Monday, April 19, 2021

থেমো না!


ডিজনি কে চেনো না এমন কেউ আছো কি? কার্টুন পছন্দ করো কিন্তু নামটাও শোনোনি এমন কারো থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি নিশ্চিত জানি অনেকে এমনকি ডিজনিল্যাণ্ডেরও নাম শুনেছো,হয়ত গিয়েছেও কেউ কেউ। আচ্ছা মেনে নিচ্ছি অনেকেরই নামটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু এটা কী, তা ঠিক জানি না। এটা কি একটা চ্যানেল? এটা কি একটা পার্ক? নাকি সিনেমার স্টুডিও? হুম, এমন সব গণ্ডগোল লাগতেই পারে কারণ এর সব গুলি- আসলে সত্যি। কিন্তু এই সব কিছু যার নামে নাম মিলিয়ে রাখা তাঁকে না চিনলে তো আর সবটা জানাই হবে না। তাঁকে নিয়েই আমাদের আজকের ছোট আড্ডা।

পড়ুয়া যারা (ক্লাসের পড়া না,সত্যিকারের কাজের যে গল্পের বই সেইসব পড়ার কথা বলছি) তারা নিশ্চই ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছো যে এই একটা নাম নিয়ে এত কথা বলার কী হ্ল। কারণ এর নামতো আমরা সবাই জানি-ই। তাঁর নাম ওয়াল্ট ডিজনি। আমেরিকান এক কার্টুনিস্ট। যিনি মিকি মাউস, স্নো হয়াইট, পিনোকিও, বাম্বি, সিন্ডারেলা ইত্যাদি সহ আরো অসংখ্য এনিমেটেড কার্টুন ছবি তৈরী করে গেছেন। তৈরী করে গেছেন ডিজনি স্টুডিও। পৃথিবীর ইতিহাসেই এতটা প্রভাব বিস্তার করা শিল্পীর সংখ্যা কম। তাই তাঁকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলাও আসলে বাহুল্য। তাহলে আমরা আজকে কী বলতে এসেছি?

যেটা বলতে এসেছি সেটা আমার ধারনা সবাই বেশ মজা পাবে শুনে। সেটা হল এই গুণে গুণে ২২ টা অস্কার বিজয়ি শিল্পীর জীবনে কতরকম সমস্যা ছিলো, কত বাধা বিপত্তি পার হয়ে তাঁকে ওয়াল্ট ডিজনি হতে হয়েছে।

কিন্তু এই এত সফল মানুষটার  জীবনের প্রথম দিকে তুমি যা কিছুরই নাম করো না কেন তাঁর সবকছুই ছিল ব্যর্থতায় ভরা। কার্টুনিস্ট হবেন বলে ১৯০১ সালে শিকাগোতে জন্ম নেয়া ওয়াল্ট আঁকিয়ে হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৮ বছর বয়সে, এবং আমাদের আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান ওয়াল্টের চাকরি চলে যায় কারণ তাঁর সম্পাদক তাঁকে বলেন সে একটা অলস আর হাঁদারাম। মাথায় বোধবুদ্ধি, সৃজনশীলতা কিছুই নেইভাবো।

মাঝে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সেখানে রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ সেরে ফিরে এসে ওয়াল্ট শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগ দেন ক্যানসাস সিটি কমার্শিয়াল স্টুডিওতে। সেটা অত সুবিধার না লাগায় পরে নিজের ভাই রয় ডিজনিকে নিয়ে শুরু করেন নিজেদের একটা কার্টুন হাউজ ‘লাফ-ও-গ্রাম’ চালু করেন। কিন্তু টাকার অভাবে তখন তাঁকে থাকতে হত এক বন্ধুর সাথে আর তাঁর অফিসটা চালাতে হয় একটা পরিত্যাক্ত গাড়ির গ্যারেজে। এবং অনেক চেষ্টার পরেও তাঁর কোন কাজই তখন আর বিক্রি হচ্ছিলো না। কোনমতে এর ওর থেকে ধার দেনা করে খাবার জোগাড় করে চলতো ওয়াল্ট। আর এই দুরবস্থার সময়েই মাঝে মাঝে তাঁর দুপুরের খাবারে ভাগ বসাতে চলে আসতো একটা ইঁদুর, আর সবার মত সেটাকে তাড়িয়ে না দিয়ে ওয়াল্ট মজার এই চরিত্রটাকে একজন কার্টুনিস্টের চোখে দেখতেন। আর এই ইঁদুরটাকে দেখেই নাকি ওয়াল্টের মাথায় পরে চলে আসে মিকি মাউসের আইডিয়া।

