Thursday, November 1, 2018

ভিআইপি

হঠাৎ করেই থেমে গেল সামনের ভীড়টা, একগাদা মানুষ পিলপিল করে ফুটপাথ আর তার পাশের রাস্তা মাড়িয়ে হনহন করে ছুটছিলো। হঠাত সামনে কী একটা ঘটতেই সবাই একসাথে থেমে গেল। ব্যপারটা বোঝার জন্যে ঝাঁকা মাথার কুলিমতন লোকটা গলা উঁচু করতেই সামনে থেকে মধ্যবয়স্ক দাড়িওয়ালা লোকটা খিস্তি করে বলে উঠলো-

-'দূরো মরার ভিআইপি!'

সবাই গুজগাজ করতে করতে দাঁড়িয়ে গেল, দুই একজন ভীড়ের ফাঁক গলে ড্যামকেয়ার ভাব করে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই দুবলা পাতলা একটা পুলিশ খ্যাক করে চেঁচিয়ে উঠল-

-'সরেন সরেন, পরে যান, দেখেন না ভিআইপি!'

- 'হালার ঠোলা। সেই আগের মধ্যবয়স্ক দাঁড়িয়াল আবার মন্তব্য করলো'

-'ভাই, এদের তো ডিউটি, কী করবে তারা?'
বল্লো এক ট্রান্সপারেন্ট ফাইল হাতে গলায় আইডি ঝোলানো স্মার্ট হবার চেষ্টারত মফস্বলী চেহারার আরেকজন।

-'মরার আর টাইম পায় না, এগো আলিদা সিটি কইরা দিলে পারে।'

-'হ্যাঁ বাইরে কিন্তু ব্যাপারটা ওইরকমই, দেখেন না বিজনেস ক্যপিটাল আর এডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপিটাল আলাদা? নিউ ইয়র্কের নাম জানে সবাই, কিন্তু মূল রাজধানী তো ওয়াশিংটন ডিসি।'

বলে সেই ট্রান্সপারেন্ট ফাইল ওয়ালা এদিক ওদিক তাকায়, সে যে বেশ খোঁজখবর রাখে এটা আর কেউ বুঝছে কি না সেটা দেখে। তার চোখ কোণাকুণি দাঁড়ানো এক তরুণির দিকে। তরুণিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে এরকম পাঁচপেঁচি জটলায় আটকে গিয়ে বেশ বিব্রত, হয়ত ওই পাড়ে গিয়ে তার গাড়িতে ওঠার কথা। হুট করে এরকম ভীড়ে আটকে কী করবে বুঝতে পারছে না।

-'হালাগো হেলিকপটার কিন্ন্যা দেয় না ক্যা? টাকা তো কম মারে না একেকজনে। নিজেরাই কিন্না উপরেদা' যায় না ক্যা?'

এবারে কথা বলে উঠল সেই যে প্রথমে পাড় হতে গিয়ে ধমক খাওয়া দুইজনের একজন। হারানো প্রেস্টিজ পুনরুদ্ধ্বারে তারা গলা উঁচিয়েই বলে ফেলে, ফলে সেই হ্যাংলা পুলিশ ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ভস্ম দৃষ্টি দেয় আর কর্কশ গলায় বলে-

-'পিছান, পিছে যান।'

ঠিক এই সময় ফুটপাথের সাথের রাস্তাটার তারস্বরে বাজতে থাকাএম্বুলেন্সটা সাইরেন বন্ধ করে দেয়। আর তারপরেই যেন সবাই জ্যামে আটকে থাকা এম্বুলেন্সটার অস্তিত্ব টের পায়। সবার চোখ এখন এম্বুলেন্সের দিকে।

-'রুগি মইরা যাউক, হ্যাগো যাইতেই হইবো এমনে রাস্তা আটকায়া। '

দুই একজন উঁকি দিয়ে এম্বুলেন্সের ভেতরে দেখার চেষ্টা করে।

-'রুগীর মাথাত ব্যান্ডিজ' মন্তব্য করে একজন। - 'কিটিকাল' সিরিয়াস মুখে আবার বলে সে।

ঠিক এই সময় আরেকটা সাইরেন শোনা যায়।

'-আইতাসে। বলে এবার আরেকজন।'

-'আসলে কী করবে বলুন এদের যে লাইফ রিস্ক...।'

বলে থেমে যায় আবার সেই ফাইল ওয়ালা। ভিড়ের কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, শার্ট প্যান্ট টাক ইন করে সে নিজে রাস্তার এপাড়ে দাঁড়িয়েও যে ভিআইপির সাফাই গাইছে এটা কারোরই পছন্দ হচ্ছে না।

জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা এম্বুলেন্সের ড্রাইভার এবার নেমে একটা সিগারেট ধরায়।

-'হুই যে কালা গাড়ি, পিছে দেখবেন একটা এম্বুলেন্সও থাকবো সবসময়।'
বিজ্ঞ মন্তব্য ঝাড়ে সে। একটু পড়ে আসলেই দেখা যায় সেটা। নিঃশব্দে প্রায় ভুতূরে ভঙ্গীতে ঢাকার রাস্তায় অবিশ্বাস্য গতিতে একের পর এক গাড়ি যেতে থাকে। ভীড়ের মধ্য থেকে টুকটাক আরো কিছু মন্তব্য আসতে থাকে।

-'আসল গাড়ি কুনডা সেইটা কিন্তু কেউ জানে না। দুইটা দেখেন একই গাড়ি গেল, এডির মধ্যে কোন একটায় আছে। আর কি।'

-'এইটা কে পিএম? না প্রেসিডেন?'

-'জানি না, হইবো একটা কিছু।'

-'যাউক ছাড়বো এইবার।'

সত্যি-ই সামনের সেই হ্যাংলা পুলিশটার সিনিয়র অফিসার ধরনের যে সয়াবিনের প্লাস্টিক ড্রামের মত দেখতে আরেকজন পুলিশ ছিলো সে হাত নেড়ে সিগন্যাল ছেড়ে দেবার ইশারা করে। ঠিক তখনই জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা এম্বুলেন্সটার ভেতর থেকে হঠাত চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। নিচে নেমে আসা ড্রাইভার ত্রস্ত ভঙ্গীতে গিয়ে সিটে বসে।

-'ভাই মইরা গেছে নাকি?'

-'আল্লা জানে'- বলে দুই একজন আবার উঁকি ঝুঁকি মারার চেষ্টা করে।

কিন্তু কিছু দেখার আগেই সিগন্যাল ছাড়া পেয়ে টান দিয়ে এম্বুলেন্সটা ছেড়ে যায়, পথচারিদের ভীড়টাও হঠাত ক্ষেতের আল ভেঙে নেমে পড়া পানির মত রাস্তাটায় নেমে পড়ে, শুধু সেই তরুণী মেয়েটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে হারিয়ে যেতে থাকা এম্বুলেন্সটার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে, তারপর আবার নেমে পড়ে রাস্তা পাড় হতে, যার জন্য ওপারে হয়ত একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে।

No comments:

Post a Comment