Thursday, April 29, 2021

অভূতপূর্ব

 – আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?

প্রশ্নটা শুনে কৌতুহলী হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম, প্রৌঢ় গড়নের, কিন্তু বেশ শক্ত পোক্ত, মাথায় বেরেটা ধরনের একটা ক্যাপ, চোখে গোল চশমা। চোখ দুটো কিন্তু ঝকঝকে কিশোরসুলভ। এরকম আচমকা অচেনা কাউকে প্রায় মধ্যরাতে বলা নেই কওয়া নাই পুরোনো দুর্বল বাংলা ভূতের গল্পের শুরুর মত প্রশ্ন করে বসা মানুষটা কেমন হবে তা ভেবে বের করতে পারলাম না। সাধারণত পুরোনো এই ধরনের ভূতের গল্পের শেষে দেখা যায় যে জিজ্ঞেস করেছে সেই শেষে ভূত বলে প্রমাণিত হয়, বাতাসে মিলিয়ে যায় বা হাহাহাহা ধরনের একটা ভৌতিক হাসি দিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু এইখানে এই আলোকিত যাত্রী বোঝাই লঞ্চে সেটা কিভাবে হবে বুঝতে পারছি না। যাই হোক, উটকো ঝামেলা এড়াতে ছোট করে জবাব দেব ভেবেও পরে আবার বললাম-

– নির্ভর করে আপনি ভূত বলতে কী বোঝেন তার উপর। শুনে ভদ্রলোক মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন।

– ভেরি ক্লেভার এনসার।

আলোচনা আর এগোবে কি না বুঝতে পারছি না, ভদ্রলোকের দিকে ভাল করে লক্ষ করলাম, তাঁর হাতে একটা বনেদী ঘরানার পুরোনো আমলের লাঠি। লাঠির মাথায় অদ্ভূত করে খোদাই করা একটা কালো চিতার মাথা। লোকটা স¤পর্কে আগ্রহ জন্মালো, আর এই মাঝরাতে, যেখানে আমাদের সুন্দরবনগামি পিকনিক লঞ্চটি একটা ডুবো চরে আটকা পড়ে আছে সুন্দরবনের থেকে মাত্র কিলো খানিক দূরে, সেখানে অচেনা একটা লোকের সাথে আড্ডা দেয়াই যায়। আলাপ টানার জন্যে তাই বললাম-

– আপনি?

– কী?

– ভূত বিশ্বাস করেন কিনা?

– করি। একটু থেমে আবার বললেন- আমি ভূত বলতে যা বুঝি আরকি, সেটা বিশ্বাস করি।

– আপনি কী বিশ্বাস করেন?

– সেটা বলছি, তার আগে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন কিনা, যে আজকে বাইরের আবহাওয়াটা একটু অদ্ভূত?

আমি বাইরে তাকালাম, আসলেই একটু কেমন যেন অদ্ভূত ধরনের আলো এই রাতের বেলা, চারিদিক শুনশান, কালচে নীল ধরনের একটা আলোর মধ্যে দূরে হালকা এক পোচ বেশি গাঢ় আরেকটা রেখা দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনের তটরেখা, আমাদের বিরাট সাইজের লঞ্চটা যেখানে আটকা সেটা একটা হঠাত জেগে ওঠা চর। জোয়ারের সময় সেটা যখন প্রায় জেগে উঠছিলো তখন আমাদের লঞ্চ সেটার ওপর দিয়ে যাবার সময় আটকে গেছে। আমাদের এই লঞ্চটা মুলতঃ বরিশালের দিকে যাতায়াত করে, খরচ কমাতে আমাদের পিকনিকের আয়োজকরা সদরঘাট থেকে তাকে চুক্তিতে নিয়ে এসেছে, সারেং আগে দাবী করেছিলো সে বাংলাদেশের সবই চেনে, এখন বোঝা যাচ্ছে সুন্দরবনের খাল তস্য খালে ভরা অদ্ভূত জটিল এই জায়গার কিছুই সে আসলে চেনে না, আর আমার ধারনা এই চরটা কোন ম্যাপেও নেই। সম্প্রতি পড়েছিলাম বাংলাদেশের দক্ষিণে নাকি আরো পলি পড়ছে, জেগে উঠছে নতুন নতুন চর।

– না তেমন অদ্ভুত লাগছে না, ভদ্রলোকের দিকে ঘুরে বললাম। খালি আলোটা একটু অন্যরককম।

– এগজ্যাক্টলি- চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আজকে ব্লু মুন।

চাঁদের দিকে তাকালাম। সেটা স্বাভাবিকের চাইতে একটু বড় মনে হল। কিন্তু ব্লু নয়।

– জানি কী ভাবছেন, না ব্লু মুন মানে চাঁদ নীল হয়ে যাবে তা না, ব্লু মুনে-বাই দ্যা ওয়ে আমি সাদী, সাদী হক।

ভদ্রলোক সম্ভবত ইউরোপ বা আমেরিকায় ছিলেন বেশ কিছু দিন, বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করে এভাবে পরিচয় আমরা দেই না, আমরা আগেই পরিচিত হয়ে নেই।

– আমি জুবেরী, আব্দুল্লা জুবেরী। সকালের কন্ঠে ফিচার স¤পাদক। এই ইভেন্টটা কাভার করতে এসেছি।

– জানি। ছোট্ট করে জবাব দিলেন সাদী হক।

কিভাবে জানেন জিজ্ঞেস করার আগেই পেছন থেকে ডাক শোনা গেল-

– আরে, জুবেরী ভাই আপনি এখানে? আমাদের মূল আয়োজক সব কাজের কাজী মুনির ভাই চলে এসেছেন।- চলেন চলেন ছাদে চলেন, সবাই মিলে গান গাওয়ার একটা প্ল্যান হয়েছে, রাতটা কাটাতে হবে তো। সাদী ভাই আপনিও আসুন।

– না আপনারা যান, তবে এই নিস্তব্ধ পরিবেশে জঙ্গলের কাছাকাছি গান না গাওয়াই ভালো। পশুপাখিদের আবাসে এসেছি ওদের বিরক্ত না করি।

– ঠিক ঠিক, ঠিক বলেছেন, আচ্ছা আমি ক্যানসেল করে দিচ্ছি, বলেই রওনা দিচ্ছিলেন মুনির ভাই, সাদী হক আবার থামালেন তাকে,

– না ক্যান্সেল করার দরকার নেই, এই এখানে ইঞ্জিন রুমের পাশে গান চলতে পারে, রক এন রোল না করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলতে পারে।

– জ্বী জ্বী ভাল বলেছেন, আমি আসছি।

মুনির ভাই চলে যেতেই সাদী হকের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম,

– ইয়ে আপনি কি করেন বললেন না তো?

– আমি? শুনে ঘাবড়ে যাবেন না যেন। আমি ভূত ধরি।

এবার নিশ্চিত হলাম ব্যাটা রগড় করছে আমাকে পেয়ে।

– হাহাহা, না আসলে মজা করে বললাম। আমি প্রাণিবিদ্যায় পড়াশোনা করেছি, বাইরে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম, এর পরে ইচ্ছে হল দুনিয়া ঘুরে দেখি, ভ্রমণ করতে করতে অকাল্ট বিদ্যায় বেশ একটা আগ্রহ জন্মে গেল, অকাল্ট মানে হল আধিভৌতিক সব জিনিসপত্র আর কি, আসলে আফ্রিকার কয়েকটা দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় এত দুর্দান্ত সব জিনিস দেখেছি, সেখান থেকেই আগ্রহ। মনে হল পৃথিবীর কত কিছুই আমরা মানুষেরা এমন কি জানিও না কিন্তু মনে করে নেই আমরা সব জেনে বসে আছি। এইসব জানার ফাঁকে ফাঁকে এই ভৌতিক ধরনের কয়েকটা রহস্যের সমাধান করতেই-

এবারে আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

– আচ্ছা আপনি কি নিহিলিন ক্লাবের সেই সাদী হক?!

– হ্যাঁ, ওই আর কি।

– ওহ্, সরি আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

– না না, এটা তো শুনেই চিনে ফেলার মত কিছু না। যাই হোক তাহলে তো একটা ধারনা পেলেন আমি কী করি। তো আমরা আবার আগের প্রসঙ্গে ফেরত যাই।

এই সময় হঠাত পাশে গান শুরু হল, সবাই মিলে কোরাসে, একদল ঘুরতে আসা বাচ্চাকাচ্চা সাথে কয়েকজন বয়স্ক গোছের শখের ট্যুরিস্ট ধরনের ভদ্রমহিলা। সবাই একসাথেই এই ট্যুরে রওনা দিয়ে এখানে আটকে আছি, বিপদে পড়লে মানুষ যেমন খুব দ্রুত কাছাকাছি চলে আসে, সেরকম এই লঞ্চের সবাই সবার সাথে একটু আপন আপন হয়ে গেছি। মুনির ভাই গানের আড্ডার কোণা থেকে উত্তেজিত ভাবে আমাদের দুজনকে হাতের ইশারায় ডাকতে লাগলেন, প্রথম গান শুরু হল-আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে।
সাদী হক দেখলাম বিনীত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনার মত হাতজোড় করে সেটা কাটালেন, আর আমাকে আস্তে করে বললেন-

