Wednesday, November 16, 2022

যে তিনটি কারণে আমার উপন্যাসটি আজো লেখা হয়নি।

নাম্বার ১

নাম
প্রথম কারণটি আসলে কোন কারণ বলা যাবে না, বলা যায় কপালের ফের। কারণটা হল আমার নাম! আমার নাম মাহমুদুল হক। নামের কোন সমস্যা না, সমস্যা হল এই নামে আরেকজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আছেন। কালো বরফের লেখক- মাহমুদুল হক। তার মানে নিজের নামে লেখা শুরু করলে সেটা পরে গিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি ঝামেলার জন্ম দেবে, তখন  বলতে হবে কোন মাহমুদুল হক? কালো বরফ? নাকি কাপুরুষের জবানবন্দি' র মাহমুদুল হক? (আমি আমার উপন্যাস না লিখলেও সেটার একটা নাম ঠিক করে রেখেছি।) এই ঝামেলায় যাওয়াই যাবে না। নাম পালটে ফেলতে হবে। তাহলেই সব ঠিক। সমস্যাটা সেখানেই হল। উপন্যাসের খসড়া মনে মনে ভাবা শেষ, কিন্তু নাম আর খুঁজে পাই না। কী নাম দেব? অনিকেত হক? মৃদু নাসের? কৃষ্ণ হক? নাকি ভারি কোন নাম যেমন- নাভিয়ান আরমান মুরাদ? ভ র ম ইত্যাদি মিলে মিশে একটা থিক থাই স্যুপ ধরনের কিছু। কিন্তু শেষ মেশ আর পছন্দ হলই না কোন নাম। এবং সত্যি, ওই একটা কারণে আমার আর উপন্যাসের প্রথম লাইনটা আজো লেখা হয় নি! সুতরাং কারণ নাম্বার এক বললে এটাকেই লিখতে হবে।

