Sunday, April 25, 2021

ইটপাটকেল চিৎপটাং

মনে মনে একজন মানুষের কথা ভাবোতো, যে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে ডাবল অর্নাস করা, সেই সাথে লন্ডনে গিয়ে ফটোগ্রাফি আর লিথোগ্রাফি নামের এক বিশেষ ধরনের ছাপচিত্র নিয়ে কঠিন  কঠিন পড়াশোনা করছে। কেমন হতে পারে সে দেখতে? চশমা? হ্যাঁ চশমা থাকতেই পারে, এত এত পড়াশোনা করলে চোখে চাপ পড়বেই, দাঁড়িগোঁফ? হুম- থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। মুখের ভাব? এটা অবশ্যই ভারিক্কি হবে তাই না? আর স্বভাবে অবশ্যই- গম্ভীর, তাই তো?

হল না, এখানে এসে মিললো না!

সুকুমার রায়

কারণ এই সব বর্ণনা আসলে বাংলা ননসেন্স হিউমারের রাজা সুকুমার রায়ের! যিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে রেখে গেছেন মত মজার মজার ছড়া আর লেখার অমৃত ভাণ্ডার।

কিশোর আলোর পাঠকদের জন্যে অবশ্য সুকুমার রায়কে নিয়ে লিখে জানানোর মত খুব বেশী কিছু নেই, কারণ তোমরা আসলে সবাই জানো যে তাঁর বাবার নাম ছিলো উপেন্দ্রকিশোর রায়। মানে বাংলা শিশু সাহিত্যের দিকপাল উপেন্দ্রকিশোর, আর অন্যদিকে সত্যজিত রায়ও যে আবার সুকুমার রায়ের ছেলে এটাও তোমরা জানো। দুইদিকে দুই অসামান্য প্রতিভাবান মিলে একটা ব্রাকেটের মত মাঝখানে ধরে রেখেছে যেই ক্ষণজন্মা ডাবল অনার্স মোটা চশমার মানুষটাকে, সে অবশ্যই কোন না কোন ভাবে একটু অন্য রকম হতে বাধ্য। এই অনন্যসাধারণ মানুষটার যা যা তোমরা সবাই হয়ত বিশদ জানোনা সেইগুলি নিয়ে আজকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।

মণ্ডা ক্লাব

অথবা MONDAY CLUB, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় আগে করেছিলেন ননসেন্স-ক্লাব। আর বিলেত থেকে ফিরে সুকুমার গড়ে তোলেন এই সোমবারের ক্লাব/ মান্ডে ক্লাব/ ম-া ক্লাব নামে এক সাহিত্য আসর। সে সময়ের গন্যমান্য অনেকেই ছিলেন এই ক্লাবে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন এখানে, সবাই মিলে যাকে বলে এক্কেবারে ননসেন্স আড্ডা। ননসেন্সের মানে কিন্তু যা-তা বা যাচ্ছেতাই নয়, অনেকটা বলতে পারো হেঁয়ালিপনা। সেটার কিছু উদাহরণ আমরা একটু পরেই দেখবো, তার আগে দেখো ননসেন্স ক্লাবের বৈঠকের জন্যে মাঝে মাঝেই কী মজার সব ছড়া লিখেছিলেন সুকুমার রায়। একবার হঠাৎ ক্লাবের সম্পাদক সাহেবের খোঁজ নেই, মানে আড্ডা পণ্ড হয় হয় অবস্থা। সেই কারণে সুকুমার লিখলেন-

সম্পাদক বেয়াকুব

কোথা যে দিয়েছে ডুব-

এদিকেতে হায় হায়

ক্লাবটি ত যায় যায়।

তাই বলি, সোমবারে

মদগৃহে গড়পারে

দিলে সবে পদধুলি

ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।

রকমারি পুঁথি যত

নিজ নিজ রুচিমত

আনিবেন সাথে সবে

কিছু কিছু পাঠ হবে।

করজোড়ে বারবার

নিবেদিছে সুকুমার।

ছন্দমিল, অন্ত্যমিল ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দাও, এমন কলকল করে বয়ে যাওয়া ভাষায় কি জলবৎ তরলং বক্তব্য। পড়লে মনেই হবে না কোন ছড়া পড়ছি, মনেই হবে না কেউ বসে বসে ভেবে ভেবে লাইনগুলি মিলিয়েছে। মনে হবে এটাই বুঝি তার ভাষা। সুকুমারের সহজাত রসবোধ আর সেই সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিত সব শব্দের সাথে শব্দের মিল যাকে বলে একমেবাদ্বিতীয়ম! 