– চলুন আমরা ছাদে যাই।

এখন আর কোনভাবেই তাঁকে হাতছাড়া করতে চাইছি না, নিহিলিন ক্লাবের সাদী হককে এতক্ষণ চিনি নি বলে লজ্জ্বা লাগছে। বেশ কিছু ভৌতিক রহস্যের দুর্দান্ত সমাধান করে উনি মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেছেন। এই তো ক’দিন আগে পুরান ঢাকায় নরবানর রহস্য- মানে বানরের মত কিছু একটা সব বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলো, সেটার একটা সমাধান করে ওনার নাম বিভিন্ন জায়গায় এসেছে, আমাদের পত্রিকাতেও অপু এর উপরেই একটা রিপোর্ট ছাপিয়েছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আমিও এ ধরনের এক্সক্লুসিভ কোন গল্প আজ পেয়ে যেতে পারি। ছাদে উঠে বসে নিলাম ভালমত চাদর টাদর পেঁচিয়ে, নভেম্বারের শেষের দিকে ঢাকায় তেমন শীত না থাকলেও এটা সুন্দরবনের নদী। জেঁকে আসছে হিম।

– যা বলছিলাম, আমি ভূত বিশ্বাস করি। শব্দার্থে বললে ভূত মানে যা আগে ছিলো এখন নেই, মানে অন্য অর্থে মারা গেছে এমন আত্মাকে যদি আবার দেখতে পাওয়া যায় তবেই তাকে বলে ভূত। কিন্তু আমি ভূত বলতে বুঝি অভূতপূর্ব কিছু, মানে উল্টোটা। যা আগে ঘটেনি, বা বলতে পারেন মানুষের অভিজ্ঞতায় নেই, মনে করুন তো চুম্বক পাথর যখন আবিষ্কার হল, মানে মানুষ যখন জানল এরকম একটা পাথর আছে যা লোহাকে আকর্ষণ করে সেটা জানার আগে যদি আপনি মানে ধরে নিন আপনি মেষ চড়ান, হাতে একটা লাঠির মাথায় লোহার আঁকশি, সেটা একটা পাথরের গায়ে রেখে দুপুরে মেষগুলি ছেড়ে দিয়ে ঘুম দিলেন, উঠে বসে দেখলেন সেটা পাথরে লেগে আছে ছোটাতে গিয়ে দেখলেন আপনার গলার লোহার চেইনটাও সেই পাথরের দিকে চলে যাচ্ছে আপনা আপনি। আপনি ছুটে গ্রামে এসে বললেন একটা ভূত এই কাজ করছে। কোন অশুভ আত্মা। আপনার কথা কিন্তু একই সাথে সত্যি আবার সত্যি না।

– বুঝতে পেরেছি।

– মানে আপনি যা ব্যাখ্যা করতে পারছেন না সেটাই আপনার কাছে ম্যাজিক, বা আরেকটু কম যুক্তিবাদী হলে বলবেন ভূতুড়ে।

– রাইট।

– আমার অভিজ্ঞতায় আমি এরকমই বেশী পেয়েছি, যেমন যেই প্রসঙ্গে আজকে আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে আপনি ভূত বিশ্বাস করেন কিনা সেটা আসলে একটা ঘটনা মনে পড়ায়, আপনি চাইলে আমি সেটা বলতে পারি।

– অবশ্যই অবশ্যই। বলে অজান্তেই আমার হাত চলে যাচ্ছিল আমার ঝোলা ব্যাগে, আমার মোলাস্কিনের যে খাতাটায় আমি নোটস নেই সবসময়, খেয়াল হল সেটা নিচে রেখে এসেছি।

– ঘটনাটা বেশ আগের, এবং এই সুন্দরবনেরই। আমি তখন মোটামুটি তরুণই বলতে পারেন। সবে ইংল্যান্ডের থেকে পড়াশোনা করে ফিরেছি, ডক্টরেট করতে আবার যাব। তখন আমার বাবার লেখা একটা শিকার কাহিনির পা-ুলিপি নিয়ে এক প্রকাশকের কাছে যাই। আমার বাবা পুরোনো ঢাকার লোক, জমিদারদের মত তারো সেই আগের আমলের ঢাকার জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শিকারের নেশা ছিলো। টঙ্গীর জঙ্গলে তখনকার দিনে তিনি বাঘও মেরেছিলেন। যাই হোক। প্রকাশকের অফিসে তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি বাংলাবাজারের একটা দোকানমত জায়গায় তখন হঠাত প্রকাশক এক ছোটখাট লোক নিয়ে ঢুকলেন, খুবই সাধাসিধা, কিন্তু গড়নে কোথায় যেন একটা খুব অন্য রকমের ব্যাপার আছে, প্রকাশক পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনি করিম গাজী।

– বাঘ শিকারী?

– হ্যাঁ, কিংবদন্তিতূল্য বাঘ শিকারী করিম গাজির সাথে বাংলাবাজারের একটা গলিতে দেখা হয়ে যাবে এটা আমি ভাবিনি, জানেন নিশ্চই, তিনি শুধু মানুষখেকো বাঘদেরই মারতেন। এবং বন বিভাগ থেকে তাঁকে এসাইন করা হত এই কাজে। যাই হোক, লোকটা খুব কম কথা বলে, কিন্তু সব কথারই যেন একাধিক মানে হয়। বাংলাবাজারে তিনি এসেছেন কারণ একটা প্রকাশনী থেকে তাঁর উপরে একটা বই বের করবে সেই কাজে। বইয়ের কাজ প্রায় শেষ, এখানে এই প্রকাশক তাঁকে নিয়ে এসেছেন আরেকটা কাজে, চা খেতে খেতে কথায় কথায় ভদ্রলোক জানালেন অচিরেই তাঁর সুন্দরবনে আরেকট বড় অপারেশনে যাবার কথা আছে, আমিও ছুটিতে আছি, জিজ্ঞেস করলাম আমি প্রানিবিদ্যায় পড়াশোনা করেছি, আমি কি ঘুরতে হলেও তাঁর সাথে যেতে পারি কি না? রাজী হলেন না, বললেন সেটা আমার নিজের মত করে আমি যেতে পারি, কিন্তু কোন অপারেশনে যাওয়া যাবে না। তখনই আবার আমার বাবার প-ুলিপি নিয়ে সেই প্রকাশকের সাথে কথা উঠলে আবার তিনি একটু আগ্রহী হন আমার পূর্বপুরুষদের নিয়ে। কিন্তুপরেই যখন শুনলেন আমি নিজে কঙ্গো ফরেস্টে একটা শিকার টিমের সাথে ছিলাম ও বেশ কিছু বাইসন ও চিতা শিকার করেছি আর যখন শুনলেন আমার কয়েক পুরুষই শিকারী তখন আবার একটু নরম হলেন। বললেন একসাথে যাওয়া যেতে পারে, তবে শিকারে হয়ত নেয়া হবে না, আমি তাতেই রাজী। যেতে যেতে অন্তত তাঁর কিছু গল্প তো শোনা যাবে? – দাঁড়ান, আমি একটু চা বলি, আপনি মনে হচ্ছে একটু বোর হচ্ছেন।

– আরে নানা, কী যে বলেন। চা পরে খাব আপনি বলুন।

– তো আমার আগ্রহের কারণে আর আমার বাবার শিকার কাহিনীর কিছু অংশ শুনে তিনি রাজী হলেন, আমার বাসাতেও তাঁকে নিয়ে গেলাম। সেখানে আমাদের ব্যক্তিগত একটা কালেশন মিউজিয়াম আছে জানেন বোধহয়? সেটা দেখে তিনি খুবই চমৎকৃত হলেন। আমার নিজের শিকারের ছবিও দেখালাম। দেখে টেখে বললেন যেতে হলে পরদিনই আমাদের রওনা দিতে হবে, এবং আমি যেন সাথে করে শিকারে যা যা লাগে তার সবই নেই। তার মানে কি সুন্দরবনের তাঁর সাথে শিকারে যাওয়া হবে? কি জানি। ভীষণ

সাদী হকের কথার এই পর্যায়ে হঠাত দূরে কিছু একটা ডেকে উঠলো, অজান্তেই আমি কিছুটা শিউরে উঠেই আবার ধাতস্থ হলাম। লক্ষ্য করে সাদী হক বললেন-

– হাহা, ভয় লাগলে লজ্জ্বা পাবেন না, করিম সাহেব বলতেন জঙ্গলে এসে বাঘের সামনে পড়ে বা তার রাজ্যে এসে যে তাদের ভয় পায় না, তারা হয় মিথ্যেবাদী নয় পাগল। আর আমরা তো এই মুহূর্তে বাঘের বাড়ির উঠোনে আটকা পড়ে আছি। যাই হোক, তো আমরা সেই সরণখোলার কানাইনগর বলে একটা জায়গার কাছে ‘দায়লা’ নামের গ্রামে চলে এলাম, প্রায় একদিনের পথ পেরিয়ে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় সেখানে পৌঁছুলাম। গ্রাম বলতে নামেই গ্রাম, আসলে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন কুঁড়ে, গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। এদের সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পৃথিবীর অন্যতম ভয়ানক জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গলের আবাসের কাছে এরা এভাবে কয়েকটা গোলপাতার ছাউনি দিয়ে বাসা করে আছে শুধু মধু সংগ্রহ করবে বলে। বাঘ যে সবাইকে নিয়ে যায়নি সেটাই আশ্চর্য। গ্রামের মুরুব্বী গোছের এক মৌয়াল- নাম ভুলে গেছি এখন- সে দেখাল যেই কুঁড়েটা থেকে বাঘ দুইজনকে নিয়ে গেছে সেটা। করিম সাহেব তাঁর দক্ষ চোখে পাগমার্ক -মানে বাঘের পায়ের ছাপ।

