Sunday, December 11, 2022

আজদহা আর আলিশান খাঁ

মেহেদী হক

চন্দনগড়ে আজ ক’দিন ধরেই থমথমে উত্তেজনা, কিসের একটা চাপা ভয় চারিদিকে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই উত্তরের হাট বন্ধ করে দিচ্ছে মহাজনেরা। ঝাউতলার যাত্রাপালা আর বসছে না, বাচ্চারা রাতে আর কাঁদছে না, চ্যাংড়া বখাটেরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? ব্যাপার হল গুজব রটেছে তেপান্তরের ওইপাড় থেকে (যেখানে কেউ যায়নি কিন্তু সেটা যে আছে সবাই জানে) আজদহা নেমে এসেছে এই পাড়ে!

আজদহা কী?

আজদহা হল বিরাট এক সাপ, যার বড় বড় ঠাণ্ডা লেবুর মত  সবজে চোখ, কটকটে তীক্ষ্ণ তিমি মাছের কাঁটার মত দাঁত। নিশ্বাস যেখানে পরে সেখানে গর্ত হয়ে যায়, গর্ত সাথে সাথে ভরে ওঠে পাতালের কালো পানিতে আর তাতে ঘুরতে থাকে ছোট ছোট কুমিরের মত কাঁটাল মাছ।

আজদহা একশো বছর ঘুমিয়ে থাকে, আর ঘুম ভাঙ্গলেই হাভাতের মত চারদিক গিলতে গিলতে নাকি ছুটে আসে। আশেপাশে যা পায় তার আর বাছবিচার করেনা, হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, খরগোষ, মোষ, মুষিক, খড়ের গাদা, চালের নাড়া, তাল গাছ, শাল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ- সোজা কথা সব গিলতে গিলতে বড় বড় লেবু রঙা দুই চোখ খুলে সে আসছে, এদিক ওদিক নিশ্বাস ফেলে ফেলে বিষম গর্ত করে করে চারিদিক ফুটিফাটা। ও হ্যাঁ তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারের কথাই তো বলা হয়নি, সেটা হল- মানুষ! মানুষ যদি পায় তবে নাকি সে সব কিছু ফেলে তার পিছনে ছোটে। তেপান্তরের এই পাড়ে (যেখানে মানুষেরা থাকে আরকি) মোটামুটি সব রাজ্যের মানুষ নাকি ইতিমধ্যে আজদহার পেটে চলে গেছে, এমন খবরই সেদিন চন্দনগড়ের রাজপথে ধরে ছুটে আসতে আসতে রাজা গদাধরের প্রধান চর বিটকেল বর্গি চিতকার করে বলছিলেন। সেই থেকে রাজ্যের আর কারও জানতে বাকি  নেই যে আজদহা চলে এলো বলে।

পরের ঘটনায় যাবার আগে রাজা গদাধরের কথা একটু বলতে হয়। নামে গদাধর হলেও গদা টদা তিনি খুবই ভয় পান। সারাদিন নিজের কামরায় ঘাপটি মেরে শুয়ে বসে থাকেন আর চারবেলা ভূড়িভোজ করেন। রাজ্যের যে অবস্থা তাতে যে এরকম বিলাসব্যাসন করাটা খুব ভালো আইডিয়া তা না। কোনরকম রাজকার্য না করে করে আর খাজনা-(ঘুষ) ইত্যাদি না তুলে তুলে রাজকোষও তেপান্তরের মাঠ। এদিক ওদিক থেকে ধারদেনা করে করে চালাচ্ছেন, এই করতে করতে ইদানীং অন্য রাজ্যের রাজারা ধারও দিতে চাচ্ছে না। আর অন্যদিকে অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির বলে রাজার আজ পর্যন্ত কোন রানীও হয়নি। বিয়ের পয়গাম হয়, আয়োজন হয় কিন্তু মূল অনুষ্ঠানে বরের খবর নেই, না তিনি নাকি নিজের কামরায় বসে বসে আখ চিবাচ্ছেন, এরকম একাধিক চেষ্টা (তেপান্তরের) মাঠে মারা যাবার পর প্রধান উজীর সুগম্ভীর ভদ্র হাল ছেড়েছেন। ওদিকে ভুষণ্ডির রাজা গোগণ্ডগোল হুমকী দিয়েছেন তাঁর পাওনা ফেরত দিতে না পারলে অচিরেই চন্দনগড় সে দখল নিতে আসবে। কারণ এদ্দিনে যা ধার দিয়েছেন তা দিয়ে নাকি দুইটা চন্দনগড় সব মানুষসুদ্ধ কেনা সম্ভব। যাই হোক এসব কিছুর পরেও জনগণের প্রবল অপ্রিয় হলেও চন্দনগড়ে তার প্রতিপক্ষরা তার চেয়েও ক্যাবলাকান্তি বলে সবাই অগত্যা তাঁকেই মেনে নিয়ে কষ্টে সৃষ্টে চলছেন। বরং রাজা অন্যমনস্ক বলে মাঝে মাঝেই ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি মেরে অনেকে বেশ ভালোই আছেন বলা যায়।