নাম্বার ২

সারভাইকাল রিব এরর।
ইংরেজীতে বলার কারণে ব্যাপারটার একটা আলাদা গুরুত্ব এসছে, এবং ব্যাপারটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ না, ব্যাপারটা গুরুতর। যারা যারা ভাবছেন কেন আমি নাম ছাড়া নিদেনপক্ষে উপন্যাসটা বেনামে হলেও লিখে ফেললাম না তাঁদের জন্যে এই দুই নাম্বার কারণটা একটা উত্তর। ঠিক ধরেছেন, শুধু আপনি মনে মনে ভাবছেন যে ব্যাটা নাম বাদ দিয়ে জিনিসটা লিখে ফেলতি- তা নয়, আমি নিজে সেটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু 
ঠিক যেদিন আমি নাম ছাড়া লিখতে বসেছি ওপর থেকে প্রজাপতি হাসিমুখে চোখ টিপে বললেন, দেখি কিভাবে লিখিস- এবং লিখতে বসে টের পেলাম হাত নড়লেই চোখে অন্ধকার দেখছি। ঘাড় মাথা সব টরররর হয়ে যাচ্ছে। চোখে মুখে অন্ধকার। প্রচণ্ড বেদনা সারা ঘাড়ে। ডাক্তারের শরণে গিয়ে জানা গেল এটা কিঞ্চিত হাড় মুড়মুড়ি ধরনের ব্যামো বটে। এর গালভরা নাম সারভাইকাল রিব। স্রষ্টা আমাকে কম দেননি, বরং অন্যদের চাইতে বেশীই দিয়েছেন। আমার গলার কশেরুকা হাড়ের শেষটা দুইদিকে একটু বেশী বড়। যার ফলে ঝুঁকে কিছু লিখতে গেলে সেটা নার্ভে চাপ দেয়। আর চোখে মুখে অন্ধকার দেখা যায়। আগেও ছিলো বয়সকালে আস্তে আস্তে গোকুলে বেড়েছে। সময়মত, মানে কিনা ঠিক যখন বুকার টুকার সামনে প্রায় উঁকি দিলো বলে- তখনই ইনি ম্যাচিওর্ড করেছেন। এখন কোন উপায় নেই। এর অপারেশন খুবই রিস্কি। হয়ত দেখা গেল এটা ঠিক হয়ে গেল কিন্তু আমার বাম পাশের ঠোঁট আর চোয়াল ঝুলে গেল একপাশে। ভুল করে হয়ত অন্য কোন নার্ভে চাপ পড়ে গিয়েছিলো। নার্ভের তারগুলি নাকি অনেকটা বিটিটিবি টেলিফোনের এক্সচেঞ্জ বক্সের তারের মত। শুনে টুনে তাতে আর সায় দিলাম না। তার বদলে চল্ল টোটকা দাওয়াই। প্রথমে নামকরা ফিজিও থেরাপিস্ট ঘাড় টার টিপে টুপে বললেন, বাস- বুঝে গেছি। রমজান! একে দেড় কেজি ঝোলাও! সভয়ে তাকিয়ে দেখি চোঁয়ারে ধরনের  এক যমের অরুচী রমজান কোত্থেকে কি সব বাটখারা নিয়ে এল। সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় ঝোলাবেন? রমজান জিজ্ঞাস করলেন- সমস্যা কোথায়? ইয়ে, ঘাড়ে। তাইলে ঘাড়ে। মনে মনে আর কোন জায়গায় সমস্যা হয়নি বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। মোটামুটি মাসখানেক প্রায় প্রতিদিন মাথায় আর ঘাড়ে পেঁচিয়ে পুচিয়ে কিভাবে করে এই কেজি দুইয়েক বাটখাড়া ঝুলিয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হল। ঘাড় ব্যাথা তো ঘাড়ব্যাথা, পারলে ঘাড়টাই বিদায় নেয়। আয়নার সামনে তাকালে গলা লম্বা লম্বা লাগে ইদানীং। সব কষ্টই সহ্য করা যায় যদি লেখালেখি আবার শুরু করা যায়। কিন্তু না। বরং ব্যাথা দিন দিন বাড়ছেই। এদিকে যেই শুনছে সেই একটা অব্যার্থ ওষুধ বাতলে দিচ্ছে। কেউ বল্ল সাভারের সিআরপি তে চলে যাও, সেখানে যাবার সাথে সাথে বাতাস গায়ে লাগলেই নাকি ঠিক হয়ে যাবে। (কে যায় সেই সাভার?) কেউ বলে, ওই সব কিচ্ছু না, মেডিটেশন কর। আলফা লেভেলে গিয়ে ভাবো তোমার হাড় হাড্ডি কিছুই নেই, তুমি বালির দলা। (দুইদিন চেষ্টা করে ঘুমিয়ে পড়লাম, বেকায়দায় ঘুমিয়ে এবারে ঘাড়ের অন্যদিকে ব্যাথা শুরু হল)। আরেক আত্মীয় বুদ্ধি দিলেন এক চৈনিক চিকিতসকের কাছে যেতে। চিকিতসক একজন মহিলা, তিনি নাকি চাইনিজ সিস্টেমে কঠিন ঝাঁড়া দেন, আর বান টান কি জানি করেন। আমি অত পাগল হইনি যে চৈনিক ওঝার কাছে যাব। কিন্তু সেই আত্মীয়র ঘাড়েও এরকম কী একটা সমস্যা ছিলো আর তিনি নিজে উপকার পেয়েছেন। সুতরাং একটা ট্রাই নেয়া যাক। 

চৈনিক চিকতসার বিতং না বললে আসলে কেউ বুঝবেন না যে আমি লেখালেখি নিয়ে কতটা সিরিয়াস। চৈনিক চিকতসা আসলে কিছুই না, ফিজিওথেরাপির ঢঙে দলাই মলাই, দলাই মলাই করে চারজন মেয়ে (কেউ আগ্রহী হয়ে ঠিকানা চাইবেন না, এই চারজনের হাতের চাইতে লোহার পাত নরম)। এর পরে কিছু সাকশন কাপ বসিয়ে দেয়া হয় সারা গায়ে- আই মিন সা-রা গায়ে। সেগুলি বায়ুশূন্য করে দেয়া হয় ফলে নিচের ভেইনের রক্ত সব জমাট বেঁধে থাকে। এর পর যখন ছেড়ে দেয়া হয় তখন হঠাত করে দ্রুতবেগে আবার রক্ত চলাচল করে, ফলে একটা চনমনে বোধ হয়। এটা ছিলো থিওরি। আমার বেলায় থিওরি খাটলো না। দেখা গেল রক্ত আমার জমাট বেঁগে সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ছেড়ে দিলে সেটা আটকেই থাকছে। দ্রুত বেগে নামছে না। চৈনিক চিকিতসক- যাঁর বাংলাদেশি নাম আরজিন আরা, আসল নাম ওজিনো আরা। তাঁর ২৬ বছরের চর্চিত বাংলায় বললেন,

