-ই দিতাম।'

আশে পাশের তুলনামূলক গরীব শ্রেনীটা একটু সিঁটিয়ে দূরে গেল। ছেলেটা একটু ঝুঁকে ছবি তুলতে গেল তখনই লোকটা আবার হাত পা ছড়িয়ে গোঙ্গানী শুরু করল, ছেলেটা আঁতকে উঠতে গিয়েই সামলে নিয়ে একটু অস্বস্তির কাশি কেশে আবার স্মার্টলি ছবিটা তুল্ল। এবারে রিক্সায় উঠতে উঠতে সে ফেইসবুকে ছবি পোস্ট করে স্ট্যাটাস লিখতে লাগলো।
একটু ভেবে লিখতে হবে। তার নিজের একটা ব্র্যান্ডিং আছে ফেইসবুক সেলিব্রেটি হিসেবে, পোস্টটা যেন শেয়ার হয় বেশী। পাশের মেয়েটা কাঁধের ওপর দিয়ে তার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে, রিক্সাটা ওদের নিয়ে মোড় ক্রস করে চলে যেতেই ভীড়টা আবার কাছিয়ে এল।

এমন সময় আবার একটা হুল্লোড় উঠলো পরের মোড়ের চায়ের দোকান থেকে চিতকার শোনা যাচ্ছে, আইপিএল এর ক্রিকেট খেলা চলছে। বলে বলে বাজী ধরা হচ্ছে। টানটান উত্তেজনা। চিতকার শুনে ভীড়ে থেকে কম বয়সী কিশোরেদের কয়েকজন ছুটে সেদিকে চলে গেল।

হঠাত আবার একজনকে দেখে গেল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ছুটে আসতে,

-'কী হইসে অ্যাঁ? কী হইসে দেখি সরেন সরেন।'
এলাকার সাংবাদিক আজাদ সাহেব , মূলতঃ একটা নিবন্ধন বিহীন অনিয়মিত ম্যাগাজিনের রিপোর্টার, সদ্য অনলাইনে একটা নিউজ সাইট খুলে সেটাতে বিভিন্ন সাইট থেকে রগরগে খবর কাট পেস্ট করে চলে, এলাকায় সাংবাদিক হিসেবে তার প্রবল দাপট। অশিক্ষিত স্থানীয় প্রভাবশালীরাও বেশ সমঝে চলে তার চালিয়াতিকে।

-'সাংবাদিক সাপ, ওই সাংবাদিক সাপ আইছে।' অজান্তেই উচ্চারণ বিভ্রাটে উলটো সঠিক শব্দেই তাকে সম্বোধন করে একজন।

-'এই লোক এইখানে এতক্ষণ পইড়া আছে আর আমাকে কেউ জানান নাই? এইটা মিডিয়ায় দিলে কী হবে জানেন? পুলিশ কেইস বোঝাই যাইতেছে, পুলিশ কেস। কে কে দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া দেখছেন সবার লিস্ট করতে হবে, সবার নাম থানায় যাবে। একটা লোক মরে যাচ্ছে আর সবাই দেখতেছে, কেউ মিডিয়াকে খবর দেয় নাই! এই মুর্খের দল দিয়া কী হবে? এই জন্আযেই দেশতার এই অবস্থা! এখনই থানার ওসিকে কল দিচ্ছি, আর কয়েকটা চ্যানেল, ফোন দিল পর দেখেন কী হুলুস্থুল হয়!'

সাংবাদিক সাহেবের হম্বি তম্বিতে সবাই সিঁটকে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সাংবাদিক তার বুক পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করে ডাকা শুরু করলেন। একের পর এক ফোন করলেন, এক ফাঁকে লোকটার একটা ছবি তুলে নিয়ে আরেক দফা সবাইকে ঝাড়ি দিয়ে দ্রুত থানায় সশরীরে জানাতে ও নিউজ পোর্টালে খবরটা দিতে চলে গেলেন। সবকিছুর মধ্যে লোকটা গোঙ্গানী থেমে থেমে একটা অদ্ভূত উদারায় চলে যাচ্ছে। ভীড়ের অনেক চলে যাচ্ছে আবার কিছু নতুন মুখের উদয় হচ্ছে,