তবে শুধু এই ছড়াতে থেমে গেলে ত আর তাঁকে এত বড় মানুষ বলা হত না। এই ম-া ক্লাব বা ননসেন্স ক্লাব তো ছিল তাঁর ঘরোয়া আড্ডা। এর বাইরে কত কী যে তিনি লিখেছেন। আর এর প্রায় সব লেখাই বের হত সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিষ্ঠিত  ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। এই সন্দেশ নিয়ে না বললে তাই সুকুমার রায়কে নিয়ে বলা স¤পূর্ন হচ্ছে না। 

সন্দেশ ও হাফটোন ব্লক পৃন্ট  

‘সন্দেশ’ মূলতঃ শিশুদের জন্যে উপেন্দ্রকিশোর রায় কর্তৃক ১৯১৩ সালে প্রকাশিত একটি পত্রিকা। এটা বলতে গেলে উপেন্দ্রকিশোর একাই বের করতেন, মানে সেটার লেখা, আঁকা, প্রুফ (বানান শুদ্ধি) মিলানো, এমনকি ছাপা এ সব উপেন্দ্রকিশোর একাই করতেন।

সন্দেশ ছাপার প্রসঙ্গে একটা ঘটনা না বললেই না। ঘটনাটা উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে, সুকুমার রায়কে বোঝার জন্যে তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোরকেও বোঝার আছে। ঘটনাটা হল উপেন্দ্রকিশোর এই সন্দেশ পত্রিকার ছাপা নিয়ে এমনকি এতটাই সিরিয়াস ছিলেন যে কিভাবে ছাপা আরো ভালো করা যায় সেটা ভাবতে ভাবতে রিতীমত ছাপার জগতে নতুন একাধিক মুদ্রণ পদ্ধতি-ই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন! আসলে তাঁর বিখ্যাত বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ যখন দ্বিতীয়বার ছাপা হল দেখা গেল ড্রয়িংগুলি কেমন ধেবড়ে গেছে, ভালমত বোঝাই যাচ্ছে না। আসলে তখন ছাপা হত কাঠের ব্লকে। সেগুলি কিছুদিন পরে নষ্ট হতে শুরু করত। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে উপেন্দ্র দৃঢ়চিত্ত হয়ে একেবারে সেই ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এলেন তখনকার নতুন পৃন্ট পদ্ধতির সব সরঞ্জাম। ভালমত বুঝে নিজে রপ্ত করে তারপরে নতুন আরো আধুনিক কিছু ফর্মুলা বের করলেন হাফটোন ব্লক আর কালার ব্লক নিয়ে , হাফটোন ব্লকের মানে হল একটা ছবির বিভিন্ন শেড বোঝাতে ছোট ছোট ডট ব্যবহার করা, ডট বাড়িয়ে কমিয়েই কালো, ধুসর বা হাল্কা ধুসর ইত্যাদী বোঝানো। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন এভাবেই জটিল করে ছাপতে হত। ছোটদের জন্যে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতে গেলে রঙ তো দুরের কথা, সাদা কালোর কোন মাঝামাঝি শেড দেয়াও তখন কঠিন ছিলো। উপেন্দ্রকিশোর রায় সেটাকে মাথায় রেখে  তাই একাধিক নতুন টোনের ডিজাইন করেছিলেন, সেগুলি এতটাই মানসম্মত হল যে সেই আবিষ্কারের কারিগরি ব্যাখ্যা নিয়ে তাঁর লেখা বৃটেনের পেনরোজ এনুয়াল ভলিউমে ছাপা হল! 