– জ্বী জানি আমি।

– ও সরি, হ্যাঁ, পাগমার্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। সমস্যা হচ্ছে বাঘটা এসেছিলো শুকনোর সময়ে কিন্তু এরপর একবার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভদ্রলোকের দক্ষতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম ঠিকই তিনি কিছু নমুনা বের করে ফেললেন। বললেন, একটাই বাঘ সম্ভবত, আর সেটা আকারে অনেক বড়, ছাপ দেখে মনেহচ্ছে মাদী আর লম্বার প্রায় বারো ফুট! আমার মনে হল এত বড় হবে না, বৃষ্টির পানিতে হয়ত মার্ক অমন হয়ে গেছে, কিন্তু করিম সাহেব একটা সুক্ষ্ম ছাপ দেখিয়ে বোঝালেন অতটা গর্ত হতে হলে বাঘের ওজন কত হতে পারে, আর সেটা হতে হলে তার দৈর্ঘ্য ওরকমই দাঁড়ায়। যদি সত্যি তাই হয় তবে তো ভয়ানক ব্যাপার, সত্যি বলতে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আফ্রিকায় হাতির পিঠে বসে বা গাছের ওপরে মাচা করে বিট ফেলে পরে øাইপার রাইফেলে প্রাণি শিকার এক জিনিস, কিন্তু এ তো ভয়ানক ব্যাপার। ওদিকে আগে অনেক কিছু বলে নিয়ে এখন করিম সাহেবের সামনে ভয় পাচ্ছি সেটা দেখানো যাচ্ছে না। যাই হোক, কথা হল পরদিন সকালে আমরা রোঁদে বের হব। কিভাবে যাওয়া হবে আর গ্রামের কয়জন সাথে যাবে এই আলোচনা যখন করা শুরু করলাম ঠিক তখনই ঘটল একটা অদ্ভূত ঘটনা।

বলে সাদী হক দম নিলেন। আমি এইবার নড়েচড়ে বসলাম, সাদী হক ফাইনালি ভূতের কথা শুরু করেছেন, গল্পটা বেশ জমে উঠেছে, নীচে চলছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, আকাশে নীল চাঁদ, ওদিকে সুন্দরবন। যাকে বলে মোক্ষম পরিবেশ।

– হ্যাঁ, হঠাত একটা কুঁড়ের দাওয়া থেকে এক খোনা গলা বলে উঠলো- আপনারা যাবেন না! ওকে বনবিবি নিয়ে গেছে।

– আমরা তাকিয়ে দেখি অন্ধকারে প্রায় দেখাই যায় না এমন একটা জায়গা থেকে কাঁথা কম্বলের একটা স্তুপ থেকে কে কথা বলছে। সেই গ্রামের প্রধান লোকটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-

– ও আমার মা, ওর কথা ধরবেন না।

এই দুর্গম স্থানে মাকে সহ এসেছে দেখে একটু অবাক হলাম, মৌয়ালরা সাধারণত এইসব গ্রাম বানায় অল্প কয়েক মাসের জন্য। সেখানে পরিবারের অন্য কারো থাকার কথা না। পরে অবশ্য কারণটা জেনেছিলাম, যে এই মহিলা খুব ভালো কবিরাজ, মাঝে মাঝেই মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির হুলে মৌয়ালরা কাবু হ্যে যায় তখন জঙ্গলের লতাপাতা দিয়ে সেগুলি সারিয়ে তুলতে এই মহিলার জুড়ি নেই। প্রধান যাই বলুক না কেন ততক্ষণে সেই খোনা গলার বৃদ্ধা বলা শুরু করেছেন যে এই দুজন নাকি বদ লোক ছিলো, বনের অনিষ্ট থামাতে বনবিবি তাঁর বাঘ পাঠিয়ে এদের তুলে নিয়ে গেছে, সে নাকি নিজের চোখে দেখেছে, নীল রঙের বিরাট এক বাঘ, আর দূরে বনবিবির আলো। এর উত্তরে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না, দেখুন শহরে বসে দিনের আলোয় নিজেদের অনেক যুক্তিবাদী মনে হয় কিন্তু ওরকম একটা জায়গায়-

– জ্বী আমি এখনই টের পাচ্ছি, বলতে হবে না। সাদী হককে থামিয়ে দিয়ে বললাম।

– তো আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলাম না। করিম সাহেব কিন্তু নির্লিপ্ত। রাতে খাবার সময় তাঁকে একথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন- হ্যাঁ এটাও হতে পারে, সে ক্ষেত্রে আমরা আবার ফিরে যাব। বুঝুন! আমি সবে ইংল্যান্ডের এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটিতে আমার থিসিস পেপার জমা দিয়ে এসেছি ইভোলিউশনের একটা ক্রিটিক করে, আর এদিকে এই মৌয়ালদের গ্রামে এসে শুনতে হচ্ছে এক বনদেবী নাকি তাঁর পোষা বাঘ দিয়ে দুইজনকে তুলে নিয়ে গেছে কারণ তারা দুষ্ট প্রকৃতির। খুবই অস্বস্তির একটা রাত কাটলো।

– পরদিন সকাল থেকেই আকাশ ঘন কালো মেঘলা, দুর্যোগের আশংকায় বের হওয়া ঠক হবে কিনা ভাবার আগেই করিম সাহেব তৈরী হওয়া শুরু করলেন। এরপরে আবার বৃষ্টি নামলে যা চিহ্ন আছে তার কিছুই মিলবে না। আর দিনের আলো এখনো যট্টুকু আছে তা ব্যবহার করতে হবে। সব দ্বিধা ঝেড়ে আমার রাইফেলটা নিয়ে রওনা দিলাম। ওদিকে পেছন থেকে সেই বুড়ি আবার খোনা গলায় আমাদের মানা করতে লাগল। সেটা পাত্তা দিলে নিজেদের শিকারী হিসেবে সম্মান থাকে না। ভালো কথা এর মধ্যে সেই দুইজনকে নিয়ে করিম সাহেব একটু খোঁজ খবর করেছিলেন, জানা গেল এরা দুইজন মামাতো-ফুপাতো ভাই। আগে মংলা পোর্টে নাকি চোরাচালানের কাজ কর্ম করত, মানে অতীত খুব একটা সুবিধার না। পরে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে সুন্দরবনের গভীরে এসে আত্মগোপন করে, মাঝে নাকি একদল ডাকাতের সাথেও জুটেছিল। আর এখন মধু সংগ্রহের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেত জঙ্গলের মাঝে। মানে আগে থেকেই বেশ সন্দেহজনক চরিত্র। যাই হোক তা ভেবে এখন আর কোন লাভ নেই, তারা কেউই নেই, আমরা বরং তাদের মরদেহের কিছু অংশ উদ্ধার করতে পারলে কবর দিয়ে দেব। আমরা এবার শেলা নদীকে হাতের ডানে রেখে হাঁটতে লাগলাম, আমার হান্টার বুট ভেদ করে সুন্দরবনের বিখ্যাত শ্বাসমূল খোঁচা মারছে, এর মাঝে করিম সাহেব দেখি খালি পায়ে হাঁটছে! যাই হোক, নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে মানুষখেকো বাঘের পিছনে ট্রেক করা গল্পে পড়ে যতটা রোমাঞ্চকর লাগে বাস্তবে সেরকম না। চারিদিক খুব স্বাভাবিক, পাখি ডাকছে, প্রজাপতি উড়ছে, নদীর তীরে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে কুমির হাঁ করে বসে আছে। করিম সাহেব কিন্তু এই সব থেকেই কী যেন একটা বোঝার চেষ্টা করছেন, ধীরে ধীরে একট ঘণ গেওয়া গাছের ঘেরে কাছাকাছি এসে তিনি হঠাত হাত তুলে থামতে বললেন, সামনে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে আমার, হাতে বাগিয়ে ধরেছি রাইফেলটা। খসখস একটা শব্দ হচ্ছে সামনের ঝোঁপে, বন্দুক বাগিয়ে যোগীর চোখে স্থির সামনে তাকিয়ে করিম সাহেব, আমিও চুপ।

