Thursday, November 1, 2018

ভিআইপি

হঠাৎ করেই থেমে গেল সামনের ভীড়টা, একগাদা মানুষ পিলপিল করে ফুটপাথ আর তার পাশের রাস্তা মাড়িয়ে হনহন করে ছুটছিলো। হঠাত সামনে কী একটা ঘটতেই সবাই একসাথে থেমে গেল। ব্যপারটা বোঝার জন্যে ঝাঁকা মাথার কুলিমতন লোকটা গলা উঁচু করতেই সামনে থেকে মধ্যবয়স্ক দাড়িওয়ালা লোকটা খিস্তি করে বলে উঠলো-

-'দূরো মরার ভিআইপি!'

সবাই গুজগাজ করতে করতে দাঁড়িয়ে গেল, দুই একজন ভীড়ের ফাঁক গলে ড্যামকেয়ার ভাব করে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই দুবলা পাতলা একটা পুলিশ খ্যাক করে চেঁচিয়ে উঠল-

-'সরেন সরেন, পরে যান, দেখেন না ভিআইপি!'

- 'হালার ঠোলা। সেই আগের মধ্যবয়স্ক দাঁড়িয়াল আবার মন্তব্য করলো'

-'ভাই, এদের তো ডিউটি, কী করবে তারা?'
বল্লো এক ট্রান্সপারেন্ট ফাইল হাতে গলায় আইডি ঝোলানো স্মার্ট হবার চেষ্টারত মফস্বলী চেহারার আরেকজন।

-'মরার আর টাইম পায় না, এগো আলিদা সিটি কইরা দিলে পারে।'

-'হ্যাঁ বাইরে কিন্তু ব্যাপারটা ওইরকমই, দেখেন না বিজনেস ক্যপিটাল আর এডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপিটাল আলাদা? নিউ ইয়র্কের নাম জানে সবাই, কিন্তু মূল রাজধানী তো ওয়াশিংটন ডিসি।'

বলে সেই ট্রান্সপারেন্ট ফাইল ওয়ালা এদিক ওদিক তাকায়, সে যে বেশ খোঁজখবর রাখে এটা আর কেউ বুঝছে কি না সেটা দেখে। তার চোখ কোণাকুণি দাঁড়ানো এক তরুণির দিকে। তরুণিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে এরকম পাঁচপেঁচি জটলায় আটকে গিয়ে বেশ বিব্রত, হয়ত ওই পাড়ে গিয়ে তার গাড়িতে ওঠার কথা। হুট করে এরকম ভীড়ে আটকে কী করবে বুঝতে পারছে না।

-'হালাগো হেলিকপটার কিন্ন্যা দেয় না ক্যা? টাকা তো কম মারে না একেকজনে। নিজেরাই কিন্না উপরেদা' যায় না ক্যা?'

এবারে কথা বলে উঠল সেই যে প্রথমে পাড় হতে গিয়ে ধমক খাওয়া দুইজনের একজন। হারানো প্রেস্টিজ পুনরুদ্ধ্বারে তারা গলা উঁচিয়েই বলে ফেলে, ফলে সেই হ্যাংলা পুলিশ ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ভস্ম দৃষ্টি দেয় আর কর্কশ গলায় বলে-

-'পিছান, পিছে যান।'

ঠিক এই সময় ফুটপাথের সাথের রাস্তাটার তারস্বরে বাজতে থাকাএম্বুলেন্সটা সাইরেন বন্ধ করে দেয়। আর তারপরেই যেন সবাই জ্যামে আটকে থাকা এম্বুলেন্সটার অস্তিত্ব টের পায়। সবার চোখ এখন এম্বুলেন্সের দিকে।

-'রুগি মইরা যাউক, হ্যাগো যাইতেই হইবো এমনে রাস্তা আটকায়া। '