তো এইরকম জোড়াতালি দিয়ে দিয়ে তাও চলেই যাচ্ছিলো, তা এর মধ্যে হঠাত বলা নেই কওয়া নেই চলে এলো আজদহা। যাকে কেউ দেখেনি, কিন্তু আজন্ম শুনে আসছে যখন আছে তো বটেই। দাদা পরদাদা থেকে শুনে আসা জলজ্যান্ত গল্প সব, প্রাচীন পুঁথিতে কাঁচা হাতে কিছু আঁকিয়ে বড় করে এঁকেও রেখেছে তার ছবি, একেবারে ভিরমি কাটার মত ছবি বটে। তাই ক’দিন ধরে সবাই একটু তবদা মেরে আছে।

কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না, কিছু একটা করতে হবে। উজীর সুগম্ভীর ভদ্র শেষে থাকতে না পেরে রাজা গদাধরের কামরায় এলেন।  রাজা তখন নিবিষ্ট মনে একটা ঢাউস সাইজের তালমিছরির টুকরো মনযোগ দিয়ে চাটছেন। আবেশে চোখ প্রায় ঢুলু ঢুলু এমন সময় সুগম্ভীর তাঁর জলদগম্ভীর গলায় বললেন-

রাজামশাই!

কে? কে? আচমকা আওয়াজ শুনে হাত থেকে মিছরির তাল পড়ে গেল মাটিতে, সাথে সাথেই রাজার খাস ভৃত্য কুড়াই সেটা কুড়িয়ে আবার পাতে তুলে রাখলো।

গলা খাকারি দিয়ে সুগম্ভীর বললেন- জ্বী আমি, বলছিলাম কিছু একটা করতে হয় এবারে।

-         কী বিষয়ে?

-         আজদহা।

-         ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা কী করা যায়?

-        আবার গলা খাকারি দিয়ে খাস ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলেন উজীর। রাজা সেটা দেখতে পেয়ে হাতের ইশারা করলেন, ভৃত্য কুড়াই সাথে সাথে কামরা ত্যাগ করলো।

গলা নামিয়ে কাছে এসে উজীর বললেন-

-         রাজামশাই মার্সেনারি ভাড়া করুন।

-         মারছে কী?

-         মার্সেনারি- মানে ভাড়াটে পালোয়ান। সে আপনার হয়ে আজদহা মেরে দেবে।

-         কেন মেরে দেবে?

-         আপনি তাকে লোভ দেখাবেন, মেরে দিলে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা।

-         আরে আমার তো রাণী-ই নাই, রাজকন্যা কোত্থেকে আসবে? আর রাজ্যও তো যায় যায়।

-       তাহলে অন্য কোন একটা চাপা মারতে হবে। আমাদের যে রাজকোষ খালি তা তো আর সেই ভিনদেশি পালোয়ান জানবে না। শর্ত থাকবে। সে আজদহাকে মারতে গিয়ে মরে গেলে আমরা তার একটা মূর্তি বানাবো রাজদ্বারে আর বেচে গেলে রাজকোষ।

-         মরে গেলে তো মনে হচ্ছে ব্যাটার লাভ বেশী হবে। রাজদ্বারে মূর্তি সোজা কথা না। আর অর্ধেক রাজত্ব দিলে তো ঋণের অর্ধেক তাকেই দিতে হবে।

-       এগজ্যাক্টলি, আমার মতে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিন। যে আজদহাকে মারতে পারবে অর্ধেক রাজত্ব আর- ওই ইয়ে, না রাজকন্যা হচ্ছে না। যাই হোক ম্যানেজ করতে হবে একভাবে।

     কী নেজ?