- কিচু গুলমাল মুনে অয়। টিক অই যাবে নো ছিন্তা ইয়াং মেন।

আমি বিমর্ষ মুখে এদিক ওদিক তাকাই, পাশের বেডে আরেক ছেলে আমার সমবয়সীই হবে, চারজন লৌহ মানবীর কিল ঘুষি খেতে খেতে আমাকে বল্ল- ভাই আপনার কেস কী? আমি জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেলাম। এবং ওইদিনই ছিলো আমার এক বন্ধুর জন্মদিনের দাওয়াত, আমাকে দেখে সে আঁতকে উঠলো। কারণ ঠিক কপালের মাঝ বরাবর একটা সাকশন কাপ দেয়াতে দেখতে হয়ছে অনেকটা সংশপ্তকের হুরমতির মত। গভীর কালচে লাল জমাট বাধা একটা গোল দাগ। এটার গ্রহণযোগ্য ব্যখ্যা অল্প পরিচিত কাউকে দেয়া সম্ভব, ছোটবেলার বন্ধুকে বিশ্বাস করানো কঠিন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একই সাথে জীবনের একটা সম্পদ ও তারচেয়েও বেশি জীবনের অভিশাপ। কপালের এই দাগের তাই অদ্ভূত, ভয়াবহ ও কুৎসিত সব ব্যাখ্যা বের হতে লাগলো। যাদের এরকম অভিশপ্ত বন্ধু আছে তারা আশা করি কিছুটা আঁচ করতে পারছেন, সেটা দশ দিয়ে গুণ করলে আমার সমস্যার কাছাকাছি একটা কিছু ধরতে পারবেন।

যাই হোক এই সব আজব আজব কারণে আমার লেখাটা শুরু হয়নি তখনো। তবে সুসংবাদ হল সব জড়িবুটি বাদ দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড এডযাস্টেবল বসার চেয়ার কেনার পরেই দেখা গেল আস্তে আস্তে হাড় মুড়িমুড়ি সমস্যাগুলি অনেকটা কাটা শুরু করলো। ব্যাস, হাতের ব্যাথার অজুহাত নেই, আর তদ্দিনে এক আঙ্গুলে টুকুরটাকুর করে ইউনিকোডে বাংলা হরফ টাইপ করাও মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেছে, কাগজে কলমে লেখার ব্যাপারটাও নেই, তাহলে?
তাহলে এর পর আর কী থাকতে পারে? কী কারণে তবে আর বসে থাকা? সেটাই আসলে দি এন্ড বা সাহিত্য সমাধি। বলা যাক তবে-

নাম্বার ৩

যদিদং হৃদয়ং তব
উপন্যাসের খসড়া মাথায় মাথায় দাঁড়া করানো আর সত্যি সত্যি লিখে ফেলা দুইটা দুই জিনিস তা লিখতে গিয়েই টের পেলাম। খালি সাদা মনিটর আর সেখানে ব্লিংক করছে একটা ছট্ট কালো কারসার। এটা যে কি ভয়াবহ দৃশ্য তা আশা করি লিখতে চেয়েও লিখতে না পারা অনেকেইউ বুঝতে পারবেন। দেখা গেল ঘণ্টা চলে যাচ্ছে একবার ও কি বোর্ড এ হাত দেয়া হচ্ছে না, এরপর থেকে দেখা গেল আমি লিখতে না পারার কারণে যে কোন কিছুতেই অন্য সবার দোষ খুঁজে পাচ্ছি, আর পাশাপাশি অনেক গুলি কারণ অলরেডি বের করে ফেলেছি যেমন একটা বলি-  আমি লিখতে পারছি না এর মূল কারণ আসলে পশ্চিম দিকের একটা বাড়ি যেটা নতুন সাদা রঙ করা হয়েছে সেটা। কারণ ঠিক যখন আমি নাস্তা টাস্তা করে নেট এ জীবনের অনেক সময় অপচয় করে পরে লেখার একটা মুডে আসি তখন ই সেই বিল্ডিং এ রোদ পরে প্রতিফলিত হয় চোখের মাঝে লাগে। এরকম অবস্থায় লেখা যায় না। টেবিল সরিয়ে দেখেছি তখন আবার অকারণে বাসার সবাই (যারা আমার সাহিত্য নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়) কোন কারণ ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করে। মন দিয়ে লেখা তখন একটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখন বুঝতে পারছি লেখকেরা কেন লেখার আগে একটা তারবিহীন টাইপ্রাইটার নিয়ে একটা দ্বীপের মধ্যে চলে যায়।