টুপ করে এসময়ে ঝোঁপ ছেড়ে সামনে এলো একটা রোগা পটকা বাঘের বাচ্চা, রয়েল বেঙ্গলের! দেখেই আদর করতে ইচ্ছে করে এমন, কিন্তু সেটা দেখেই আতংকে যেন সিঁটিয়ে উঠলেন করিম সাহেব। প্রবলভাবে হাত নাড়তে নাড়তে আমাকে পেছাতে বললেন, যতটা সম্ভব পিছিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন- বাঘিনী, তাও আবার বাচ্চা সহ বাঘিনী সব থেকে ভয়ানক। বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে ভাবলে যে কাউকেই নিমেষে শেষ করে দেবে সে। সুতরাং আপাতত কেটে পড়াই ভাল। আমিও রাজী, মনে মনে খুশী-ই। কিন্তু ফিরতি পথে রওনা দেবার আগেই করিম সাহেব আবার ইশারা করে থামতে বললেন। কান পেতে কী একটা শুনে নদীর পাড়ের দিকে এগোলেন। উঁচু হয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে আমাকে ডাকলেন। হ্যাঁ আমিও টের পেলাম, কাদের যেন কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছি। এবং আমার ভুল না হলে একটা গলা আইরিশ ইংরেজীতে! অবাক হয়ে সামনে আরেকটু এগিয়ে দেখি সামনের যে খালটা নদী থেকে এসে এইদিক পর্যন্ত ঢুকেছে তার মাঝামাঝি একটা চিকন নৌকা বাঁধা, তার ওপরে বেশ কায়দা করে একটা ঘর মত বাঁধা তার সামনে একটা চেয়ারে করে এক বৃটিশ সাহেব, নৌকায় আরো দুইজন আছে, তাদের গড়ন বেশ শক্তপোক্ত, তবে তারা স্থানীয়। সাহেব কিছু একটা বলে এদের রীতিমত ধমকাচ্ছে। আমি আরেকটু ভালমত খেয়াল করে শুনলাম, ছাড়া ছাড়া কথায় যা বোঝা গেল তাতে একই সাথে অবাক হলাম এবং একই সাথে বেশ রেগে গেলাম। সাহেব আসলে পোচার মানে চোরাশিকারী। সুন্দরবনে এসেছে রয়েল বেঙ্গলে বাঘের চামড়া সংগ্রহ করতে! এবং সামনেই একটা বাঘ মরে পড়ে আছে, সেটার চামড়া ছাড়াতে ওই দুইজনকে আদেশ দিচ্ছে কিন্তু তারা তা মানছে না। কারণ আগের দুইজন নাকি মারা গেছে এভাবেই, বিদ্যুতগতিতে মাথায় খেলে গেল দুইজন? সেই মৌয়াল দুইজন না তো? করিম সাহেবকে সে কথা বলতেই ভয়ানক রেগে গেলেন। মানুষখেকো বাঘের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে তিনি বাঘ মারেন বটে কিন্তু কিন্তু অপ্রয়োজনে বা চামড়া বিক্রির জন্যে প্রাণীহত্যা তাঁর কাছে ভয়ানক অপরাধ, বললেন বন বিভাগের পক্ষ থেকে তিনি এখনি এই সাহেবকে গ্রেফতার করতে চান, আমি থামালাম, প্রমাণ ছাড়া ধরতে গেলে উলটো বিপদে পড়তে হবে, তারচেয়ে দেখা যাক আদৌ যা ভেবেছি তা-ই কি না। ওদিকে সাহেব ধীরে ধীরে আরো উত্তেজিত হয়ে রীতিমত মারতে তেড়ে যাচ্ছেন অন্য দুইজনকে, তারা এবার তাকে কিছু একটা বল্ল। সাহেব একটু থেমে নৌকার উপরের ঘরটায় গিয়ে ঢুকলো, মিনিট পাঁচেক পরে আবার শিকারের সাজে বের হয়ে এল। বুঝলাম নৌকার দুইজন নিশ্চই শর্ত দিয়েছে সাহেবকেও যেতে হবে সাথে। করিম সাহেবকে ইশারা করলাম এদের অনুসরণ করতে, হাতে নাতে বাঘের চামড়া ছাড়ানোর চেষ্টা করার সময় এদের ধরতে হবে। উনিও রাজী। এদিকে আকাশ কালো করে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে জঙ্গলে। সে এক গা ছম ছমে অনুভ’তি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো ওই যে বাচ্চাটা দেখলাম তার মাকেই এদের লোকেরা হত্যা করেছে। ভেবে ভয়ানক মেজাজ খারাপ লাগলো। যাই হোক, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাহেব আর তার দুই সহকারীকে দেখলাম, সাহেবও মনে হল ভয় পাচ্ছে। আর আমরা দুজন রাগের কারণে ভয়টা টের পাচ্ছি না, খালি সুযোগ খুঁজছি কখন তাদের ধরব। হঠাত তারা চোখে সামনে থেকে হারিয়ে গেল, গতি বাড়িয়ে সামনে এগোতেই আমরা আবার সেই আগের জায়গায়, মানে যেখানে বাঘের ছানাটা দেখেছিলাম সেখানে পৌঁছে গেলাম। আরেকটু এগোতেই সাহেবের গলার আওয়াজ পেলাম,

– গট ইট, ইউ …স, নাউ পিইল ইট, হারি

যা ভেবেছিলাম, সে এক করুণ দৃশ্য, একটা রয়াল বেঙ্গল বাঘ মরে পড়ে আছে, ভালোই লম্বা বাঘটা, তার চারদিকে অসহায়ের মত কুঁই কুঁই করছে দুটো রুগ্ন বাচ্চা, মা কেন উঠছেনা তা বুঝছে না তারা। আর এর মধ্যে সেই সাহেবের নির্দেশে সাথের দুইজন ছুরি বের করে বাহঘের দিকে এগিয়ে গেল, দেখে আর সহ্য হলো না, বন্দুক বাগিয়ে এগোতে লাগলাম, চিতকার করে তাদের থামতে বলব ও সারেন্ডার করতে বল থিক এমন সময় ঘটলো ঘটনাটা- আকাশ এমনিতেই বেশ কালো হয়ে ছিলো, হুট করে যেন একেবারে সন্ধ্যার ঘন কালো নেমে এলো এবার। আর বাঘটা যেখানে পড়ে ছিলো তার পেছন দিকে যে একট ঢিবি মতন জায়গা ছিলো সেটার পেছন থেকে একটা অদ্ভূত নীলচে আলো দেখা গেল। সেটা করিম সাহেবকে দেখাতে যাব তার আগেই চারদিক কাঁপিয়ে একটা বাঘের গর্জন শোনা গেল।
সাদী হক একটু থামলেন।

জুবেরী সাহেব, করিম গাজীর সেই বইটা যদি জোগাড় করেন তবে দেখবেন সেখানে বলা আছে যত বড় বীরপরুষই হওনা কেন সুন্দরবনের ভেতরে দাঁড়িয়ে বাঘের ডাক শুনে ভয় পাবে না এমন মানুষের জন্ম হয়নি। সত্যি তাই, তবে আমার জীবনের শোনা কোন গর্জনের সাথে এর তুলনা হয় না, খুব যে জোরে তা-নয়, কিন্তু এমন গম্ভীর আর গাঢ় স্বরে সেটা হল আর মনে হল কোন একটা উৎস থেকে না, গোটা জঙ্গলের থেকেই যেন ডাকটা এল। সাহেব ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আর সাথের দুইজন মুহূর্তের মধ্যে কোথায় দৌড়ে পালালো। আমরা কী করব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম যেন সম্মোহিত হয়ে। সাহেবের পায়ের কাছে বাঘের বাচ্চা দুটো দাঁড়িয়ে, পাশে পড়ে আছে তাদের মায়ের মৃতদেহ আর ওদিকে ঢিবিটার পেছন থেকে নীলচে আলোটা আরে বেড়ে উঠলো, সাহেব এবার আতংকে সেদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া শুরু করলো। করিম সাহেব আমার হাত চেপে ধরে বলল-সাবধান! এবং এরপরেই সেই আলো গায়ে মেখে লাফিয়ে খোলা জায়গাটায় বের হয়ে এল একটা বাঘ। লম্বার ত্রিশ ফুটের কম হবে না! আর সারা গা থেকে নীল আভা বের হচ্ছে ফসফরাসের মত, সাহেব আর গুলি করতে পারলেন না। করিম সাহেব হাঁটু গেড়ে বসে চোখ বুজে বিরবির করে কী একটা বলতে লাগলেন, আমি স্থাণূ হয়ে তাকিয়ে, সেই অপ্রাকৃত বাঘটা খুব ধীরে ধীরে সামনে এলো সাহেবকে একটু শুঁকলো, সাথে সাথেই সাহেব সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল, বাঘটা আবার গর্জন করতেই এবারে পেছন থেকে খুব হালকা একটা গানের মত আওয়াজ শোনা গেল, রিনরিনে কন্ঠে যেন এক কিশোরী গান গাইছে, অদ্ভূত ভাষায়। সেই ঢিবির পেছনে থেকে এবারে বেরিয়ে এল এক কিশোরী। বয়স পনেরো ষোলো হবে, পরনে পুরোনো আমলের মত করে পড়া শাড়ি। চোখ বন্ধ, আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটা আসতেই বাঘটা ঘুরে যেন তার পোষা একটা বেড়াল এভাবে কাছে গিয়ে তার চারদিকে ঘুরতে লাগলো, মেয়েটা তার গায়ে হাত বুলিয়ে পড়ে থাকা সাহেবটার দিকে এবার চোখ খুলে তাকালো, আবার মৃত বাঘটার দিকে তাকালো, মৃত বাঘটার শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বাচ্চা দুটোকে তুলে নিল হাতে, এর পর হেঁটে হেঁটে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে রওনা দিলো। আরো কী হয় দেখতে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে ছিলাম সম্বিত ফিরলো করিম সাহেবের সজোরে হাতে টান খেয়ে উনি চোখ বুঁজে বিরবির করেই যাচ্ছেন আর আমাকে বসে পড়তে বলছেন। বসে পড়তেই হঠাত চারিদিক আবার আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এলো, যেন ভোর হচ্ছে। আরেকটু আলো হতেই করিম সাহেব আমার হাত ধরে টানতে টানতে ফিরে চললেন যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। গ্রামে ঢোকার আগে বললেন যা ঘটেছে কাউকে না বলতে, বলতে যে মরদেহ দুটো আমরা পেয়েছিলাম, সেগুলো গোর দেয়া হয়েছে। আমরা কী দেখলাম সেটা নিয়ে উনি কথা বলতেই রাজী নন। বললেন বিরাট দোয়া ছিলো আমাদের উপরে, যে এখনো বেঁচে আছি। পরে বললেন,

ও-ই বনবিবি। সাথে তার পোষা বাঘ। সেই দক্ষিণ রায়ের সাথে চুক্তির পর থেকে সুন্দরবন এভাবেই পাহারা দিয়ে আসছেন। তাঁকে দেখার ভাগ্য কারো হয় না, হলেও সে বেঁচে ফেরে না। তাই কাউকে বল্লেও সে সেটা বিশ্বাস করবে না। আমি কী জবাব দেব জানি না, কারণ যা ঘটেছে আমি বরং তার চেয়েও বেশী দেখেছি, বিজ্ঞান দিয়ে এর ব্যাখ্যা কী দেব?