-         ম্যানেজ- মানে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। শেষে ছোট করে একটা *শর্ত প্রোযোজ্য টাইপ কিছুও জুড়ে দেব। ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইলো, আমি এলান তৈরী করে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নিচ্ছি।

-         ফিং- কী?

-         আরে ধুরো, সব বোঝার দরকার নেই আপনি মিছরি খান।

এই বলে উজির সুগম্ভীর বের হয়ে পুরো চন্দনগড় জুড়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন যে যে আজদহাকে মেরে আসতে পারবে সে পাবে চন্দনগড়ের অর্ধেক রাজত্ব ও আরো অনেক ‘আকর্ষণীয়’ পুরস্কার। কিন্তু ঢেঁড়া পেটানোর পর দেখা গেল চন্দনগড়ের অর্ধের রাজত্ব নিয়ে কারো তেমন কোন উৎসাহ নেই। আকর্ষণীয় পুরস্কারেও কেউ খুব একটা আগ্রহী না। প্ল্যান মাঠে মারা যাচ্ছে আর ওদিকে শোনা যাচ্ছে আজদহা নাকি খুব কাছাকাছি চলে এসছে। উপায়ন্তর না দেখে উজীর সুগম্ভীর আরো গম্ভীর হয়ে এই সব ঢেঁড়া ট্যারা বাদ দিয়ে সরাসরি পালোয়ান ধরে আনার জন্যে চারিদিকে লোক পাঠালেন। একের পর এক ভাড়াটে পালোয়ান এল- তেপান্তরের দিকে গেল, কিন্তু- আর ফিরে এলো না। তার মধ্যে ছিল-

মুচড়া খান, (প্রতিপক্ষকে খালি হাতে মুচড়ে দেন) কটকটি সিং (অত্যন্ত কটকটে মেজাজ), মুগুর মালী (বাগানের মালী, বাগানে বাঘ এসে পড়ায় মুগুর পেটা করে সেটাকে তাড়ান তাই মুগুর মালী), তলোয়ার খাঁ (তলোয়ার এ সিদ্ধহস্ত) চাবিলাল (এর বিশেষত্ব ভালমত জানার আগেই তিনি আজদহার খোঁজে চলে যান ও আর ফিরে আসেন নি)। এরকম একের পর এক পালোয়ান এল আর গেল কিন্তু কেউ ফিরে এলো না। এদিকে চন্দনগড় মোটামুটি খালি হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে উজীর আদেশ দিলেন

-         আলিশান খাঁ কে খবর দাও, বলো যে সে রাজি হলে পুরো রাজত্ব!

আলিশান খাঁ হল গোটা সপ্তভূমির সবচেয়ে নামজাদা পালোয়ান, শোনা যায় খালি হাতে নাকি হাতি নিয়ে লোফালুফি করেন প্রতি সকালে। এক চুমুকে পুকুরের সব পানি খেয়ে ফেলেন (মাছসহ)। আস্ত সুপারী গাছ দিতে দাঁত খোঁচান। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল তাকে কেউ কখনো দেখেনি! তিনি নাকি থাকেন ভয়াল আন্ধারপোঁতা জঙ্গলে, কেউ যদি তার সাহায্য চায় তবে আন্ধারপোঁতা জঙ্গলের যে আলিশান বটগাছটা আছে তার নিচে একটা কাগজে নিজের সমস্যার কথা লিখে রেখে আসতে হবে। সমস্যাটা গুরুতর হলে তিনি সেটা সমাধান করে দেবেন। তবে বিনিময়ে কী চাই সেটা উনি তখনি না বলে সময়মত চেয়ে নেবেন। উজির সুগম্ভীরের লোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আন্ধারপোঁতার পাকুর বটের তলায় কোনমতে চিঠিটা রেখেই ছুট! আদৌ কাজ হল কি না তা দেখার সময় নাই, সাহসও নাই কারো। উজীর কে তা বলাও হল না।

চিঠি পৌঁছে দেবার পরে এবারে শুরু হল অপেক্ষার পালা, ওদিকে চন্দনগড়ের আশেপাশে মাঝে মাঝেই অদ্ভূত সব গর্জন শোনা যাচ্ছে, সবাই মোটামুটি নিশ্চিত আজদহা চলে এসেছে, আর সময় নাই। যারা এখনো ছিল তারাও এবারে দলে দলে চন্দনগড় ছাড়া শুরু করলো। উজীর সুগম্ভীর ও রাজা গদাধরকে  সহ পালাবার জন্যে জুড়ি গাড়ি পেছনের দরজার বেঁধে রেখেছেন। আর একদিন অপেক্ষা করবেন এর মধ্যে আলিশান খাঁ চলে এলে তো হল, সে যদি আজদহাকে মারতে পারে তবে তো রাজ্য তারই। আর যদি সে না আসে তাহলেও রাজ্য চলেই গেল। দেখা যাক, আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা শুধু।  


আন্ধারপোঁতা জঙ্গল।

ভোর হচ্ছে। পুবের আকাশে লালচে কমলা রঙ ধরেছে। একগাদা পাখী ক্যাঁচর ম্যাচর শুরু করেছে তাও সেই আঁধার থাকতেই। জঙ্গলের প্রবেশপথের ঠিক সামনেই এক বিরাট অবয়ব। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে ছোটোখাট একটা পাহাড় না হলেও টিলা, কিন্তু নড়ে উঠতেই বোঝা গেল এটা কোন একটা প্রাণি। প্রাণিটার মাথাটা যেন বিরাট এক পাথুরে টিলা, কুঁতকুঁতে চোখ, সারা গায়ে ঝলমলে কালচে আঁশ। মাথার যেখানে কান থাকার কথা সেখান থেকে হঠাৎ পাখির ডানার মত কানকো ধরনের কিছু একটা বের হয়েছে। হেমন্তের সকালে নিশ্বাসে যেন ধোঁয়া ফুঁড়ে বের হচ্ছে থেকে থেকে। এই সেই আজদহা! বিরাট এক নাগসর্প, আদতেই বিরাট বপু। মোটামুটি কয়েক রাজ্যের প্রাণিকূল খেয়ে সাবড়ে এই জঙ্গলের কাছে একটু বিশ্রামে থেমেছে সে, হুট করে আর কিছু করার ইচ্ছা নাই। দেখা যাক, চাইকি এখানেই পরের একশো বছরের জন্যে ঘুমটা শুরু করা যেতে পারে। গত কয়দিন বেশ কিছু হুমদো হুমদো পালোয়ান টাইপ মানুষ খেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। আজ একটা দারুণ ঘুম দেবার তোরজোড় করছে সে এমনি সময় হঠাত দূর থেকে কাউকে আসতে দেখা গেল। সাদা আলখাল্লা পরা টিংটিঙে এক লোক। দেখে হাসি পেল আজদহার, এত এত পালোয়ান এর পর এ আবার কে? একে তো খেয়েও সুখ হবে না।

কাছে আসতেই দেখা গেল গেরুয়া বরণ আলখাল্লা পরা এক সন্ত-সাধু, হতে একটা একতারা নিয়ে স্মিতমুখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে আসছে। আজদহাকে সে যেন চোখেও দেখেনি।

আর থাকতে না পেরে কৌতুক চোখে তাকিয়ে আজদহা হালকা গলা খাকারি দিল-

-         এহেম!

-         আরে, তুমি আবার কে? বলে উঠলো সাধু বা গায়ক লোকটা।

-         আমি আজদহা, সপ্তভূমির সর্বোচ্চ খাদক। একশো বছর ঘুমিয়ে থাকি। জেগে উঠে খাই একশো হাতি, দুইশো মোষ, চারশো হরিণ, ছয়শো

-         আরে আরে থামো থামো। তুমি দেখি কথা কইতে পারো, আজব কিসিম প্রাণি? তা এত ঘুমাও ই বা ক্যান আর এত খাও ই বা ক্যান?

-         আজদহা একটু থতমত খেয়ে বলে- কারণ এটাই আমার কাজ।

-         খালি খাওন আর ঘুমান? এই কইরা জীবন কাটাইবা? দুনিয়ার আর কিছু দেখবা না? শুনবা না?

-         দুনিয়ার আর কিসের কথা হচ্ছে? অবাক আজদহা।

-         এই ধরো ফুল, এই ধরো মেঘ, এই ধরো একটা ব্যাং চুপ কইরা বইসা রইলো নদীর পাড়ে। বা ধরো শিল্পকলা, যাত্রাপালা, নাচ, গান, আঁকিবুকি। তা গানটান জানো কিছু?

আজদহা তো হতবাক। গান? এ আবার কী? পান খায় শুনেছি, জান যায় শুনেছি, বান ডাকে তাও জানি, কিন্তু গান? এ আবার কী?

-         গান কী? আজদহা শুধায়।

-         শোনার জিনিস, শুনবা নাকি??