তাহলেই বোঝো ছোটদেরকে এই রায় পরিবার কতটা গুরুত্ত্ব দিতেন, কতটা গুরুত্ব দিতেন নিজের কাজের। আর বাবার এই কাজের ধারাবাহিকতায় সুকুমার যে আরো এগিয়ে নেবেন সবকিছু তা তো বলাই বাহুল্য। আসলে বাবার ওই সন্দেশ পত্রিকা না থাকলে সুকুমার ঠিক সুকুমার হতেন কি না তা বলা কঠিন। কারণ বিলেত থেকে ফিরে এই সন্দেশেই সমানে লিখতে শুরু করেন তিনি, আর ১৯১৫ সালে বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের মৃত্যুর পরে একেবারে পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেন সন্দেশ পত্রিকার ও সেই সাথে বাবার প্রথিষ্ঠিত প্রেস ইউ.রয় এন্ড সন্স। এর পর টানা ৮ বছর আমৃত্যু সেটার স¤পাদনা করে গেছেন সুকুমার রায়। এই পত্রিকাতেই প্রথম সুকুমারের অনবদ্য প্রতিভার প্রকাশ পায়, সন্দেশে ছাপা হওয়া সুকুমারের প্রথম ছড়ার নাম ‘খিচুরি’ নাম শুনে হয়ত চিনলে না, কিন্তু তার প্রথম লাইনগুলি বললেই চিনে ফেলেবে, লাইনগুলি হল-

হাঁস ছিল সজারু (ব্যকরণ মানি না)

হয়ে গেল হাঁসজারু, কেমনে তা জানি না। 

সেই ছড়াটা তোমাদেও অনেকেরই মুখস্থ, সেই ছড়াতেই বাংলার পাঠক প্রথম শুনতে পায়, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, বিছাগল আর গিরগিটিয়ার কথা। সুকুমারের  আবোল তাবোল বইয়ের প্রায় সব ছড়াই কিন্তু আগে সন্দেশে বের হয়েছিলো। যদিও ভিন্ন নামে। রামগরুরের ছানা, বাবুরাম সাপুরে-ইত্যাদি। তোমাদের সবার পড়া সেই ‘অবাক জলপান’ নাটকটিও এই সন্দেশেই বের হয়েছে, আর সেই সাথে আরো দুটো নাটক, ‘হিংসুটে’ ও ‘মামা গো’- সন্দেশেই প্রকাশিত। এ ছাড়া পাগলা দাশু, হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি, খাই খাই এর বিভিন্ন ছড়াও এখানেই বের হয়েছিলো। তার মানে সন্দেশ আর সুকুমার একেবারে অবিচ্ছেদ্য। আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকাতে সংযুক্ত ছিলেন, এমনকি মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থাতেও এর কাজ থামান নি।

তবে সন্দেশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত  শুধু রায় পরিবারের পত্রিকা হয়েই থাকেনি, এখানে লিখেছেন- 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ রায়, কামিনী রায় সহ আরো অনেকে।


দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ

সুকুমার রায়ের আরেকটা দারুণ পরিচয় ছিলো, তিনি ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তরুণ বন্ধু’! ভাবো একবার। এখানেও অবশ্য তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোরের একটা ভূমিকা আছে, কারণ উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের সরাসরি বন্ধুই ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে সাথে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা পেতেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দারুণ  স্নেহ করতেন। এমনকি সুকুমারের অকাল মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্তও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। সুকুমারের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শান্তিনিকেতনের একটা দারুণ প্রভাব ছিল। আবার অন্যদিকে একটা ঘটনায় সুকুমার রায় উলটো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনেও একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেটা হল সেই ১৯১২ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাইজ পাবার এক বছর আগে। সুকুমার রায় The spirit of Rabindranath Tagore নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরে ব্রিটেনর Quest নামের পত্রিকায় বের হয়। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে এই প্রবন্ধের মাধ্যমে বিলেতের পণ্ডিত সমাজ প্রথমবারের মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনতে পারেন, আর সেটা যে পরবর্তীতে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে কোন ভূমিকাই রাখেনি এটা বলা কঠিন। সেটা হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুকুমারের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অপত্য স্নেহে সাহচর্য দিয়েছেন যতটুকু সম্ভব। মৃত্যুর মাত্র ন’দিন  পরে বের হয় সুকুমার রায়ের প্রথম বই আবোল তাবোল, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই তরুণ বন্ধুর বইয়ের ভূমিকায় লেখেন-

“সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবে মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।”

ড্রয়িং

সুকুমার রায়ের আরেকটা প্রতিভা যেটা না বললেই না সেটা হল তাঁর আঁকা। বাবা উপেন্দ্রকিশোরও আঁকতেন দুর্দান্ত, পরে তাঁর ছেলে সত্যজিত রায় তো একেবার পেশাদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টিস্টই ছিলেন। আর মাঝে সুকুমার রায় তাঁর অনন্য ড্রয়িং দিয়ে ভরাট করে রেখে গেছেন পাতার পর পাতা। প্রায় সবই তাঁর নিজের লেখার জন্যে আঁকা। আর সেকি দারুণ সাবলীল লাইন। তাঁর এসব সব উদ্ভট চিন্তাভাবনার দৃশ্যায়ন আসলে অন্য আর কেউ করতে পারতো কি না সেটা একটা প্রশ্ন। কোন আঁকার কথা বলব বল? 


হেঁসোরাম হুশিয়ার স্বয়ং। তার দলবল বাক্সপেটরা পেতে বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। হেঁসোরামকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে হচ্ছে না। দাঁড়ানোর ভঙ্গী আর ছবির সুচিন্তিত কম্পোজিশন বলে দিচ্ছে কে মূল লোক। পেছনে আবার হিজ মাস্টার্স ভয়েছের মত করে কুকুরটা যেন আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে বাকি সব্বাইকে। একটা ছাতা, নিচে পড়ে থাকা ম্যাপ আর হেঁসোরামের বন্দুকের মাথায় রাখা ক্যাপ সবই এক এডভেঞ্চারাস সরস আবহ তৈরী করেছে।

যেহেতু সুযোগ পাওয়া গেছে আমি আমার পছন্দেও গুলি দিয়েই শুরু করি, সেটা হল- ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যলেঞ্জারে সাথে মিল থাকলেও এর ক্যারেক্টারটা সুকুমার এমনই অন্য এক কল্পনা জগতে নিয়ে গেছেন যে তার ধারে কাছে আর কেউ ঘেঁষতেই পারবে না। গল্পটা আমি বলবো না, কারণ অনেকেই পড়নি হয়ত, মূল ভাবনাটা হল এক পরিব্রাজকের ডায়রি। তিনি তাঁর এক আজব অভিযানে যে অবিশ্বাস্য সব প্রাণীর দেখা পেয়েছেন তারই বর্ণনা নিয়ে লিখেছেন, অনেকটা পরবর্তিতে তাঁর ছেলে সত্যজিত রায়ের চরিত্র প্রফেসর শংকুর মত। সুকমার রায়ের মত এরকম কন্সেপ্ট আর্ট সে সময় বাঙ্গালী কেউ করেছেন ভাবতেই কেমন একটা গা শিউড়ানো অনুভূতি টের পাচ্ছি। এবারে হেঁসোরামের কিছু প্রানীর নাম শোন আর ছবি দেখো-

 


বাঁয়ে বেচারােেথড়িয়াম আর ডানে চিল্লানসোরাস। মানে কিনা বাঁয়ের জন বড়ই বেচারা, আর ডানেরজন চিলচিতকারে পটু নাম তাই চিল্লানোসোরাস। কী অসাধারণ নামকরণ, ডায়নোসরের মত নামের শেষে ‘সোরাস’ আর প্রথমে একেবারে আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি চিল্লানি আর ওদিকে বেচারা। কিন্তু কোথাও তাল কাটেনি। আর ড্রয়িংএ কার কী ভূমিকা তা এক পলকেই বোঝা যাচ্ছে।

     


আর ল্যাগব্যাগে এই পাখির (!) নাম আর কী হবে, ল্যাগব্যাগর্নিস।


গোমড়ামুখো: গোমড়াথেরিয়াম

 


ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলছে, ল্যাংড়াথেরিয়াম!