দুই একজন উঁকি দিয়ে এম্বুলেন্সের ভেতরে দেখার চেষ্টা করে।

-'রুগীর মাথাত ব্যান্ডিজ' মন্তব্য করে একজন। - 'কিটিকাল' সিরিয়াস মুখে আবার বলে সে।

ঠিক এই সময় আরেকটা সাইরেন শোনা যায়।

'-আইতাসে। বলে এবার আরেকজন।'

-'আসলে কী করবে বলুন এদের যে লাইফ রিস্ক...।'

বলে থেমে যায় আবার সেই ফাইল ওয়ালা। ভিড়ের কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, শার্ট প্যান্ট টাক ইন করে সে নিজে রাস্তার এপাড়ে দাঁড়িয়েও যে ভিআইপির সাফাই গাইছে এটা কারোরই পছন্দ হচ্ছে না।

জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা এম্বুলেন্সের ড্রাইভার এবার নেমে একটা সিগারেট ধরায়।

-'হুই যে কালা গাড়ি, পিছে দেখবেন একটা এম্বুলেন্সও থাকবো সবসময়।'
বিজ্ঞ মন্তব্য ঝাড়ে সে। একটু পড়ে আসলেই দেখা যায় সেটা। নিঃশব্দে প্রায় ভুতূরে ভঙ্গীতে ঢাকার রাস্তায় অবিশ্বাস্য গতিতে একের পর এক গাড়ি যেতে থাকে। ভীড়ের মধ্য থেকে টুকটাক আরো কিছু মন্তব্য আসতে থাকে।

-'আসল গাড়ি কুনডা সেইটা কিন্তু কেউ জানে না। দুইটা দেখেন একই গাড়ি গেল, এডির মধ্যে কোন একটায় আছে। আর কি।'

-'এইটা কে পিএম? না প্রেসিডেন?'

-'জানি না, হইবো একটা কিছু।'

-'যাউক ছাড়বো এইবার।'

সত্যি-ই সামনের সেই হ্যাংলা পুলিশটার সিনিয়র অফিসার ধরনের যে সয়াবিনের প্লাস্টিক ড্রামের মত দেখতে আরেকজন পুলিশ ছিলো সে হাত নেড়ে সিগন্যাল ছেড়ে দেবার ইশারা করে। ঠিক তখনই জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা এম্বুলেন্সটার ভেতর থেকে হঠাত চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। নিচে নেমে আসা ড্রাইভার ত্রস্ত ভঙ্গীতে গিয়ে সিটে বসে।

-'ভাই মইরা গেছে নাকি?'

-'আল্লা জানে'- বলে দুই একজন আবার উঁকি ঝুঁকি মারার চেষ্টা করে।

কিন্তু কিছু দেখার আগেই সিগন্যাল ছাড়া পেয়ে টান দিয়ে এম্বুলেন্সটা ছেড়ে যায়, পথচারিদের ভীড়টাও হঠাত ক্ষেতের আল ভেঙে নেমে পড়া পানির মত রাস্তাটায় নেমে পড়ে, শুধু সেই তরুণী মেয়েটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে হারিয়ে যেতে থাকা এম্বুলেন্সটার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে, তারপর আবার নেমে পড়ে রাস্তা পাড় হতে, যার জন্য ওপারে হয়ত একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে।