-         ব্যাথা পাবো না তো?

-         আরে না না, পাইলেও কইলজার মধ্যে হালকা পাইতে পারো।

আজদহা শুনে ভয় পেয়ে গেলে সাথে সাথে লোকটা তাকে আস্বস্ত করে

-         আরে না না এই ব্যাথা সেই ব্যাথা না। শোন তাইলে।

বলে একতারায় টুং টাং শুরু করে গায়ক বা সাধু। এরপর ভরা গলায় ধরলো গান, সেই গান শুনে আজদহার প্রাণ আকুলি বিকুলি। চোখে পানি ছলাৎ ছলাৎ, প্রাণে পানি শলাৎ  শলাৎ। কলজেতে সেই ব্যাথা চিন চিন। গান শেষে ছল ছল লেবুর মত সবুজ চোখ একেবারে বরফের মত সাদা বানিয়ে মুখ তুলে সাধু বা গায়ক লোকটাকে বললো

-         কী শোনালে ভাই, এতো যাকে বলে একেবারে যা-তা লেভেলের। বলো তোমার জন্যে কী করতে পারি আমি?

-         তোমার ভাল লাগছে- এই আমার পাওনা।

-         তারপরেও বলো কী চাই তোমার।

-         একটা করতে পারো, যত নিরপরাধ প্রাণীকে খাইছো তাদের ফিরায়ে দাও। প্যাটের জন্যে যা খাইছো ঠিক আছে, জিবের জন্যে যা খাইছো তা ফিরত দাও। তুমি তো তন্ত্রমন্ত্র জানো, চাইলেই পারবা।

আজদহা চুপ।

-         কি হইলো।

-         ইয়ে মানে হজম হয়ে গেছে। আর মন্ত্র একটা ছিল মনে হয়, সেই একশো বছর আগে মুখস্ত করছিলাম, ভুলে গেছি।

-         আইচ্ছা বাদ দাও। যারা গেছে গেছে, আইজ আর কাইল। মন্ত্র টন্ত্র লাগবো না। এইবার কী করবা?

-         আরো গান শুনাও আমাকে।

-         না আইজ আর না, আমারে ওইবেলা ফিরতে হবে। একটা শো আছে নিমপোতার মাঠে।

-         আমিও যাব। করুণ চোখে তাকিয়ে বলে নাগসর্প আজদহা।

-         আমি ঠিক করছি এখন থেকে গান গাইবো, তুমি শিখাবে আমাকে? এই একশো বছর পর পর এই একই জিনিস আর ভালো লাগে না।

-         গান শিখবা?

-         হুঁ।

-         আইচ্ছা, লও যাই, তয় ঘাসপাতা খাইতে হবে কিন্তু। মানুষ, ইন্দুর বান্দর সব বাদ।

আজদহা ঘার কাত করে সম্মতি জানালো। এতগুলি জন্তু জানোয়ার (ও মানুষ) হজম করে বেচারা একটু অফ খেয়ে আছে।

আজদহা বশ পর্ব কেমন গেল এ নিয়ে রাতে সভা বসেছে রাজা গদাধরের কামরায়। আলিশান খাঁর পোষা কবুতর এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেছে উজীর সুগম্ভীরকে। তাই নিয়ে তিনি আর রাজার কামরায়-

-         এই পালোয়ানও মারা গেছে?

-         যাক মূর্তি টুর্তি বানানো লাগবে না। রাজদ্বারে মূর্তিতে মূর্তিতে ছয়লাব। আর রাজত্ব?

-         চায় না।

-         পাগল নাকি?

-         তাই তো মনে হয়, অথবা বেশি বুদ্ধি।

-         সেকি তাহলে- তাহলে তো পুরা­-

-         হ্যাঁ, পুরা লোন আপনাকেই টানতে হবে। একটু থেমে যোগ করেন উজীর- ইন্টারেস্ট সহ।

রাজা আবার মুষড়ে পড়ে সজোরে মিছ্রির তাল চুষতে শুরু করেন।

সুগম্ভীর বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললেন

-         ইমোশনাল ইটিং।

আর আজদহা? সে আর সেই নাম না জানা বাউল (নাকি আলিশান খাঁ?) নাকি আজকাল সপ্তভূমির বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে শো করে বেড়াচ্ছে, আগে থেকে বুকিং না দিলে নাকি শোতে ঢোকার উপায় থাকে না।