– ‘আর সেই সাহেব?’ জানতে চাইলাম।

– হ্যাঁ পরদিন লোকজন নিয়ে আমরা আবার গিয়েছিলাম সেখানে, সাহেব নেই, শুধু সেই নৌকাটা পেলাম, তার ভেতর থেকে উদ্ধার হল সাহেবের পাসপোর্ট, সে আইরিশ লোক। ইন্টারপোলে পরে খোঁজ নিয়েছিলাম, সে মূলত আন্তর্জাতিক পোচার দলের একজন সদস্য, অত বড় কেউ না, তবে তখন ভারত আর বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু পোচিং এর সমন্বয় করছিলো সে। রয়েল বেঙ্গলের চামড়ার লোভে এবারে নিজেই চলে এসেছিলো। ওই মৌয়াল দু’জনকে দিয়ে সে এসব কাজই করাতো। ওই মা বাঘিনীটাকে মারতে গিয়েই সবার কাল হল। যাই হোক, তাই বলছিলাম, আমি ভূত বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার ভূত হল অভূতপূর্ব কিছু। আমি জানি এটা বিশ্বাস করার কিছু নেই, আমি নিজেও পরে অনেক ভেবেছি, কোন ব্যাখ্যা পাইনি, কোন আদিবাসী মেয়ে কি জঙ্গলের কোন বাঘ পোষ মানিয়ে ওখানে থাকে? বাঘটা কি অ্যালবিনো? গায়ে ফসফরাস মেখে তাকে দিয়ে চোরাশিকারীদের মেয়েটা ভয় দেখায়? আবহাওয়ার কারণে সেদিনের লাইটিং কি অন্যরকম ছিলো বলে অপটিক্যাল ইলিউশনে বাঘটাকে অন্যরকম লেগেছে? জানি না।

সাদী হকের কাহিনী শুনে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নিস্তব্ধতা ভাঙতে কিছু একটা বলার উপক্রম করতেই বিকট শব্দে আমাদের লঞ্চের সাইরেনটা বেজে উঠলো। ছুটুতে ছুটতে ছাদে চলে এলেন মুনীর ভাই-

আরে আপনারা এখানে, হাহাহাহা, আমি ভাবলাম বুঝি বাঘে এসে নিয়ে গেছে হাহাহাহা, চলুন আমাদের লঞ্চ ছুটে গেছে, জোয়ারের সময়। আর সকাল হয়ে যাচ্ছে প্রায়, আসুন আসুন।

দু’জনেই উঠে দাঁড়ালাম, কোন কথা না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এই গল্পটা- মানে ঘটনাটা আমি কি লিখতে পারি কোথাও?

অবশ্যই, কিন্তু গল্প হিসেবেই লিখবেন, করিম সাহেবকে কথা দিয়েছিলাম এটা কাউকে বলা হবে না। আর কোথাও ছাপা হলে দয়া করে কপি পাঠিয়ে দেবেন এই ঠিকানায়- বলে তাঁর একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন।

‘তথাস্তু।’ বলে সুন্দরবনের তটরেখার দিয়ে তাকিয়ে রইলাম, ভূত যদি এমন ভাবে আসে তবে বোধহয় বিশ্বাস না করে আর উপায় নেই।

কিশোর আলো

জানুয়ারি, ২০১৯

অজগর স্যার ও চন্দ্রা

মানহাদের বিজ্ঞান স্যার- আজগর সাত্তার- খুবই রাগী ধরনের, বিজ্ঞান পড়ানোর সময় ভয়ংকর কিছু মুখভঙ্গি করে চোখমুখ কুঁচকে কথা বলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ঠোঁট সরু করে জিবটা বারবার সাপের মত করে বের করেন, ফলে তাঁর আরেকটা নাম হয়ে গেছে- অজগর স্যার। তাঁর মূল সমস্যাটা হল তিনি বিজ্ঞানে যা-ই পড়ান, পড়ানোর পরে ক্লাসের সবার দিকে তাকিয়ে বলেন

- ‘এইগুলা ভুয়া কথা। বাইরের বিজ্ঞানীদের বুজরুকি। পরীক্ষার জন্যে পড়তেছো পড়ো, বিশ্বাস করা লাগবে না’। আর কেউ কিছু জানতে চাইলেই উলটা ধমক দেন। বলেন-

- ‘আসছে আমার আইনস্টাইন, বইয়ে যা আছে পড়ো’।

ক্লাসে এখন পেটানো নিষেধ কিন্তু এই স্যার মুখে কথা বলে যা করেন তা পেটানোর চেয়ে কম না।

মানহাদের ক্লাসের কেউই এই স্যারকে দেখতে পারে না, নাফিসা, জিশান, রাবিদ সবাই বিরক্ত। বিজ্ঞান বিষয়টার উপরেই তাদের বিরক্তি এসে গেছে। এইরকম একদিন হঠাত তাদের ক্লাসে নতুন এক মেয়ে ভর্তি হল। মেয়েটা অদ্ভূত ধরনের। ক্লাস ফাইভের যে কারো তুলনায় বেশ ঢ্যাঙ্গা, গায়ের রঙ খয়েরি ধরনের, কান দুটো কেমন বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকে। প্রথমদিন মেয়েটা কারো দিকে তাকালোই না, পুরোটা সময় মুখ  নিচু করে বসে থাকলো। বেশী ভাব নিচ্ছে মনে করে মানহাও পাত্তা না দেবার চেষ্টা করলো। পরেরদিনও একই অবস্থা, তার পরের দিন মানহা ঠিক করলো এই মেয়েকে সে জীবনেও নাম জিজ্ঞেস করবেনা, ঢঙ্গী একটা। কিন্তু সেদিন ক্লাসে ঢুকেই যা ঘটলো!

- সেদিনও অজগর স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন, সেদিন মানুষের চাঁদে অভিযানের কথা পড়াচ্ছিলেন। আর্মস্ট্রং কিভাবে চাঁদে নেমেছেন সেটা পড়ার পড়েই তিনি বইটা বন্ধ করে বললেন

- ‘কী দূর্ভাগ্য যে এইসব বুজরুক আমাদের পোলাপানদের পড়াতে হচ্ছে, চাঁদে কি মানুষ যাইতে পারে? আর এইটা এখন ইন্টারনেটেও প্রমাণ করছে যে চাঁদে আসলে মানুষ যায় নাই। এইসব মিথ্যা-সিথ্যা আমাদের পড়তে হইতেছে আফসোস। তোমরাই বলো, শুন্যে আবার রকেট ওড়ে কিভাবে? সেইখানে বাতাস আছে? এম্নেই তো টূপ কইরে সেটা পড়ে যাবার কথা, কি বলো সবাই?

‘জ্বী স্যার!’ অজগর স্যারের কথার সাথে গলা না মিলালে তার পরিণাম আরো খারাপ হতে পারে।

‘সেটাই, এইগুলা হলিউডে বানানো সিনেমা, তোমরা চাইলে আমার মোবাইলে দেইখা যাইতে পারো, মানুষ ওইভাবে হাল্কা লাফ দিয়া দিয়া হাঁটতে পারে কখনও?’।

জ্বী না স্যার! আবার সবাই বললো। অজগর স্যার হাসিমুখে মাথা নাড়তে নাড়তে ক্লাস শেষ করে দিতে যাচ্ছিলেন সেই সময় ঘটলো ঘটনাটা।

রিনরিনে একটা গলা ভেসে এলো ক্লাসের একেবারে শেষের কোণার দিক থেকে-

‘পারে স্যার’-  সেই নতুন মেয়েটা! বেচারী জানে না কী ভুল করলো!

অজগর স্যার প্রথমে মনে হয় বোঝেন নি, তাই আবার সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি, পারে?’

আবার উত্তর এলো

‘জ্বী’

সবাই দম বন্ধ করে কোণার মেয়েটার দিকে তাকালো, মেয়েটা এই প্রথম চোখ তুলে সোজা তাকিয়েছে।

কী বল্লা তুমি? তুমি ইন্টারনেটের প্রমাণ দেখতে চাও?

না স্যার, ওগুল হোক্স, মানে ফেইক নিউজ, আর ইন্টারনেটের নিউজ বলে কিছু নেই, কোন একটা সাইট থেকে এগুলি ছড়ানো হয়।

মানে? আচ্ছা, তুমি কি মনে কর আমি মিথ্যা বলতেসি? সবাই টের পাচ্ছে অজগর স্যার ভয়ানক রেগে যাচ্ছেন। কোন একটা ছুতোয় নতুন মেয়েটাকে বকার সুযোগ খুঁজছেন।

না, তবে ভুল বলছেন।

মানে??

‘মানে আপনি বিজ্ঞান কী সেটাই বোঝেন না, এবং সেই সাথে বদরাগি, আমাদের আগের স্কুলে হলে আপনাকে টিসি দেয়া হত’।

মানহা আক্ষরিক অর্থে দম বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মেয়েটার সাহস দেখছিলো।

‘স্যারকে টিসি?? হাহাহা!’ অজগর স্যার কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করলেন, আচ্ছা তার মানে তুমি বলতে চাইতেসো রকেট শুণ্যে ভাসে বাতাস ছাড়াই?

‘হ্যাঁ’।

‘মানুষ লাফায়ে লাফায়ে এভাবে ব্যাঙ্গের মত ওড়ে? বলে স্যার খুবই হাস্যকর ভাবে নভোচারীদের লাফ ব্যাংঙ্গ করার চেষ্টা করলেন’।

হ্যাঁ।

‘আর কী পারে? বল্‌’। অজগর স্যার রাগে হাঁফাচ্ছেন।

‘অনেক কিছুই পারে, টেলিকাইনেসিস এখনো আপনারা জানেন না, সেটা জানলে যে কোন অবসস্থাতেই গ্রাভিটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যে কোন মাধ্যমে আপনি ভরশুণ্য হয়ে উড়তে পারবেন’।

‘ফাজিলের ফাজিল, মিথ্যুকের মিথ্যুক। এইটারে উড়া’- বলে অজগর স্যার তার হাতের ডাস্টারটা ছুঁড়ে মারলেন মেয়েটার দিকে। এবং পুরো ক্লাস স্তম্ভিত হয়ে দেখলো সেটা শুণ্যেই ঝুলে ঝুলে আবার স্যারের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লো। স্যার কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থেকে অবাক হবার বদলে এবারে গ্যাঁ গ্যাঁ করতে করতে ছুটে মেয়েটাকে ধরার জন্যে লাফ দিলেন, আর কি আশ্চর্য। স্যার অবিকল নীল আর্মস্ট্রং এর মত হালকা একটা গ্যাস বেলুনের মত ছাদের কাছে পৌঁছে আবার একটা পালকের মত নীচে নেমে এসে ড্রপ খেলেন, এইবারে স্যার ভয় পেলেন। পুরো ক্লাস হঠাত সম্বিত ফিরে পেয়ে চেঁচাতে লাগলো, নাফিশা ফিট হয়ে পড়ে গেল, জিশান কী করবে না বুঝে তালি দেয়া শুরু করলো, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা অজগর স্যারকে নতুন মেয়েটা বল্লো-

‘দেখেছেন? সবই সম্ভব যদি আপনি বিজ্ঞান মানেন, বিজ্ঞান আসলে আনন্দের। আপনি যেটা জানেন না খালি সেটাকেই ভয় লাগে। জেনে নিলেই দেখবেন সব কত সহজ’

অজগর স্যারের এসব শোনার মত অবস্থা নেই, সে অচেতনের মত কার কাছে যেন চোখ বুজে মাফ চাইছে খালি। আর ওদিকে হৈ চৈ শুনে হেড স্যার বিরাজ ভূষণ স্যার নিজে চলে এসেছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে মানহারা কেউই কিছু বললো না। নাফিসা উঠে বসে হেড স্যারকে দেখে ভয়ে আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকলো, মানহা কিছু বলতে গিয়ে টের পেলো এই কথা হেড স্যার বিশ্বাস করবে না। তাই সে বললো,

‘স্যার, আজমল স্যার বিজ্ঞান পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন, খুব জটিল একটা বিষয় পড়াচ্ছিলেন তো।'

দপ্তরীকে ডেকে এনে স্যারকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হল। ক্লাসের সবাই ভয়ের চোখে নতুন মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। সে একেবারে শান্ত হয়ে আবার মুখ নিচু করে বসে আছে। মানহা সাহস করে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

‘এই তোমার নাম কী’?

মেয়েটা মুখ তুলে তাকিয়ে মানহাকে দেখলো, তারপর হালকা একটা হাসি দিয়ে বললো- ‘চন্দ্রা’।

সেই থেকে মেয়েটার সাথে সবার খুব খাতির হয়ে গেল। খালি সেদিন আসলে কী ঘটেছিলো সেটা ক্লাসের কেউ কাউকে বলে নি, শুধু অজগর স্যার নাকি বারবার এই ঘটনা বলতে থাকায় তাকে স্কুল থেকে বাধ্যতামুলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। মানহাদের নতুন বিজ্ঞান শিক্ষক একজন ম্যাডাম। তিনি খুবই সুন্দর করে গল্প বলে বলে ওদের বিজ্ঞান পড়ান। মানহার কাছে বিজ্ঞান এখন বেশ ভালো লাগে।

১ ডিসেম্বর, ২০১৭

গোল্লাছুট, প্রথম আলো

 

 

 

Sunday, April 25, 2021

ইটপাটকেল চিৎপটাং

মনে মনে একজন মানুষের কথা ভাবোতো, যে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে ডাবল অর্নাস করা, সেই সাথে লন্ডনে গিয়ে ফটোগ্রাফি আর লিথোগ্রাফি নামের এক বিশেষ ধরনের ছাপচিত্র নিয়ে কঠিন  কঠিন পড়াশোনা করছে। কেমন হতে পারে সে দেখতে? চশমা? হ্যাঁ চশমা থাকতেই পারে, এত এত পড়াশোনা করলে চোখে চাপ পড়বেই, দাঁড়িগোঁফ? হুম- থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। মুখের ভাব? এটা অবশ্যই ভারিক্কি হবে তাই না? আর স্বভাবে অবশ্যই- গম্ভীর, তাই তো?

হল না, এখানে এসে মিললো না!

সুকুমার রায়

কারণ এই সব বর্ণনা আসলে বাংলা ননসেন্স হিউমারের রাজা সুকুমার রায়ের! যিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে রেখে গেছেন মত মজার মজার ছড়া আর লেখার অমৃত ভাণ্ডার।

কিশোর আলোর পাঠকদের জন্যে অবশ্য সুকুমার রায়কে নিয়ে লিখে জানানোর মত খুব বেশী কিছু নেই, কারণ তোমরা আসলে সবাই জানো যে তাঁর বাবার নাম ছিলো উপেন্দ্রকিশোর রায়। মানে বাংলা শিশু সাহিত্যের দিকপাল উপেন্দ্রকিশোর, আর অন্যদিকে সত্যজিত রায়ও যে আবার সুকুমার রায়ের ছেলে এটাও তোমরা জানো। দুইদিকে দুই অসামান্য প্রতিভাবান মিলে একটা ব্রাকেটের মত মাঝখানে ধরে রেখেছে যেই ক্ষণজন্মা ডাবল অনার্স মোটা চশমার মানুষটাকে, সে অবশ্যই কোন না কোন ভাবে একটু অন্য রকম হতে বাধ্য। এই অনন্যসাধারণ মানুষটার যা যা তোমরা সবাই হয়ত বিশদ জানোনা সেইগুলি নিয়ে আজকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।

মণ্ডা ক্লাব

অথবা MONDAY CLUB, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় আগে করেছিলেন ননসেন্স-ক্লাব। আর বিলেত থেকে ফিরে সুকুমার গড়ে তোলেন এই সোমবারের ক্লাব/ মান্ডে ক্লাব/ ম-া ক্লাব নামে এক সাহিত্য আসর। সে সময়ের গন্যমান্য অনেকেই ছিলেন এই ক্লাবে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন এখানে, সবাই মিলে যাকে বলে এক্কেবারে ননসেন্স আড্ডা। ননসেন্সের মানে কিন্তু যা-তা বা যাচ্ছেতাই নয়, অনেকটা বলতে পারো হেঁয়ালিপনা। সেটার কিছু উদাহরণ আমরা একটু পরেই দেখবো, তার আগে দেখো ননসেন্স ক্লাবের বৈঠকের জন্যে মাঝে মাঝেই কী মজার সব ছড়া লিখেছিলেন সুকুমার রায়। একবার হঠাৎ ক্লাবের সম্পাদক সাহেবের খোঁজ নেই, মানে আড্ডা পণ্ড হয় হয় অবস্থা। সেই কারণে সুকুমার লিখলেন-

সম্পাদক বেয়াকুব

কোথা যে দিয়েছে ডুব-

এদিকেতে হায় হায়

ক্লাবটি ত যায় যায়।

তাই বলি, সোমবারে

মদগৃহে গড়পারে

দিলে সবে পদধুলি

ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।

রকমারি পুঁথি যত

নিজ নিজ রুচিমত

আনিবেন সাথে সবে

কিছু কিছু পাঠ হবে।

করজোড়ে বারবার

নিবেদিছে সুকুমার।

ছন্দমিল, অন্ত্যমিল ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দাও, এমন কলকল করে বয়ে যাওয়া ভাষায় কি জলবৎ তরলং বক্তব্য। পড়লে মনেই হবে না কোন ছড়া পড়ছি, মনেই হবে না কেউ বসে বসে ভেবে ভেবে লাইনগুলি মিলিয়েছে। মনে হবে এটাই বুঝি তার ভাষা। সুকুমারের সহজাত রসবোধ আর সেই সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিত সব শব্দের সাথে শব্দের মিল যাকে বলে একমেবাদ্বিতীয়ম! 