হঠাত এমন সময় বাইকের হর্ণ শোনা গেল। বাজখাঁই গলায় কিছু অশ্রাব্য গালাগাল,

-...র পুতেরা রাস্তার মইদ্যে কি? হালারা রাস্তার মইদ্যে কী?' আলাল। এলাকার মাস্তান। সব এলাকাতেই যেরকম পাড়াতো কেউ থাকে আর কি। তাকে দেখেই সেই মিরগি রোগ নির্ণায়ক লোকটা আস্তে করে কেটে পড়লো। আর স্যান্ডেল শুঁকাতে থাকা কম বয়সী এক ছেলে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল
- 'আলাল ভাই, মিরগি হইসে।' আলাল তার বাজাজ বাইকটা রাস্তার কিনারে পার্ক করে চোখ কুঁচকে নামলো।

-'ভাই-'
ওই ছেলে আবার বলতে যেতেই হাত তুলে তাকে থামালো আলাল- খাড়া! এ কোইত্তে আইসে?

-'জানি না ভাই,'

-'মরার আর জায়গা পায় না, মিরগি তরে কইসে ক্যাডা? এইডা তো ইশটক মনে হইতাসে। তো তরা খাড়ায়া খাড়ায়া দেখতাসোস? হালা ...র পোলারা । মা...।

-'ভাই খেইপেন না ভাই।'

আলাল আসার পর ভীর আস্তে আস্তে পাতলা হচ্ছে,

-'কতক্ষণ পইড়া আসে অ্যায় ?'

-'ভাই এক ঘন্টা'
সাথে সাথে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিলো আলাল তার গালে। ...য়ার পোলা, একঘন্টা ধইরা খাড়ায়া রঙ দেহস? এই লোক তো মরব। বলেই সে কতক্ষণ আবার অশ্রাব্য গলায় কী কী বলা শুরু করল। পেছন দিকে ঈমাম সাহেবকে আবার দেখা গেল গলা বাড়িয়ে আলালকে দেখেই আবার সুট করে মসজিদের মধ্যে ঢুকে গেলেন। 

-'ধর লোকটারে ধর, হালার ভাইরা ভাত খাস না? দুই ঠ্ছযাং ধর, এক ঠ্যাং তিনজনে ধরসস ক্যান? ছয়জন মিল্যা এই ক্যাঙ্গারুরে তুলবার পারস না, ল আমি মাতা ধরি, ওই রিক্সা, ওই বান্দির পুত, প্যাসিঞ্জার নামা, নামা তর প্যাসিঞ্জার!' 
ধীরে সুস্থে আসছিলো এক রিক্সা তাতে এক মোটাসোটা লোক, আলালের কথা শুনে সে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল, আর রিক্সাওয়ালা এসে লোকটাকে ধরে রিক্সায় তুলল।

-'হুন, দুই জন এরে লয়া ডাইরেক রোডের মাতায় যা, আমি আইতাসি বাইক লয়া।'

মুহূর্তের মধ্যেই রিক্সা করে ক্ষীণ স্বরে গোঙ্গাতে থাকা এখনো বিস্ময়করভাবে জীবিত লোকটাকে নিয়ে চলে গেল, পিছন পিছন খিস্তি করতে করতে আলাল তার পুরোনো বাজাজ মোটর সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো।
হঠাত করেই ভীড় আবার পাতলা হতে লাগলো, বেশীরভাগ লোকই আইপিএল চলতে থাকা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। মহিলারা আগেই ভেতরে চলে গেছে। আস্তে আস্তে ঈমাম সাহেবকে আবার দেখা গেল রাস্তায়, গুটিকয় দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের জিজ্ঞেস করলো
-'নিয়া গেছে লোকটারে?'
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো কয়েকজন
-'আলাল ভাইয়ে নিয়া গেসে।'
-'আলাইল্যা?।'
-'হ।'
-'যাউক।'