পর পর কয়েকদিন এই অবস্থা যাবার পরে আমার মেজাজ অনেকটা আমাদের বাসায় সামনের কালুর মত হয়ে গেল। যে কাউকে দেখলেই খ্যাঁ করে উঠছি, বা গরগর করছি শুধু কন্ঠনালীর কিছু সীমাবদ্ধতার জন্যে তাঁর মত পুরোদমে ঘেউ ঘেউ টা করা যাচ্ছে না। 

ঠিক এইরকম তুঙ্গ অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও মাথা ঠাণ্ডা করতে চলে গেলাম আবার সেই বন্ধুদের কাছে (যেটা আমার জীবনের আরেকটি বড় ভুল)। তারা আমাকে দেখা মাত্র বুঝে ফেললো কিছু একটা গড়বড়। হাজার হলেও বাবা মায়ের চাইতেও এই অভিশপ্ত বন্ধুরাই আপনাকে সবচে বেশি চেনে। শুনে টুনে তারা যেই বুদ্ধি দিল তা এইরকম-
আমার লেখা হচ্ছে না কারণ আমার কোন প্রেম হয় নাই, এবং সেই কারণে ছ্যাঁকাও খাই নাই। মহৎ সাহিত্য করতে গেলে প্রেম লাগে,যত বেশি প্রেম তত বড় সাহিত্য আর বিরাট কালজয়ী কিছু করতে গেলে লাগে ছ্যাঁকা। এইটার কোনটাই নাই বলে আমার লেখা টেখা হচ্ছে না আর হবেও না। 
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম।
- আমাকে এখন আমার উপন্যাস লেখার জন্য প্রেম করতে হবে?
- অবশ্যই!
- আর ছ্যাঁকা খাইতে হবে?
- সেইটা চেষ্টা করা লাগবে না খুব একটা।
- আচ্ছা যদি ছ্যাঁকা না খাই?
- তাইলে প্রেমটা তো হইল। সেটাই বা কয়জনের হয়।
অকাট্য যুক্তি। 

শুরু হল আমার সাহিত্য যাত্রা শুরুর অনুপ্রেরণা খোঁজার পালা।
না যতটা ভাবছেন অতটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ অনেকদিন থেকেই  যাকে বলবো বলবো ভাবছিলাম সেই সাদিয়াকে এবারে বলে ফেলার একটা দারুণ উপলক্ষ পাওয়া গেল। এমনিতে যেমন বুক দুরু দুরু গলা শুখু শুখু ব্যাপার থাকে এখন সেটা যেন কিছুটা কম। কারণ এখন জবাব টা 'না' হলেই বরং বাংলা সাহিত্যের জন্যে একটা বিরাট সুসংবাদ। দিনক্ষণ ও কিভাবে কী ইত্যাদি সব বাতলে দিল আমার এক বন্ধু, (যার এ পর্যন্ত মোট বান্ধবীর সংখ্যা ১৩)। তার কিছু টিপস এখানে তুলে দেই-

১। চোখে তাকাবি না, তাইলে তোর যে ব্যাক্তিত্ব নাই, আর একটা চিপা ছাগলা ক্যারেক্টার আছে সেটা আরো বেশি বোঝা যাবে। বেস্ট হয় সানগ্লাস পরে যাওয়া।
২। কোন সময় দেয়া যাবে না, বাইনারি সিস্টেমে রাজী আছো কি নাই- এই রকম একটা হ্যাঁ- না প্রশ্ন। সময় দিলেই মেয়েটা অনেক বাস্তব চিন্তা করবে আর বাস্তব চিন্তা করলেই সে তোর সাথে ঝোলার কোন যুক্তি পাবে না।
৩। বেশি কাঁদো কাঁদো ভাব দেখানো যাবে না, ভাব দেখাতে হবে আমার আরো বেশকিছু অপশন আছে, লিস্টে প্রথমে তুমি, রাজী থাকলে বলো, না থাকলে আমি পরেরজনের কাছে যাচ্ছি। ভদ্রতা করে লিস্টের শুরু থেকে শুরু করেছি।