তবে শুধু এই ছড়াতে থেমে গেলে ত আর তাঁকে এত বড় মানুষ বলা হত না। এই ম-া ক্লাব বা ননসেন্স ক্লাব তো ছিল তাঁর ঘরোয়া আড্ডা। এর বাইরে কত কী যে তিনি লিখেছেন। আর এর প্রায় সব লেখাই বের হত সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিষ্ঠিত  ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। এই সন্দেশ নিয়ে না বললে তাই সুকুমার রায়কে নিয়ে বলা স¤পূর্ন হচ্ছে না। 

সন্দেশ ও হাফটোন ব্লক পৃন্ট  

‘সন্দেশ’ মূলতঃ শিশুদের জন্যে উপেন্দ্রকিশোর রায় কর্তৃক ১৯১৩ সালে প্রকাশিত একটি পত্রিকা। এটা বলতে গেলে উপেন্দ্রকিশোর একাই বের করতেন, মানে সেটার লেখা, আঁকা, প্রুফ (বানান শুদ্ধি) মিলানো, এমনকি ছাপা এ সব উপেন্দ্রকিশোর একাই করতেন।

সন্দেশ ছাপার প্রসঙ্গে একটা ঘটনা না বললেই না। ঘটনাটা উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে, সুকুমার রায়কে বোঝার জন্যে তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোরকেও বোঝার আছে। ঘটনাটা হল উপেন্দ্রকিশোর এই সন্দেশ পত্রিকার ছাপা নিয়ে এমনকি এতটাই সিরিয়াস ছিলেন যে কিভাবে ছাপা আরো ভালো করা যায় সেটা ভাবতে ভাবতে রিতীমত ছাপার জগতে নতুন একাধিক মুদ্রণ পদ্ধতি-ই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন! আসলে তাঁর বিখ্যাত বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ যখন দ্বিতীয়বার ছাপা হল দেখা গেল ড্রয়িংগুলি কেমন ধেবড়ে গেছে, ভালমত বোঝাই যাচ্ছে না। আসলে তখন ছাপা হত কাঠের ব্লকে। সেগুলি কিছুদিন পরে নষ্ট হতে শুরু করত। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে উপেন্দ্র দৃঢ়চিত্ত হয়ে একেবারে সেই ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এলেন তখনকার নতুন পৃন্ট পদ্ধতির সব সরঞ্জাম। ভালমত বুঝে নিজে রপ্ত করে তারপরে নতুন আরো আধুনিক কিছু ফর্মুলা বের করলেন হাফটোন ব্লক আর কালার ব্লক নিয়ে , হাফটোন ব্লকের মানে হল একটা ছবির বিভিন্ন শেড বোঝাতে ছোট ছোট ডট ব্যবহার করা, ডট বাড়িয়ে কমিয়েই কালো, ধুসর বা হাল্কা ধুসর ইত্যাদী বোঝানো। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন এভাবেই জটিল করে ছাপতে হত। ছোটদের জন্যে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতে গেলে রঙ তো দুরের কথা, সাদা কালোর কোন মাঝামাঝি শেড দেয়াও তখন কঠিন ছিলো। উপেন্দ্রকিশোর রায় সেটাকে মাথায় রেখে  তাই একাধিক নতুন টোনের ডিজাইন করেছিলেন, সেগুলি এতটাই মানসম্মত হল যে সেই আবিষ্কারের কারিগরি ব্যাখ্যা নিয়ে তাঁর লেখা বৃটেনের পেনরোজ এনুয়াল ভলিউমে ছাপা হল! 

তাহলেই বোঝো ছোটদেরকে এই রায় পরিবার কতটা গুরুত্ত্ব দিতেন, কতটা গুরুত্ব দিতেন নিজের কাজের। আর বাবার এই কাজের ধারাবাহিকতায় সুকুমার যে আরো এগিয়ে নেবেন সবকিছু তা তো বলাই বাহুল্য। আসলে বাবার ওই সন্দেশ পত্রিকা না থাকলে সুকুমার ঠিক সুকুমার হতেন কি না তা বলা কঠিন। কারণ বিলেত থেকে ফিরে এই সন্দেশেই সমানে লিখতে শুরু করেন তিনি, আর ১৯১৫ সালে বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের মৃত্যুর পরে একেবারে পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেন সন্দেশ পত্রিকার ও সেই সাথে বাবার প্রথিষ্ঠিত প্রেস ইউ.রয় এন্ড সন্স। এর পর টানা ৮ বছর আমৃত্যু সেটার স¤পাদনা করে গেছেন সুকুমার রায়। এই পত্রিকাতেই প্রথম সুকুমারের অনবদ্য প্রতিভার প্রকাশ পায়, সন্দেশে ছাপা হওয়া সুকুমারের প্রথম ছড়ার নাম ‘খিচুরি’ নাম শুনে হয়ত চিনলে না, কিন্তু তার প্রথম লাইনগুলি বললেই চিনে ফেলেবে, লাইনগুলি হল-

হাঁস ছিল সজারু (ব্যকরণ মানি না)

হয়ে গেল হাঁসজারু, কেমনে তা জানি না। 

সেই ছড়াটা তোমাদেও অনেকেরই মুখস্থ, সেই ছড়াতেই বাংলার পাঠক প্রথম শুনতে পায়, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, বিছাগল আর গিরগিটিয়ার কথা। সুকুমারের  আবোল তাবোল বইয়ের প্রায় সব ছড়াই কিন্তু আগে সন্দেশে বের হয়েছিলো। যদিও ভিন্ন নামে। রামগরুরের ছানা, বাবুরাম সাপুরে-ইত্যাদি। তোমাদের সবার পড়া সেই ‘অবাক জলপান’ নাটকটিও এই সন্দেশেই বের হয়েছে, আর সেই সাথে আরো দুটো নাটক, ‘হিংসুটে’ ও ‘মামা গো’- সন্দেশেই প্রকাশিত। এ ছাড়া পাগলা দাশু, হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি, খাই খাই এর বিভিন্ন ছড়াও এখানেই বের হয়েছিলো। তার মানে সন্দেশ আর সুকুমার একেবারে অবিচ্ছেদ্য। আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকাতে সংযুক্ত ছিলেন, এমনকি মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থাতেও এর কাজ থামান নি।

তবে সন্দেশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত  শুধু রায় পরিবারের পত্রিকা হয়েই থাকেনি, এখানে লিখেছেন- 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ রায়, কামিনী রায় সহ আরো অনেকে।


দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ

সুকুমার রায়ের আরেকটা দারুণ পরিচয় ছিলো, তিনি ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তরুণ বন্ধু’! ভাবো একবার। এখানেও অবশ্য তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোরের একটা ভূমিকা আছে, কারণ উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের সরাসরি বন্ধুই ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে সাথে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা পেতেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দারুণ  স্নেহ করতেন। এমনকি সুকুমারের অকাল মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্তও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। সুকুমারের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শান্তিনিকেতনের একটা দারুণ প্রভাব ছিল। আবার অন্যদিকে একটা ঘটনায় সুকুমার রায় উলটো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনেও একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেটা হল সেই ১৯১২ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাইজ পাবার এক বছর আগে। সুকুমার রায় The spirit of Rabindranath Tagore নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরে ব্রিটেনর Quest নামের পত্রিকায় বের হয়। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে এই প্রবন্ধের মাধ্যমে বিলেতের পণ্ডিত সমাজ প্রথমবারের মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনতে পারেন, আর সেটা যে পরবর্তীতে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে কোন ভূমিকাই রাখেনি এটা বলা কঠিন। সেটা হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুকুমারের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অপত্য স্নেহে সাহচর্য দিয়েছেন যতটুকু সম্ভব। মৃত্যুর মাত্র ন’দিন  পরে বের হয় সুকুমার রায়ের প্রথম বই আবোল তাবোল, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই তরুণ বন্ধুর বইয়ের ভূমিকায় লেখেন-

“সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবে মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।”

ড্রয়িং

সুকুমার রায়ের আরেকটা প্রতিভা যেটা না বললেই না সেটা হল তাঁর আঁকা। বাবা উপেন্দ্রকিশোরও আঁকতেন দুর্দান্ত, পরে তাঁর ছেলে সত্যজিত রায় তো একেবার পেশাদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টিস্টই ছিলেন। আর মাঝে সুকুমার রায় তাঁর অনন্য ড্রয়িং দিয়ে ভরাট করে রেখে গেছেন পাতার পর পাতা। প্রায় সবই তাঁর নিজের লেখার জন্যে আঁকা। আর সেকি দারুণ সাবলীল লাইন। তাঁর এসব সব উদ্ভট চিন্তাভাবনার দৃশ্যায়ন আসলে অন্য আর কেউ করতে পারতো কি না সেটা একটা প্রশ্ন। কোন আঁকার কথা বলব বল? 


হেঁসোরাম হুশিয়ার স্বয়ং। তার দলবল বাক্সপেটরা পেতে বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। হেঁসোরামকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে হচ্ছে না। দাঁড়ানোর ভঙ্গী আর ছবির সুচিন্তিত কম্পোজিশন বলে দিচ্ছে কে মূল লোক। পেছনে আবার হিজ মাস্টার্স ভয়েছের মত করে কুকুরটা যেন আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে বাকি সব্বাইকে। একটা ছাতা, নিচে পড়ে থাকা ম্যাপ আর হেঁসোরামের বন্দুকের মাথায় রাখা ক্যাপ সবই এক এডভেঞ্চারাস সরস আবহ তৈরী করেছে।

যেহেতু সুযোগ পাওয়া গেছে আমি আমার পছন্দেও গুলি দিয়েই শুরু করি, সেটা হল- ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যলেঞ্জারে সাথে মিল থাকলেও এর ক্যারেক্টারটা সুকুমার এমনই অন্য এক কল্পনা জগতে নিয়ে গেছেন যে তার ধারে কাছে আর কেউ ঘেঁষতেই পারবে না। গল্পটা আমি বলবো না, কারণ অনেকেই পড়নি হয়ত, মূল ভাবনাটা হল এক পরিব্রাজকের ডায়রি। তিনি তাঁর এক আজব অভিযানে যে অবিশ্বাস্য সব প্রাণীর দেখা পেয়েছেন তারই বর্ণনা নিয়ে লিখেছেন, অনেকটা পরবর্তিতে তাঁর ছেলে সত্যজিত রায়ের চরিত্র প্রফেসর শংকুর মত। সুকমার রায়ের মত এরকম কন্সেপ্ট আর্ট সে সময় বাঙ্গালী কেউ করেছেন ভাবতেই কেমন একটা গা শিউড়ানো অনুভূতি টের পাচ্ছি। এবারে হেঁসোরামের কিছু প্রানীর নাম শোন আর ছবি দেখো-

 


বাঁয়ে বেচারােেথড়িয়াম আর ডানে চিল্লানসোরাস। মানে কিনা বাঁয়ের জন বড়ই বেচারা, আর ডানেরজন চিলচিতকারে পটু নাম তাই চিল্লানোসোরাস। কী অসাধারণ নামকরণ, ডায়নোসরের মত নামের শেষে ‘সোরাস’ আর প্রথমে একেবারে আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি চিল্লানি আর ওদিকে বেচারা। কিন্তু কোথাও তাল কাটেনি। আর ড্রয়িংএ কার কী ভূমিকা তা এক পলকেই বোঝা যাচ্ছে।

     


আর ল্যাগব্যাগে এই পাখির (!) নাম আর কী হবে, ল্যাগব্যাগর্নিস।


গোমড়ামুখো: গোমড়াথেরিয়াম

 


ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলছে, ল্যাংড়াথেরিয়াম!

এরপরে বলতে হবে তাঁর আরেক অবিশ্বাস্য ননসেন্স গল্প ‘হযবরল’ এর কথা। সেখানকার অসংখ্য চরিত্রের একটা হল এক গণিতিবিদ কাক- শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটির এই কাকেরা সকল ধরনের হিসাবি ও বেহিসাবী, খুচরা ও পাইকারী সকল গণনার কাজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে থাকে। এই বর্ণনার সাথে যেন এই ড্রয়িংটি নাহলে সেটা সম্পূর্নই হত না- কাকের হাতে ধরা শ্লেট , মুখে চক-খড়ি, সিরিয়াস মুখে সেটা ধরে আছে এক হাত-নাকি পায়ে? নিচে ঝুলছে দলিল দস্তাবেজ। একটা ব্যাপার দেখার আছে, সুকুমারের এই ড্রয়িংএ কিন্তু ক্যারেক্টারগুলি কার্টুন না। মানে মনে হচ্ছে একেবারে সত্যিকারের একটা কাকই এটা ধরে বসে আছে। সুকুমার যে কার্টুনের মত করে কাক আঁকতে পারতেন না এমন না, তার মানে এখানে রিয়েলিস্টিক করে কাক আঁকার একটা কারণ হতে পারে সেটা হল আঁকায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনা। মানে দেখে মনে হবে একেবারে আসল কাক, মানে হয়ত আসলেই এই কাক্কেশ্বর কুচকুচে কোথাও না কোথাও আছেন, আর খুচরা-পাইকারী হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছেন।

শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে

গেছোদাদা

একই গল্পের আরেক চরিত্র গেছোদাদা, সে যে কখন কোথায় থাকে তা বলাই এক মুশকিলের ব্যাপার। আর হযবরল এর সেই ফিচেল বেড়াল, যা কি না সুকমার সমগ্র বইয়ের প্রচ্ছদে এসে সব বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে ঢুকে গেছে। সেটার এক চোখ টেপা বাঁকা হাসি যেন সুকুমারের গোটা সাহিত্যের মূল মেজাজটাই ধরে বসে আছে। এই বিড়াল যারা দেখেছো আর হযবরল যারা পড়েছো তার নিশ্চই গল্পটার সাথে লুই ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্দারল্যান্ডের মিল পেয়েছো? বিড়ালটা সেই চেশ্যায়ার ক্যাটের মত না? হেঁয়ালী ভরা উক্তিতে যে চেশ্যায়ার ক্যাটকেও ছাড়িয়ে গেছে, যে কি না চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ (!) আর রুমালের মা মিলে যে বানিয়ে দিলো চশমা। নন-সেন্স মানে কিনা যার সরাসরি কোন মানে হয় না কিন্তু কোথাও আবার কোন ছন্দপতন নেই এমন প্রায় অসম্ভবের মত সাহিত্যের এই ধারাটি কিন্তু পৃথিবীতেই সহজলভ্য না। লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন- পৃথিবীর বহু দেশের বহু লেখকের লেখা তিনি পড়েছেন, অনেক ভাষা জানতেন বলে এমনকি অনেকগুলি মূল ভাষাতেই পড়েছেন কিন্তু সুকুমারের মত এমন উইটি আর ননসেন্স এক করে লেখার মত কাউকে পাননি। এ ব্যাপারে তাঁর মতে সুকুমার রায়ই বিশ্বসেরা। 

হযবরল এর বিড়াল 

সুকুমার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আঁকাআঁকি শেখেননি, তাই প্রথম দিকের বেশ কিছু ড্রয়িংএ কিছুটা নভিস ছাপ দেখা গেলেও পরের দিকে সেটা একেবারে পেশাদার আঁকিয়েদের মত হয়ে গিয়েছে। যেমন অবুঝ নামের ছড়ার এই আঁকা বা সাথের ‘দাঁড়ের কবিতা’র আঁকাটা খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে। যেমন কনফিডেন্ট লাইন, তেমনি রিদম আর কম্পোজিশন। বিশেষ করে দাঁড়ের কবিতার ড্রয়িং তো অনবদ্য। 


অবুঝ

দাঁড়ের কবিতা 


তবে আমার ব্যক্তিগত মত সুকুমারের ড্রয়িংএর মধ্যে সবচেয়ে দারুণ কাজটা হল তাঁর ট্যাঁশগরু, এখানে একই সাথে যেমন ক্যারেক্টার ডিজাইন, তেমন আঁকাআঁকির ব্যকরণের প্রয়োগ মিলে যাকে বলে হিরণ্ময়।


ট্যাঁশগরু

কিম্ভুত কিমাকার এই গরু হারুদের অফিসে বসে যেন জাবর কাটছে সুখে। ড্রয়িংটার বিশেষত্ব হল এখানে আঁকাআঁকির ব্যকরণ অনেকটাই সার্থকভাবে মানা হয়েছে। ডানদিকের কোণাকুণি একটা লাইট আসছে বলে তার বাম পাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছায়ায় মিলানো। সেটা করা হয়ছে শুধুমাত্র কলমের ক্রসহ্যাচ (কলমে এদিক ওদিক টেনে জালের মত করে যেই শেডটা দেয়া) করে। আর পশুর এনাটমিকে যথাসম্ভব সত্যিকারের মত করে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, আবারো সেই বিশ্বাসযোগ্যতা। মানে কিনা এই জিনিস আসলেই আছে। আর শেষ মুন্সিয়ানা হল গলার মাফলারটা। একেবারে ১০০% দেশী বাঙ্গালী বাবুটি যেন। চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত, ফিট্ফাট্ কালোচুলে টেরিখানা চোস্ত । যে আবার খায় খালি সাবানের সুপ আর মোমবাতি। পায়ের কাছে সম্ভবত সে দুটোই পড়ে আছে। যেমন ড্রয়িং তেমনি তার বর্ণনা, দুর্দান্ত ননসেন্স ছন্দমিল- 

ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে ;

যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে ।

...

একদিন খেয়েছিল ন্যাক্ড়ার ফালি সে-

তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে ।

সুকুমারের ড্রয়িং আর তাঁর লেখা আসলে একটা ছাড়া অন্যটা সম্পূর্ন হয় না। আর এই লেখার সাথে এই ড্রয়িংও আসলে একজনই করতে পারতো, সুকুমার নিজে।

আদিম কালের চাঁদিম হিম

ভাবতে পারো এই অসম্ভব গুণী মানুষটা মারা গিয়েছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে? এবং সেটা খুবই করুণ ভাবে। সে সময়ে একটা রোগ ছিলো স্থানীয়ভাবে যাকে বলত কালাজ্বর। জীবনের শেষ আড়াই বছরের বেশীরভাগই তাঁর কেটেছে রোগশয্যায়। এর মধ্যেও তাঁর কাজ কিন্তু থেমে ছিলো না। এমনকি প্রিন্টিং নিয়ে একাধিক নতুন টেকনিকের খসড়া করা ছিলো তাঁর সে সময়ের নোটবুকে। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি থামেনি। মুছে যায়নি মুখের হাসি। নিজের প্রথম বই আবোল তাবোল তখনো প্রেসে, সেটার শেষ ছড়াটি তিনি লিখে শেষ করলে বিছানায় শুয়ে।

আজকে দাদা যাবার আগে

বলব যা মোর চিত্তে লাগে-

নাই বা তাহার অর্থ হোক

নাইবা বুঝুক বেবাক লোক ।

...  ... ...  ...  ...  ...  

আদিম কালের চাঁদিম হিম

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,

গানের পালা সাঙ্গ মোর । 

ছড়াটিতেই কি টের পাচ্ছোনা যে একটা বিদায়ের সুর তিনি দিয়ে যাচ্ছেন? তাঁর মৃত্যুর ন’দিন পর বের হয় আবোল তাবোল। উদ্ভট খামখেয়ালে বাঙালি- বাংলা ভাষাভাষীদের একেবারে চিত্তের সাথে নিজিকে মিলিয়ে দিয়ে বিদায় নেন সুকুমার। তাঁর নিজের ভাষায়- ‘দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ’। সত্যি একেবারে তাই, দেহের বিনাশে তাঁর যেন কিছুই বিনাশ হয়নি। বরং নতুন করে প্রতিদিন তিনি জন্ম নিচ্ছেন প্রতিটি পাঠকের মধ্যে।

বি: দ্র: লেখাটির বেশ কিছু তথ্য দীপক সেনগপ্তের লেখা ‘চিরনবীন সুকুমার রায়’ নামের লেখা প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।

কিশোর আলো
সেপ্টেম্বর, ২০১৮