তিন প্রস্থ


বুঝলেন নাকি? আমার সেই কেসটা তো জিতে গেছি প্রায় এখন। নীতু এখন আমার বাসায় এলো বলে। সেই যে বললাম না? কেস চলছিলো? আমাকে অপহরণ মামলা দিয়েছিলো- বলুন কী অবস্থা। নীতু তো ক্ষেপে গিয়েছে বুঝলেন? ও তো আবার বেশ মাথা গরম। আমি মানা করেছি মাথা গরম করতে। কিন্তু ও বলে- বাবা, তুমি দেখে নিও, আমি ওদের একটা বিচার করেই ছাড়বো। আমি বলি- মা শোন, এটা কোন সমস্যাই না। এই মামলা টিকবে না। বুঝলেন? ওই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দিয়েছে। সেটা অ-জামিন যোগ্য কি না। আমার অবশ্য জামিন হয়েছে। আমার এক বন্ধু আছে। এখন ফুল সচিব। সেও তো শুনে ক্ষেপে টেপে শেষ। ও ছিলো আমার ব্যাচমেট, আমরা পিএটিসিতে একত্রে ট্ররেনিং এ ছিলাম কি না। আরেক বন্ধু, সে আইজি এখন সেও কল দিলো।  আমি কিন্তু জানেন কাউকে কিছু বলিনি। ওরা যে কিভাবে খবর পায়, আসলে আমার বন্ধুরা আমাকে বেশ ভালোবাসে । সে বল্লো শোন মশিউর- তোর কোন চিন্তা নেই। আমরা নীতুর স্টেটমেন্ট নিচ্ছি। তোর বউ আর ওই লোক কী অভিযোগ করেছে তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। মূল ব্যাপারটা ওর স্টেটমেন্ট।  শোন আমি ওসিকে বলে দিচ্ছি- ও আবার খুব অনেস্ট বুঝলেন কিনা? বল্লো ওসিদের কী বলব? ওদের সাথে কথা বলে মুখ ধুয়ে নিতে হয় সাতবার, তার চেয়ে আমার কলিগদের দিয়ে বলিয়ে দিচ্ছি। তা ও বলেও দিয়েছে জানেন? আমি থানায় যেতেই ওসি দাঁড়িয়ে রীতিমত সেলুট। আমি বললাম ছি ছি আপনি আমাকে স্যালুট দিচ্ছেন কেন? ওসি বললেন- স্যার আপনি কে আমরা কি জানি না? না হয় এখন আর সার্ভিসে নেই, চাকরি ছেড়েছেন কিন্তু আমরা তো ছাড়িনি। একবার স্যার সবসময়েই স্যার। আমি তো লজ্বায় শেষ। ওরা বলল ওরা স্টেটমেন্ন্ট নাকি নিয়ে এসেছে, নীতু স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে পৃথিবীতে সে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে তার বাবাকে, বাবা তাকে অপহরণ করেনি। বলেন তো কি লজ্জ্বার ব্যাপার?  এসব নিয়তে বাইরের মানূষের সামনে কথাবার্তা চলছে। আসলে আমার স্ত্রী- মানে প্রাক্তন স্ত্রী আরকি। ক্ষোভ থেকে মামলাটা করেছে, আসলে ও-ও করেনি। আমার কি মনে হয় জানেন? মনে হয় ওই লোকটা মনে হয় চাইছেই যাতে এমন একটা কিছু হয়ে নীতু আমার কাছেই চলে আসুক। তাই তো হচ্ছে না? কী বলেন? ভালোই হচ্ছে আসলে। এই তো এই মামলাটা পার হয়ে গেলাম, এবারে আমি ক্লেইম করবো। হয়ে যাবে দেখবেন। নীতু যে কি কষ্টে আছে। মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন দেয়। আমি দিতে পারি না, ফোনটা তো ওর মায়ের... ও দিলে ধরতে পারি। আবার ওর মা যদি দেখতে পায় ও আমাকে কল করেছে। অনেক রাগ করে। ও কি বলে জানেন? বলে বাবা- জানো? আমি কক্ষণো ওদের সাথে খাই না। যদিও আমি জানি তুমি আমার জন্যে টাকা পাঠাও, খাওয়া পরার সব পাঠাও তা-ও। আমার অনেক অস্বস্তি লাগে। আর ওই লোকটা এমন সব কথা বলে আমার কি যে খারাপ লাগে। আমি কোন জবাব দি-ই না। মাকে আগে বলতাম, কিন্তু সে উলটো বকা দিতো, এখন আর তাকেও বলি না। আমি বলি- আহা বোকা মেয়ে, সে তো এখন আরেক বাড়ির বউ, তাঁকে তো সেদিক রক্ষাকরে কথা বলতেই হবে, সে আসলে তোকে ভালোবাসে ওগুলো বাধ্য হয়ে করছে। নীতু মানতে চায় না, বলে-আমি এখন সারাদিন একা একা বসে থাকি আর পড়ি। জানো বাবা আমি কত কিছু পড়ে ফেলেছি? ভালো কথা বাবা, তুমি কিন্তু আমাকে হ্যারি পটারের সাত নাম্বারটা এনে দেবে। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে শুধু ৬ পর্যন্ত আছে, আমিতো আর হ্যারি পটার কিনতে ওদের কাছে টাকা চাইতে পারবো না... মেয়েটা এত শার্প হয়েছে বুঝলেন? আমাকে বলে, বাবা- তুমি যে মার্কেস পড়ো, চিনুয়া আচেবে না কি যেন অদ্ভূত একটা নাম আছে না আফ্রিকান রাইটার? ওর লেখাগুলি পড়? তুমি বোঝো? হাহা, বোঝেন মেয়ে আমার কি পাগল। সে ওই বইগুলিও ঘেঁটে দেখে। মাঝে মাঝে বাসায় নিয়ে আসতাম যখন আগে যখন তখন আমার লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখতো। আমি আর কী বলবো? মেয়েটা আমার মনে হয় এই সেদিন জন্মালো। এখন প্রায় সাড়ে তেরো! স্কুলে কিন্তু দারুণ ফেমাস সে। এখন তো সে আবার প্রিফেক্ট। ও বলে যে ওর ভালো লাগে না, কিন্তু টিচাররা ওকেই বানাবে। ও ওদের মধ্যে সবথেকে ভালো রেজাল্ট করে, আর খুব পার্সোনালিটি। বলে বাবা আমি আর একটু বড় হয়ে নেই, তোমাকে নিয়ে আমি অন্য কোন দেশে চলে যাব। দেখে নিও, আমি বেশ ভালো স্কলারশিপ পাবো তখন ওই মহিলা আর  লোকটার থেকে তোমাকে অনেক দূরে নিয়ে যাব। আমি বকা দিই- ছিহ্‌ সে না তোমার মা? তাকে মহিলা মহিলা বলছো কেন? খারাপ কিছু তো বলিনি বাবা, সে তো মহিলাই- টেকনিক্যালি কারেক্ট। আর আমার রাগ হলে আমি মনে মনে আরো অনেক বিশ্রী গালাগাল দেই, আমি এখন অনেক বাজে বাজে গালাগাল জানি। আমাদের স্কুলে থেকে শিখেছি। বোঝেন অবস্থা, বাবাকে এসে বলছে সে নাকি বাজে গালি শিখেছে, মেয়েটা একেবারে স্বাভাবিক ভাবে মানুষ হচ্ছে না , আহা, কবে যে আসবে আমার বাসায়। আমি জানেন ওর একটা ঘর সাজিয়ে রেখেছি। যখন যা ভালো আগে মনে হয় ওর ভালো লাগবে সেটা এনে সাজিয়ে রেখে দি' ওকে জানাইও না, এসে অবাক হয়ে যাবে। আমি ওই হ্যারি পটার না কি সেটা পড়িও নি। আমি পড়ি ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য, বা জার্মান লিটারেচার, ফ্রেঞ্চ ও পড়ি। এখন তো আর লেখা হয় না, তবে নীতু চলে এলে আবার লেখা শুরু করবো। আমি আমার স্ত্রীকে কখনই ডিভোর্স দিতাম না হয়ত, কিন্তু কি জানেন? আমার ভাই বোনের দেওয়ালো...। আসলে ওদেরও দোষ না। সে সারাদিনই ওই ভদ্রলোকের সাথে ঘুরতো। আমি না থাকলে সে বাসায় আসতো, নীতু নাকি চিৎকার করে উঠতো লোকটা এলেই। ভাবুন। ওইটুকু বাচ্চা সে তখন দুই কি তিন বছর। কি-ই বা বোঝে? কিন্তু বাবা নেই যখন তখন অন্য মানুষ কেন বাসায় এটা  নিয়ে সে বিরক্ত হত। আসলে চারিদিকে এমন জানাজানি হয়ে গেলো না... আমি ওকে দোষ দি-ই না। ওর আমাকে আর ভালো লাগছিল না। হয় না?
হঠাত করে প্রেমটা মরে গেল?
মানুষের মন- আহা।

আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম, দোয়া করবেন।  সামনে মামলার রায়। আমার বিশ্বাস নীতুকে আমি পাবোই।
আসি কেমন?

----
রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে, সেই বদের হাড্ডিটা কেস জিতে যাচ্ছে। ওর কী সব বন্ধু আছে না সরকারী আমলা? ওদের প্রভাব খাটাচ্ছে! যত্তসব! আমি যে কী করি। কথার যাদুতে নিজের মেয়েটাকেও একেবারে ন্যাওটা বানিয়ে ফেলেছে। তা কথা বলতে পারে বটে লোকটা , কথা বলে বলেই তো... আর হ্যাঁ, দোষ তো সবসময়ে আমারই, আমি মেয়ে না? একজনের সাথে বনেনি বলে ঘর ছাড়বো বলে সবাই রীতিমত চরিত্র তুলে কথা বললো। এই সমাজের মুখে থুতু! ওপরে ওপরে সব চরিত্রবান সাবিত্রী, আমি তো লুকিয়ে কোন অপরাধ করছি না তাই সব দোষ আমার। শাহেদেরও দোষ, সে কেন আরেকজনের বউ ভাগিয়ে নিল। আরে বাবা, আমি তো আর আরেকজনের বউ নই মনে প্রাণে, কেউ আমাকে ভাগিয়েও নেয় নি। ওই দোজখে আমার একদিনও থাকা সম্ভব ছিল তুই বল। ও এক ভ্যবানন্দ আর ওর মা-টা একটা ডাইনি, বলবো না বলছিস? কেন আমার কি একটা জীবন নেই? বিয়ের আগে ও আমাকে বলেছিলো তারা তিন পুরুষের শিক্ষিত, মা অনেক উদার। আমার চাকরী বাকরী কোন সমস্যাই না, উনি নিজেও চাকরি করতেন। কিসের কী! সিক্সটিজে মডার্ন স্লিভলেজ ব্লাউজ পরে ঘুরতেন যিনি হালে বুড়ি হবার সাথে সাথে হজ্ব করে তাপসী রাবেয়া সেজেছেন, আমাকে বলে মেয়েদের চাকরি না করাই ভাল, ছেলেমেয়ে নাকি মানুষ হয় না। ছেলেমেয়ে কি সব মেয়ে মানুষের? বাচ্চা মানুষ করা আমাদের একার কাজ? আর সেটা তো ও-ও বলেনি আমাকে, বলেছেন উনি, নিজে একজন মহিলা। এটা কেন হয় জানিস? হিংসা, নিজে ক্যারিয়ার করতে পারেনি এখন ধর্ম্পরায়ন ভিক্টরিয়ান সাবিত্রী সেজেছেন। দেখ, নিজের বাচ্চাকে কেউ ফেলে আসতে চায়? আমার নীতু... ... ... নীতু... নীতুকে আমি কতদিন দেখি না রে। আর ও কেন একটু সাপোর্ট দিলো না আমাকে? আমি কি ওকেও ভালোবাসতাম না? ও কেন বল্ল একটু মায়ের মত করে মানিয়ে চল? ও কি আর 'ও' থাকলো তাহলে? সেই বাম পলিটিক্স করা, তুখোড় ছেলেটা, আমাকে কি অনায়াসে আয়ত্ত্ব করে ফেলেছিলো, কী অসাধারণ লেখার হাত ছিলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম ও একটা কিছু করবেই জীবনে। অনেক বড় লেখক হবে, আমরা একসাথে ঘুরবো দেশ বিদেশ, আর ও লিখে যাবে একের পর এক বই। আমি সাথে থেকেই তো খুশী ছিলাম। কিন্তু কেন ও ওর মায়ের সাথে আমাকে চার দেয়ালে আটকে ফেলতে চাইলো? মেয়েরা চাকরী করলেই তারা ক্যারিয়ারিস্ট? সংসারের দিকে মন নেই? আর ছেলেরা? তারা সময় দিক বাচ্চাদের। এটা বললেই আমি সর্বনাশা, বাজে মেয়ে? আমি ...আমি কতদিন নীতুকে দেখি না রে... ... ... আমি কি ঠিক করে কথা বলছি না, অগোছালো হয়ে যাচ্ছে? এক কথা আজকাল বার বার বলি। শাহেদও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যায়। ওর কী দোষ, ও এখন আরেক কমপ্লক্সে। আমি কি আসলেই ওকে পছন্দ করেছি নাকি খালি ওই বাড়ি থেকে মুক্তি পেতে ওকে ব্যবহার করেছি। আমি জানি না কী করবো রে। ওকে আমি পছন্দ না করলে কি ওর সাথে বের হয়ে আসার মত এত বড় সিদ্ধান্ত নিতাম? কী বললি? আমার বাসা? হাহা,তারা আমাকে অনেক আগেই ত্যাগ করেছে, নীতু... নীতুও আমার সাথে কথা বলে না রে... আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
না, আমি ভাল থাকবো, নাইলে ওই বুড়িটারই জিত হয়ে যাবে। রাখি রে, আমি আর পারছি না। না না ভয় নেই, উল্টোপাল্টা কিছু করবো না, অত পাগল হই নি এখনো।

----
আকাশের নীলটা একটু গাঢ় আজ, কালচে গাঢ়,  এটাকে বলে প্রুশিয়ান ব্লু । নীল রঙটা আমার এত পছন্দের, আমি নীলের সব শেড মুখস্ত করে ফেলেছি। আমার আসলে রঙই অনেক পছন্দ। এই আকাশটাই কিছুক্ষণ আগে ছিলো কোবাল্ট ব্লু । আমাদের ড্রয়িং টিচার খুব ঢং করে রঙের নাম শিখায়, সে যে কত জানে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে। কথায় কথায় সেদিন নীল রঙ নিয়ে বললো, 'মাতিসের ব্লু পিরিয়ডের কাজ'- এত অশিক্ষিত, ব্লু  পিরিয়ডিক কাজ হল পিকাসোর। ঠিক ঠাক বলতে পারিস না বলতে যাস কেন? একটু গুগল করে নিলেও তো হয়। আমি বাবার লাইব্রেরি থেকে কন্টেম্পোরারি আর মডার্ন সব পেইন্টারদের নাম পড়ে নিয়েছি, তুলুস লুত্রেক, আঁরি মাতিস, এদগার দেগা, মঁদলিয়ানি-

লুত্রেক ডিজ্যাবল ছিলেন, একটা পা ছোট ছিল। আমার এটা খুব রোমান্টিক লাগে, মনে হয় একটা এমন কিছু থাকা উচিত শিল্পীদের। শিল্পী বিনোদ বিহারী শেষ বয়সে চোখে দেখতেন না, বেথোফেন শেষের দিকে কানে শুনতেন না। একটা কিছু এমন না হলে ঠিক দুঃখটা বোঝা যায় না। পূর্ণ মানুষ তো ব্যর্থ মানুষ।