এদিকে শেষমেশ সেই ‘লাফ-ও-গ্রাম’ এর ভরাডুবি হতে পকেটে সবেধন ৪০ ডলার নিয়ে ওয়াল্ট রওনা হলেন লস এঞ্জেলস শহরের দিকে। এবার ইচ্ছা অভিনেতা হবেন, কার্টুন টার্টুন বাদ। কিন্তু বিধি বাম সেটাও কোনভাবেই হলো না। কী আর করা সব ছেড়েছুড়ে আবার কার্টুনে ফেরা, এবারে তিনই মনস্থির করলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে সেখানে একটা এনিমেশন ফার্ম দেবেন। কারণ তখন ওই এলাকায় এরকম কোন স্টুডিও ছিলো না। আবারো ভাই রয় ডিজনিকে সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। এবং এবারে যেন কাল মেঘের কোণা ফুঁড়ে রুপোলী রোদের হাল্কা রেখা দেখা গেল- তাঁদের কার্টুন ছবি ‘অসওয়াল্ড দ্য লাকি র‍্যাবিট’ বেশ নাম করলো।

কিন্তু এই সুখও বেশিদিন সইলো না, ব্যবসায়ীক জটিলতার খপ্পরে পড়ে সেখান থেকে হঠাত তাকে সরিয়ে দেয়া হল, তিনি আবিষ্কার করলেন এতদিন যেই অসওয়াল্ড নিয়ে তিনি কাজ করছিলেন সেটার মালিকানা আসলে মোটেও তাঁর ছিলো না, আইনের মারপ্যাঁচে সেটার কপিরাইট চলে গেছে ইউনিভার্সেল স্টুডিওর হাতে। আবারো সেই শূণ্য দশা ওয়াল্টের। এ অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষই আমরা হতাশ হয়ে যাবে। আর এখানেই ওয়াল্টের সাথে আমাদের হতাশ মানুষদের পার্থক্য।

ওয়াল্ট বের হয়েই খুঁজে বের করলে তাঁর পুরোনো বন্ধু আরেক অসাধারণ কার্টুনিস্ট ও এনিমেটর অ্যায়েওয়ার্ক্স (Iwerks) কে। দু’জনে মিলে এবারে তৈরী করলেন একটা ইঁদুর ক্যারেক্টার, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো, সেই ইঁদুরটার নাম মিকি মাউস। পুরো পৃথিবী এখন যাকে জানে এক নামে। এবং এরপর থেকে একে একে অসাধারণ সব এনিমেশন মুভি বের হতে থাকে তাঁদের থেকে, স্নো হয়াইট, পিনোকিও, বাম্বি, সিন্ডারেলা , এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, পিটারপ্যান, স্লিপিং বিউটি- সজা কথা যা যা দারুন এনিমেটেড সিনেমার নাম আমরা জানি। ডিজনির নিজের নামে করা ডিজনি স্টুডিও যেন পুরো পৃথিবীতেই এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিলো কার্টুন এর জগতে। সেসব গল্প আসলে আর নতুন করে বলার কিছুই নেই, যেমনটা লেখার শুরুতেই বলেছিলাম।

আসলে আমরা সফল মানুষদের সফলতার গল্পটাই সাধারণত শুনি, কিন্তু এর পেছনে কত রকমের ব্যর্থতা আর হতাশার পাহাড় জমে আছে তা জানি না। ওয়াল্ট ডিজনি কিভাবে এই হতাশা কাটিয়েও সামনে এগোতেন সেটাই আমাদের একটা বড়ো শেখার জায়গা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর দুটো বক্তব্য ছিল-

“তোমার যে কোন স্বপ্নই সত্যি হতে পারে যদি তুমি সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করো আর সেই অনুযায়ী আজ করে যাও”

আর যে কোন কাজটা করার যে ডিজনি সূত্র তা হল-

‘’Keep Moving Forward’’

অর্থাত যা-ই ঘটুক না কেন, সফলতা বা ব্যর্থতা তোমাকে সেটা ভেবে থেমে গেলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে, থামা চলবে না। ডিজনিও থামেননি, আর তার ফলেই পৃথিবী পেয়েছে অসামান্য স্বপ্নের জগতের অসংখ্য কার্টুন ক্যারেক্টার, আর অসাধারণ সব এনিমেটেড সিনেমা। আর একক ব্যাক্তি হিসেবে তিনি ঝোলায় পুরেছেন ২২ টি অস্কার!

সুতরাং যদি নিজের স্বপ্ন সফল করতে চাও তাহলে খালি মেনে চলো তাঁর এই সূত্রগুলি।


-মেহেদী হক

কিশোর বাংলা ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর, ২০২০ এ প্রকাশিত।


No comments:

Post a Comment