এরকম আরো গোটা দশেক উপদেশ। আমার যেহেতু লক্ষ্য মহৎ ও কালজয়ী কিছু তাই আমি এগুলোর সব গুলির ঠিক উল্টোটাই মনে মনে ঠিক করে নিলাম। এবং শরতের এক বিকেলে ক্যাজুয়াল একটা আড্ডার পরে চোখে চোখ রেখে, কাঁদো কাঁদো হয়ে প্রেমের প্রস্তাব ফেঁদে বসলাম সাদিয়ার কাছে। যেহতু পৃথিবীতে এই প্রথম একটা প্রেমের প্রস্তাবের অন্যতম উদ্দেশ্য মহৎ সাহিত্য সুতরাং সেটা একটু বেশি নাটুকে হয়ে গেছিল সন্দেহ নাই।
অবশ্যই আপনাদের মনে হচ্ছে উত্তরে সাদিয়া কী বলেছিল?
উত্তরটা অন্যভাবে দেই।
কেউ কি আমার কোন উপন্যাস পড়েছেন? কালজয়ী? বা অন্য কিছু ছোটখাট কিছু জয়ী? না?
হুম। এটাই।
এটাই আমার উপন্যাসটা আজো লিখতে না পারার তিন নম্বর এবং যাকে বলে লাস্ট বাট নট দা লিস্ট কারণ। 
এখনো মাঝে মাঝে অলস সন্ধ্যায় আমাদের মেয়ে লিয়া কে নিয়ে যখন ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে নতুন এনিমেটেড ফিল্ম দেখি তখন হঠাত সাদিয়া বলে ওঠে-
অ্যাই, তুমি না আগে লেখালেখি করতে? একটা উপন্যাস না লিখবে বলেছিলে? লেখো না কেন? 
আমি হাসিমুখে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে বলি- 
না থাক, কী বলি তা আর না-ই বা শুনলেন।

Friday, November 11, 2022

আশ্রম

এটাই ভালো হয়েছে কী বল?

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সাদিয়া বলল

মাঝে মাঝেই আম্মুকে এখানে দেখতে আসতে পারবো।

হুম। কী উত্তর দেব জানি না, ভাল হয়েছে এটা বলাও কেমন আবার- না চল ওনাকে নিয়ে যাই এটাও বলা যাচ্ছে না।

আম্মু সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে খুব পছন্দ করতো, খুব সোশাল ছিলো। এখানেও কত মানুষ তাই না?

হুম। আবার একই উত্তর দিলাম। উত্তর বা ঠেক দেয়া একটা শব্দ। কী করা যায় না বুঝলে আমরা যেই রকম করি আরকি। মেসেঞ্জার বা এস এম এস এ সেটা ইংরেজীতে মাঝে মাঝেই Hm হয়ে যায়।

চারদিকে অনেক গাছ। আর ঢাকার মধ্যেই, তাই না? ভাব যদি তাকে ঢাকার বাইরে রেখে আসতাম?

এটাই ভাল হয়েছে, আমিও এবার চায়ে চুমুক দিলাম।

আমার মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে এখানে এসে আম্মুর সাথে একটু শুয়ে থাকি। এটা করা যায় না, না?

হুম।

ভাব এখানেও আম্মু কিন্তু ঘুমিয়েই আছে। হাসপাতালেও যেমন ছিল। আসলে পারথক্য শুধু কথা বলা যাচ্ছে না, আর হাত টা ধরা যাচ্ছে না, আর দেখা যাচ্ছে না, আর... বলতে বলতে সাদিয়া আবার কাঁদতে লাগলো।

আজিমপুর কবরস্থানে আমাদের আম্মুকে রেখে যতবার ই আসি, প্রতিবার ই এরকম হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আস্তে আস্তে সয়ে যাবে, কিন্তু যায় না। এই ভয়াবহ ব্যস্ত শহরের মধ্যে একেবারে হঠাত সমতল নিশ্চুপ গোরস্তানে যেন কত বছরের কত মানুষের হাহাকার জমে আছে, কত মানুষ ছিল কিন্তু স্রেফ নেই হয়ে এখানে আছে, বা হয়ত এখানে নেই, হয়ত কোথাও নেই। কে জানে? কিন্তু কি আশ্চর্য করুণ সুন্দর জায়গাটা। সারি সারি সাদা সাইনবোর্ড, কত হাজার হাজার মৃত মানুষের নাম। কত তাদের ঠিকানা, চুনকুটিয়া, কেরানীগঞ্জ, চানখারপুল, নারায়ণগঞ্জ, আরমানীটোলা, মোহাম্মদপুর। সে সব ছাপিয়ে উঠে গেছে থোড়াই কেয়ার করা কিছু অশ্বত্থ, জারুল আর কদম। সেখানে ডাকছে বুলবুলি, ফিঙ্গে, শালিক।

ফিরতে ফিরতে আমারো তাই মনে হল।

মা কে  হয়ত এখানে রাখাই ভাল হয়েছে।