আমার মনে হয় আমিও বিরাট একটা কিছু হয়ে যাব একদিন। কেন জানি না, খুব করে মনে হয় এমন কিছু হোক। স্কুলের গেটের কাছে নামার সময় মনে হয় অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে যদি একটা পা কাটা পড়ত, বা মনে কর হঠাত করে উলটো দিকের কোন গাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়া ধারালো কিছুতে একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল, না দুইটা চোখই চলে গেলে আবার বেশি বেশি হয়ে গেল। অথবা মনে কর ইস্পাত বইয়ের লেখক, নিকোলাই অস্ত্রভস্কির মত মোটামুটি পুরোই অচল হয়ে গেলাম, শুধু একটা হাত সচল, সেটায় কি বোর্ড সম্বল করে লিখে যেতে থাকতাম আর লিখে যেতে থাকতাম।

আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আর। শুধু তোমার সাথে কথা বলি, আসলে বলি বলা ঠিক হলো না, তোমার ওপর লিখি। তুমি তো আর জবাব দিতে পারো না। তাও তুমি-ই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার মন এখন মোটেও ভাল নেই জানো? মা ফোন করেছিলো, আমি কাটা কাটা কথা বলেছি, হ্যাঁ আর না দিয়ে যতটুকু সম্ভব। মা ওপাশে কাঁদতে শুরু করল, আমি ফোন কেটে দিলাম। আর তারপর এপাশে চিতকার করে কাঁদা শুরু করলাম। দাদি তার হুইলচেয়ার চালিয়ে সাথে সাথেই দরজায় চলে এল। আমি থেমে গেলাম, এটা ইদানীং খুব ভালো পারি, হঠাত করে ইচ্ছামত কেঁদে টেদে আবার হুট করে থেমে যাই। দাদি অনেক্ষণ দরজার সামনে এসে আমাকে আদর করে ডেকে গেল, আমি কোন জবাবই দিলাম না, দাদিকে আমি কী ভালোবাসতাম! আসলে এখনো বাসি, সে যে কি দারুণ কিউট। কিন্তু সব কেমন হয়ে গেল, না? আমার কি মনে হয়ে জানো? মনে হয় আমি-ই সব কিছুর জন্যে দায়ী, আমার জন্ম না হলে আম্মুকে কেউ বলতো না বাচ্চা মানুষ করতে হবে, আব্বু আর আম্মু এখনো প্রেম প্রেম ভাব করে ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যেত, দাদি স্বাভাবিকভাবে তার বাড়িঘরের দেখাশোনা করত। আমার জন্মটাই সব পালটে দিলো। কিন্তু সেটাতে তো আমার কোন হাত ছিলো না। আমি কী করবো বলবে তুমি? তুমি কেন কিছুই বলতে পারো না?  তুমি কথা বলতে পারলে খুব ভালো হত। আমার ইদানীং মনে হয় আমি হুট করে মরে টরে যাই যদি তাহলে সবাই আগের মত হয়ে যাবে- না সেটাও বোধহয় হবে না। সেই অন্য লোকটা, আম্মু যাকে বিয়ে করেছে। ওই বদটা। ও বদটা আমার দিকেও বিশ্রী করে তাকায়! ভাবতে পারো? ছিহ্‌! ঘেন্নায় আমি দম বন্ধ করে বসে থাকতাম। আম্মুর সাথে এমনি কথা বলি না, তার ওপর এটা আমি বললে মনে হয় মেরেই বের করে দিত ওদের বাসা থেকে। বাবাকেও বলিনি... আসলে কাউকে কিছু আর বলতেও ইচ্ছে করে না এখন।
আচ্ছা সবারই কি এরকম সমস্যা হয়?
আমার আজকাল একটা রঙ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে জানো? নীলের কোন একটা শেড, বা সবুজের- মনে কর তকতকে সবুজ স্যাপ গ্রিন, বা ভিরিদিয়ান। আমার মনে হয় পিকাসোরও এমন একটা কিছু হয়ে যেতে ইচ্ছে হত। হঠাত করে তাই সে নীল হয়ে গিয়েছিলো। আমিও একদিন কোন একটা রঙ হব।
দেখে নিও।