Thursday, April 29, 2021

অজগর স্যার ও চন্দ্রা

মানহাদের বিজ্ঞান স্যার- আজগর সাত্তার- খুবই রাগী ধরনের, বিজ্ঞান পড়ানোর সময় ভয়ংকর কিছু মুখভঙ্গি করে চোখমুখ কুঁচকে কথা বলেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ঠোঁট সরু করে জিবটা বারবার সাপের মত করে বের করেন, ফলে তাঁর আরেকটা নাম হয়ে গেছে- অজগর স্যার। তাঁর মূল সমস্যাটা হল তিনি বিজ্ঞানে যা-ই পড়ান, পড়ানোর পরে ক্লাসের সবার দিকে তাকিয়ে বলেন

- ‘এইগুলা ভুয়া কথা। বাইরের বিজ্ঞানীদের বুজরুকি। পরীক্ষার জন্যে পড়তেছো পড়ো, বিশ্বাস করা লাগবে না’। আর কেউ কিছু জানতে চাইলেই উলটা ধমক দেন। বলেন-

- ‘আসছে আমার আইনস্টাইন, বইয়ে যা আছে পড়ো’।

ক্লাসে এখন পেটানো নিষেধ কিন্তু এই স্যার মুখে কথা বলে যা করেন তা পেটানোর চেয়ে কম না।

মানহাদের ক্লাসের কেউই এই স্যারকে দেখতে পারে না, নাফিসা, জিশান, রাবিদ সবাই বিরক্ত। বিজ্ঞান বিষয়টার উপরেই তাদের বিরক্তি এসে গেছে। এইরকম একদিন হঠাত তাদের ক্লাসে নতুন এক মেয়ে ভর্তি হল। মেয়েটা অদ্ভূত ধরনের। ক্লাস ফাইভের যে কারো তুলনায় বেশ ঢ্যাঙ্গা, গায়ের রঙ খয়েরি ধরনের, কান দুটো কেমন বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকে। প্রথমদিন মেয়েটা কারো দিকে তাকালোই না, পুরোটা সময় মুখ  নিচু করে বসে থাকলো। বেশী ভাব নিচ্ছে মনে করে মানহাও পাত্তা না দেবার চেষ্টা করলো। পরেরদিনও একই অবস্থা, তার পরের দিন মানহা ঠিক করলো এই মেয়েকে সে জীবনেও নাম জিজ্ঞেস করবেনা, ঢঙ্গী একটা। কিন্তু সেদিন ক্লাসে ঢুকেই যা ঘটলো!

- সেদিনও অজগর স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন, সেদিন মানুষের চাঁদে অভিযানের কথা পড়াচ্ছিলেন। আর্মস্ট্রং কিভাবে চাঁদে নেমেছেন সেটা পড়ার পড়েই তিনি বইটা বন্ধ করে বললেন

- ‘কী দূর্ভাগ্য যে এইসব বুজরুক আমাদের পোলাপানদের পড়াতে হচ্ছে, চাঁদে কি মানুষ যাইতে পারে? আর এইটা এখন ইন্টারনেটেও প্রমাণ করছে যে চাঁদে আসলে মানুষ যায় নাই। এইসব মিথ্যা-সিথ্যা আমাদের পড়তে হইতেছে আফসোস। তোমরাই বলো, শুন্যে আবার রকেট ওড়ে কিভাবে? সেইখানে বাতাস আছে? এম্নেই তো টূপ কইরে সেটা পড়ে যাবার কথা, কি বলো সবাই?

‘জ্বী স্যার!’ অজগর স্যারের কথার সাথে গলা না মিলালে তার পরিণাম আরো খারাপ হতে পারে।

‘সেটাই, এইগুলা হলিউডে বানানো সিনেমা, তোমরা চাইলে আমার মোবাইলে দেইখা যাইতে পারো, মানুষ ওইভাবে হাল্কা লাফ দিয়া দিয়া হাঁটতে পারে কখনও?’।

জ্বী না স্যার! আবার সবাই বললো। অজগর স্যার হাসিমুখে মাথা নাড়তে নাড়তে ক্লাস শেষ করে দিতে যাচ্ছিলেন সেই সময় ঘটলো ঘটনাটা।

রিনরিনে একটা গলা ভেসে এলো ক্লাসের একেবারে শেষের কোণার দিক থেকে-

‘পারে স্যার’-  সেই নতুন মেয়েটা! বেচারী জানে না কী ভুল করলো!

অজগর স্যার প্রথমে মনে হয় বোঝেন নি, তাই আবার সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি, পারে?’

আবার উত্তর এলো

‘জ্বী’

সবাই দম বন্ধ করে কোণার মেয়েটার দিকে তাকালো, মেয়েটা এই প্রথম চোখ তুলে সোজা তাকিয়েছে।

কী বল্লা তুমি? তুমি ইন্টারনেটের প্রমাণ দেখতে চাও?

না স্যার, ওগুল হোক্স, মানে ফেইক নিউজ, আর ইন্টারনেটের নিউজ বলে কিছু নেই, কোন একটা সাইট থেকে এগুলি ছড়ানো হয়।

মানে? আচ্ছা, তুমি কি মনে কর আমি মিথ্যা বলতেসি? সবাই টের পাচ্ছে অজগর স্যার ভয়ানক রেগে যাচ্ছেন। কোন একটা ছুতোয় নতুন মেয়েটাকে বকার সুযোগ খুঁজছেন।

না, তবে ভুল বলছেন।

মানে??