এরপরে বলতে হবে তাঁর আরেক অবিশ্বাস্য ননসেন্স গল্প ‘হযবরল’ এর কথা। সেখানকার অসংখ্য চরিত্রের একটা হল এক গণিতিবিদ কাক- শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটির এই কাকেরা সকল ধরনের হিসাবি ও বেহিসাবী, খুচরা ও পাইকারী সকল গণনার কাজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে থাকে। এই বর্ণনার সাথে যেন এই ড্রয়িংটি নাহলে সেটা সম্পূর্নই হত না- কাকের হাতে ধরা শ্লেট , মুখে চক-খড়ি, সিরিয়াস মুখে সেটা ধরে আছে এক হাত-নাকি পায়ে? নিচে ঝুলছে দলিল দস্তাবেজ। একটা ব্যাপার দেখার আছে, সুকুমারের এই ড্রয়িংএ কিন্তু ক্যারেক্টারগুলি কার্টুন না। মানে মনে হচ্ছে একেবারে সত্যিকারের একটা কাকই এটা ধরে বসে আছে। সুকুমার যে কার্টুনের মত করে কাক আঁকতে পারতেন না এমন না, তার মানে এখানে রিয়েলিস্টিক করে কাক আঁকার একটা কারণ হতে পারে সেটা হল আঁকায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনা। মানে দেখে মনে হবে একেবারে আসল কাক, মানে হয়ত আসলেই এই কাক্কেশ্বর কুচকুচে কোথাও না কোথাও আছেন, আর খুচরা-পাইকারী হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছেন।

শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে

গেছোদাদা

একই গল্পের আরেক চরিত্র গেছোদাদা, সে যে কখন কোথায় থাকে তা বলাই এক মুশকিলের ব্যাপার। আর হযবরল এর সেই ফিচেল বেড়াল, যা কি না সুকমার সমগ্র বইয়ের প্রচ্ছদে এসে সব বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে ঢুকে গেছে। সেটার এক চোখ টেপা বাঁকা হাসি যেন সুকুমারের গোটা সাহিত্যের মূল মেজাজটাই ধরে বসে আছে। এই বিড়াল যারা দেখেছো আর হযবরল যারা পড়েছো তার নিশ্চই গল্পটার সাথে লুই ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্দারল্যান্ডের মিল পেয়েছো? বিড়ালটা সেই চেশ্যায়ার ক্যাটের মত না? হেঁয়ালী ভরা উক্তিতে যে চেশ্যায়ার ক্যাটকেও ছাড়িয়ে গেছে, যে কি না চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ (!) আর রুমালের মা মিলে যে বানিয়ে দিলো চশমা। নন-সেন্স মানে কিনা যার সরাসরি কোন মানে হয় না কিন্তু কোথাও আবার কোন ছন্দপতন নেই এমন প্রায় অসম্ভবের মত সাহিত্যের এই ধারাটি কিন্তু পৃথিবীতেই সহজলভ্য না। লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন- পৃথিবীর বহু দেশের বহু লেখকের লেখা তিনি পড়েছেন, অনেক ভাষা জানতেন বলে এমনকি অনেকগুলি মূল ভাষাতেই পড়েছেন কিন্তু সুকুমারের মত এমন উইটি আর ননসেন্স এক করে লেখার মত কাউকে পাননি। এ ব্যাপারে তাঁর মতে সুকুমার রায়ই বিশ্বসেরা। 

হযবরল এর বিড়াল 

সুকুমার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আঁকাআঁকি শেখেননি, তাই প্রথম দিকের বেশ কিছু ড্রয়িংএ কিছুটা নভিস ছাপ দেখা গেলেও পরের দিকে সেটা একেবারে পেশাদার আঁকিয়েদের মত হয়ে গিয়েছে। যেমন অবুঝ নামের ছড়ার এই আঁকা বা সাথের ‘দাঁড়ের কবিতা’র আঁকাটা খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে। যেমন কনফিডেন্ট লাইন, তেমনি রিদম আর কম্পোজিশন। বিশেষ করে দাঁড়ের কবিতার ড্রয়িং তো অনবদ্য। 


অবুঝ

দাঁড়ের কবিতা 


তবে আমার ব্যক্তিগত মত সুকুমারের ড্রয়িংএর মধ্যে সবচেয়ে দারুণ কাজটা হল তাঁর ট্যাঁশগরু, এখানে একই সাথে যেমন ক্যারেক্টার ডিজাইন, তেমন আঁকাআঁকির ব্যকরণের প্রয়োগ মিলে যাকে বলে হিরণ্ময়।