‘মানে আপনি বিজ্ঞান কী সেটাই বোঝেন না, এবং সেই সাথে বদরাগি, আমাদের আগের স্কুলে হলে আপনাকে টিসি দেয়া হত’।

মানহা আক্ষরিক অর্থে দম বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মেয়েটার সাহস দেখছিলো।

‘স্যারকে টিসি?? হাহাহা!’ অজগর স্যার কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করলেন, আচ্ছা তার মানে তুমি বলতে চাইতেসো রকেট শুণ্যে ভাসে বাতাস ছাড়াই?

‘হ্যাঁ’।

‘মানুষ লাফায়ে লাফায়ে এভাবে ব্যাঙ্গের মত ওড়ে? বলে স্যার খুবই হাস্যকর ভাবে নভোচারীদের লাফ ব্যাংঙ্গ করার চেষ্টা করলেন’।

হ্যাঁ।

‘আর কী পারে? বল্‌’। অজগর স্যার রাগে হাঁফাচ্ছেন।

‘অনেক কিছুই পারে, টেলিকাইনেসিস এখনো আপনারা জানেন না, সেটা জানলে যে কোন অবসস্থাতেই গ্রাভিটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যে কোন মাধ্যমে আপনি ভরশুণ্য হয়ে উড়তে পারবেন’।

‘ফাজিলের ফাজিল, মিথ্যুকের মিথ্যুক। এইটারে উড়া’- বলে অজগর স্যার তার হাতের ডাস্টারটা ছুঁড়ে মারলেন মেয়েটার দিকে। এবং পুরো ক্লাস স্তম্ভিত হয়ে দেখলো সেটা শুণ্যেই ঝুলে ঝুলে আবার স্যারের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লো। স্যার কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থেকে অবাক হবার বদলে এবারে গ্যাঁ গ্যাঁ করতে করতে ছুটে মেয়েটাকে ধরার জন্যে লাফ দিলেন, আর কি আশ্চর্য। স্যার অবিকল নীল আর্মস্ট্রং এর মত হালকা একটা গ্যাস বেলুনের মত ছাদের কাছে পৌঁছে আবার একটা পালকের মত নীচে নেমে এসে ড্রপ খেলেন, এইবারে স্যার ভয় পেলেন। পুরো ক্লাস হঠাত সম্বিত ফিরে পেয়ে চেঁচাতে লাগলো, নাফিশা ফিট হয়ে পড়ে গেল, জিশান কী করবে না বুঝে তালি দেয়া শুরু করলো, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা অজগর স্যারকে নতুন মেয়েটা বল্লো-

‘দেখেছেন? সবই সম্ভব যদি আপনি বিজ্ঞান মানেন, বিজ্ঞান আসলে আনন্দের। আপনি যেটা জানেন না খালি সেটাকেই ভয় লাগে। জেনে নিলেই দেখবেন সব কত সহজ’

অজগর স্যারের এসব শোনার মত অবস্থা নেই, সে অচেতনের মত কার কাছে যেন চোখ বুজে মাফ চাইছে খালি। আর ওদিকে হৈ চৈ শুনে হেড স্যার বিরাজ ভূষণ স্যার নিজে চলে এসেছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে মানহারা কেউই কিছু বললো না। নাফিসা উঠে বসে হেড স্যারকে দেখে ভয়ে আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকলো, মানহা কিছু বলতে গিয়ে টের পেলো এই কথা হেড স্যার বিশ্বাস করবে না। তাই সে বললো,

‘স্যার, আজমল স্যার বিজ্ঞান পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন, খুব জটিল একটা বিষয় পড়াচ্ছিলেন তো।'

দপ্তরীকে ডেকে এনে স্যারকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হল। ক্লাসের সবাই ভয়ের চোখে নতুন মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। সে একেবারে শান্ত হয়ে আবার মুখ নিচু করে বসে আছে। মানহা সাহস করে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

‘এই তোমার নাম কী’?

মেয়েটা মুখ তুলে তাকিয়ে মানহাকে দেখলো, তারপর হালকা একটা হাসি দিয়ে বললো- ‘চন্দ্রা’।

সেই থেকে মেয়েটার সাথে সবার খুব খাতির হয়ে গেল। খালি সেদিন আসলে কী ঘটেছিলো সেটা ক্লাসের কেউ কাউকে বলে নি, শুধু অজগর স্যার নাকি বারবার এই ঘটনা বলতে থাকায় তাকে স্কুল থেকে বাধ্যতামুলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। মানহাদের নতুন বিজ্ঞান শিক্ষক একজন ম্যাডাম। তিনি খুবই সুন্দর করে গল্প বলে বলে ওদের বিজ্ঞান পড়ান। মানহার কাছে বিজ্ঞান এখন বেশ ভালো লাগে।

১ ডিসেম্বর, ২০১৭

গোল্লাছুট, প্রথম আলো

 

 

 

No comments:

Post a Comment