ট্যাঁশগরু

কিম্ভুত কিমাকার এই গরু হারুদের অফিসে বসে যেন জাবর কাটছে সুখে। ড্রয়িংটার বিশেষত্ব হল এখানে আঁকাআঁকির ব্যকরণ অনেকটাই সার্থকভাবে মানা হয়েছে। ডানদিকের কোণাকুণি একটা লাইট আসছে বলে তার বাম পাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছায়ায় মিলানো। সেটা করা হয়ছে শুধুমাত্র কলমের ক্রসহ্যাচ (কলমে এদিক ওদিক টেনে জালের মত করে যেই শেডটা দেয়া) করে। আর পশুর এনাটমিকে যথাসম্ভব সত্যিকারের মত করে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, আবারো সেই বিশ্বাসযোগ্যতা। মানে কিনা এই জিনিস আসলেই আছে। আর শেষ মুন্সিয়ানা হল গলার মাফলারটা। একেবারে ১০০% দেশী বাঙ্গালী বাবুটি যেন। চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত, ফিট্ফাট্ কালোচুলে টেরিখানা চোস্ত । যে আবার খায় খালি সাবানের সুপ আর মোমবাতি। পায়ের কাছে সম্ভবত সে দুটোই পড়ে আছে। যেমন ড্রয়িং তেমনি তার বর্ণনা, দুর্দান্ত ননসেন্স ছন্দমিল- 

ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে ;

যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে ।

...

একদিন খেয়েছিল ন্যাক্ড়ার ফালি সে-

তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে ।

সুকুমারের ড্রয়িং আর তাঁর লেখা আসলে একটা ছাড়া অন্যটা সম্পূর্ন হয় না। আর এই লেখার সাথে এই ড্রয়িংও আসলে একজনই করতে পারতো, সুকুমার নিজে।

আদিম কালের চাঁদিম হিম

ভাবতে পারো এই অসম্ভব গুণী মানুষটা মারা গিয়েছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে? এবং সেটা খুবই করুণ ভাবে। সে সময়ে একটা রোগ ছিলো স্থানীয়ভাবে যাকে বলত কালাজ্বর। জীবনের শেষ আড়াই বছরের বেশীরভাগই তাঁর কেটেছে রোগশয্যায়। এর মধ্যেও তাঁর কাজ কিন্তু থেমে ছিলো না। এমনকি প্রিন্টিং নিয়ে একাধিক নতুন টেকনিকের খসড়া করা ছিলো তাঁর সে সময়ের নোটবুকে। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি থামেনি। মুছে যায়নি মুখের হাসি। নিজের প্রথম বই আবোল তাবোল তখনো প্রেসে, সেটার শেষ ছড়াটি তিনি লিখে শেষ করলে বিছানায় শুয়ে।

আজকে দাদা যাবার আগে

বলব যা মোর চিত্তে লাগে-

নাই বা তাহার অর্থ হোক

নাইবা বুঝুক বেবাক লোক ।

...  ... ...  ...  ...  ...  

আদিম কালের চাঁদিম হিম

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,

গানের পালা সাঙ্গ মোর । 

ছড়াটিতেই কি টের পাচ্ছোনা যে একটা বিদায়ের সুর তিনি দিয়ে যাচ্ছেন? তাঁর মৃত্যুর ন’দিন পর বের হয় আবোল তাবোল। উদ্ভট খামখেয়ালে বাঙালি- বাংলা ভাষাভাষীদের একেবারে চিত্তের সাথে নিজিকে মিলিয়ে দিয়ে বিদায় নেন সুকুমার। তাঁর নিজের ভাষায়- ‘দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ’। সত্যি একেবারে তাই, দেহের বিনাশে তাঁর যেন কিছুই বিনাশ হয়নি। বরং নতুন করে প্রতিদিন তিনি জন্ম নিচ্ছেন প্রতিটি পাঠকের মধ্যে।

বি: দ্র: লেখাটির বেশ কিছু তথ্য দীপক সেনগপ্তের লেখা ‘চিরনবীন সুকুমার রায়’ নামের লেখা প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।

কিশোর আলো
সেপ্টেম্বর, ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment