Wednesday, May 3, 2017

আইপিএল

মোড়টা পেরিয়ে রাস্তাটা যেই একটু বাঁক নিয়েছে তার পাশের লাইটপোস্ট টাতে বাতি নেই আজ প্রায় মাস খানেক। কারো তা নিয়ে মাথা ব্যাথাও ণেই, ওইটুকু পথ পার হতে পকেট থেকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়েই কাজ চলে যায়, অফিস ফেরতা গৃহী মানুষ, গার্মেন্ট শ্রমিক খলখলে কিশোরী তরুণী বিনা আলোতেই দিব্যি মোড়টা পার হয়, নির্জন হলেও মোড়ের কোন বদনাম নেই। আজ সেই মোড়েই মোটামুটি আলো ঝলমলে অবস্থা। কোত্থেকে এক নাম নিশানা ছাড়া উটকো মানুষ সটান পড়ে আছে। থেকে থেকে দুই হাত পা দুইদিকে ছড়াচ্ছে আর গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।
আশেপাশের ভীড় থেকে মোবাইল ফোনের ডিজিটাল টর্চ জ্বালিয়ে সবাই তাকে দেখার চেষ্টা করছে।

-'মিরগি' বিজ্ঞের মত মন্তব্য ঝাড়ল এক মধ্যবয়স্ক।

-'জুতা হুঙ্গা, চামড়ার জুতা হুঙ্গা'- আরেকজন কে বলে উঠলো

উতসাহী বেশ কয়েকজন তাদের ময়লা কাদায় মাখা চামড়ার জুতো খুলে গোঙ্গাতে থাকা মানুষটার নাকের সামনে ধরলো। কেউ কেউ তার মানিব্যাগ নিয়ে সেটাও ধরে রাখলো লোকটার গ্যাঁজলা ওঠা নাকের সামনে। লোকটা একটু পরে পর ঘর ঘর করে শব্দ করছে। ভীড় ক্রমাগত বাড়ছেই।
এবারে আস্তে আস্তে বাড়ছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, ভিডিওও করছে মনে হয় কেউ কেউ। এমন সময় গলির কোণা দিয়ে ভীড় এড়িয়ে সুরুত করে পার হবার চেষ্টা করছিলেন পাশের জামে মসজিদ বায়তুস সুজুদ , বরকতপুর, নামাপাড়ার ঈমাম রশিদ হুজুর। হঠাত দুই মধ্যবয়সী তাকে ধরে ফেলল,

-'হুজুর, এই মানুষটা পইড়া আছে কোত্থেকে জানি। মসজিদ থেকে কিছু একটা করেন।'

-'মসজিদ থিকা কী করব? এইটা কি মসজিদের কাজ? কোইত্থেকে কী খায়া পইড়া আছে দেখেন
আগে, দেইখা মনে হয় মদ গাঞ্জা খাইসে- অস্তাগফিরুল্লা।'

-জ্বি না, এইডা মিরগি- বলল সেই আগের গম্ভীর দাড়িওয়ালা লোকটা।

পড়ে থাকা লোকটার চেহারা আসলেও ভদ্রস্থ না। মলিন একটা শার্ট- হয়ত সেটা একসময় সাদা ছিল। আর নীচের অংশ আরো ভয়ানক- লুঙ্গী! মানে নীচের শ্রেণির। এর দায়িত্ব কে নেবে?

-'দেখেন কোন মোবাইল টোবাইল, কাগজ কুগজ আছে কি না।' বল্লেন ঈমাম সাহেব।

-'না নাই'।
ভাল মত খুঁজে টুজে বলল দুই তরুণ-গার্মেন্ট কর্মী হবে হয়ত।

-'ঈমাম সাব আপনে একজন মুরুব্ব...'
কেউ একজন বলতে শুরু করতেই তাকে মাঝপথে থামিয়ে হুজুর বলে উঠলেন,

-'আরে মুরুব্বী কী করবে? এলাকায় আরো বড় মুরুব্বী আছে তো। আইচ্ছা আমি এলান করায়ে দিতাসি মসজিদ থিকা।'
বলেই আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত মসজিদের দিকে চলে গেলেন হুজুর।

মানুষজন যাচ্ছে আসছে যাওয়া আসার পথে লোকটাকে উঁকি মেরে দেখছে, এক দঙ্গল বাচ্চা কাচ্চাও জুটে গেছে, তারা একটু পর পর বয়স্কদের ঝাড়ি খাচ্ছে, একটু দূরে সরে যাচ্ছে আবার উৎসুক মুখে সামনে আসছে। মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ অস্ফুটে বলছে

-'আল্লাগো, বাঁইচ্চা আছে ব্যাডায়?'

'-কী ব্যাপার, এখানে এত ভীড় কেন?'
চৌকস পোশাকের, এ পাড়ার গরীব গুরবোদের সাথে মেলে না এমন পোশাকের এক কম বয়স্ক দম্পতি রিক্সা দিয়ে মোড় পার হতে গিয়ে ভীড় দেখে বিরক্তিতে বলে উঠলো

ভীড়ের মধ্য থেকে কয়েকজন চাপা গলায় বলতে লাগলো
- 'বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা।' কেউ জবাব দেবার আগেই মসজিদের মাইকিং শোনা গেল-

-'একটি ঘোষণা একটি ঘোষণা, নামাপাড়া শহীদুলের মোড়ে নাম পরিচয় বিহীন একটা মানুষ পড়ে আছেন, কোন হৃদয়বান ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেন। লোকটি অজ্ঞান হয়ে আছে। সে এই এলাকার কেউ না। একটি ঘোষণা...'।

স্মার্ট মধ্যপ্রদেশে স্ফীত সুখের উদয় হচ্ছে এমন চেহারার সুবেশী ছেলেটা মনে হল আরো বিরক্ত হল ঘোষণা শুনে।

-'আহ কেউ একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না, কতক্ষণ ধরে পড়ে আছে এই লোক?'

- 'এক ঘন্টা হইয়া গেছে- কে জানি বলল'

-'এক ঘন্টা?-মেয়েটা এবারে মুখ খুল্ল
- ও গড।' বাক্য শেষ করল সে।

কই দেখি তো, বলে এগিয়ে এল এবারে ছেলেটা বিরবির করে কী জানি একটা বলল এলাকা নিয়ে। এইরকম এলাকায় তার থাকার কথা না বা এই ধরনের কিছু।

-'হুম, একেবারে স্ট্রিট বেগার টাইপ। ওকে সবাই সরেন। সিমস লাইক এপিলেপটিক কেইস, দাঁড়ান।আমি একটা ছবি তুলে নেই। '

মেয়েটাও রিক্সা ছেড়ে নেমে এল, মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল- 'গ্রেট, আমিও এটাই ভেবেছিলাম, তুমি জলদি ফেইসবুকে দাও, তোমার যে পরিমাণ ফলোয়ার, আমি দিলে কিছু হবে না, নাইলে আমি-ই দিতাম।'

আশে পাশের তুলনামূলক গরীব শ্রেনীটা একটু সিঁটিয়ে দূরে গেল। ছেলেটা একটু ঝুঁকে ছবি তুলতে গেল তখনই লোকটা আবার হাত পা ছড়িয়ে গোঙ্গানী শুরু করল, ছেলেটা আঁতকে উঠতে গিয়েই সামলে নিয়ে একটু অস্বস্তির কাশি কেশে আবার স্মার্টলি ছবিটা তুল্ল। এবারে রিক্সায় উঠতে উঠতে সে ফেইসবুকে ছবি পোস্ট করে স্ট্যাটাস লিখতে লাগলো।
একটু ভেবে লিখতে হবে। তার নিজের একটা ব্র্যান্ডিং আছে ফেইসবুক সেলিব্রেটি হিসেবে, পোস্টটা যেন শেয়ার হয় বেশী। পাশের মেয়েটা কাঁধের ওপর দিয়ে তার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে, রিক্সাটা ওদের নিয়ে মোড় ক্রস করে চলে যেতেই ভীড়টা আবার কাছিয়ে এল।

এমন সময় আবার একটা হুল্লোড় উঠলো পরের মোড়ের চায়ের দোকান থেকে চিতকার শোনা যাচ্ছে, আইপিএল এর ক্রিকেট খেলা চলছে। বলে বলে বাজী ধরা হচ্ছে। টানটান উত্তেজনা। চিতকার শুনে ভীড়ে থেকে কম বয়সী কিশোরেদের কয়েকজন ছুটে সেদিকে চলে গেল।

হঠাত আবার একজনকে দেখে গেল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ছুটে আসতে,

-'কী হইসে অ্যাঁ? কী হইসে দেখি সরেন সরেন।'
এলাকার সাংবাদিক আজাদ সাহেব , মূলতঃ একটা নিবন্ধন বিহীন অনিয়মিত ম্যাগাজিনের রিপোর্টার, সদ্য অনলাইনে একটা নিউজ সাইট খুলে সেটাতে বিভিন্ন সাইট থেকে রগরগে খবর কাট পেস্ট করে চলে, এলাকায় সাংবাদিক হিসেবে তার প্রবল দাপট। অশিক্ষিত স্থানীয় প্রভাবশালীরাও বেশ সমঝে চলে তার চালিয়াতিকে।

-'সাংবাদিক সাপ, ওই সাংবাদিক সাপ আইছে।' অজান্তেই উচ্চারণ বিভ্রাটে উলটো সঠিক শব্দেই তাকে সম্বোধন করে একজন।

-'এই লোক এইখানে এতক্ষণ পইড়া আছে আর আমাকে কেউ জানান নাই? এইটা মিডিয়ায় দিলে কী হবে জানেন? পুলিশ কেইস বোঝাই যাইতেছে, পুলিশ কেস। কে কে দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া দেখছেন সবার লিস্ট করতে হবে, সবার নাম থানায় যাবে। একটা লোক মরে যাচ্ছে আর সবাই দেখতেছে, কেউ মিডিয়াকে খবর দেয় নাই! এই মুর্খের দল দিয়া কী হবে? এই জন্আযেই দেশতার এই অবস্থা! এখনই থানার ওসিকে কল দিচ্ছি, আর কয়েকটা চ্যানেল, ফোন দিল পর দেখেন কী হুলুস্থুল হয়!'

সাংবাদিক সাহেবের হম্বি তম্বিতে সবাই সিঁটকে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সাংবাদিক তার বুক পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করে ডাকা শুরু করলেন। একের পর এক ফোন করলেন, এক ফাঁকে লোকটার একটা ছবি তুলে নিয়ে আরেক দফা সবাইকে ঝাড়ি দিয়ে দ্রুত থানায় সশরীরে জানাতে ও নিউজ পোর্টালে খবরটা দিতে চলে গেলেন। সবকিছুর মধ্যে লোকটা গোঙ্গানী থেমে থেমে একটা অদ্ভূত উদারায় চলে যাচ্ছে। ভীড়ের অনেক চলে যাচ্ছে আবার কিছু নতুন মুখের উদয় হচ্ছে,

হঠাত এমন সময় বাইকের হর্ণ শোনা গেল। বাজখাঁই গলায় কিছু অশ্রাব্য গালাগাল,

-...র পুতেরা রাস্তার মইদ্যে কি? হালারা রাস্তার মইদ্যে কী?' আলাল। এলাকার মাস্তান। সব এলাকাতেই যেরকম পাড়াতো কেউ থাকে আর কি। তাকে দেখেই সেই মিরগি রোগ নির্ণায়ক লোকটা আস্তে করে কেটে পড়লো। আর স্যান্ডেল শুঁকাতে থাকা কম বয়সী এক ছেলে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল
- 'আলাল ভাই, মিরগি হইসে।' আলাল তার বাজাজ বাইকটা রাস্তার কিনারে পার্ক করে চোখ কুঁচকে নামলো।

-'ভাই-'
ওই ছেলে আবার বলতে যেতেই হাত তুলে তাকে থামালো আলাল- খাড়া! এ কোইত্তে আইসে?

-'জানি না ভাই,'

-'মরার আর জায়গা পায় না, মিরগি তরে কইসে ক্যাডা? এইডা তো ইশটক মনে হইতাসে। তো তরা খাড়ায়া খাড়ায়া দেখতাসোস? হালা ...র পোলারা । মা...।

-'ভাই খেইপেন না ভাই।'

আলাল আসার পর ভীর আস্তে আস্তে পাতলা হচ্ছে,

-'কতক্ষণ পইড়া আসে অ্যায় ?'

-'ভাই এক ঘন্টা'
সাথে সাথে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিলো আলাল তার গালে। ...য়ার পোলা, একঘন্টা ধইরা খাড়ায়া রঙ দেহস? এই লোক তো মরব। বলেই সে কতক্ষণ আবার অশ্রাব্য গলায় কী কী বলা শুরু করল। পেছন দিকে ঈমাম সাহেবকে আবার দেখা গেল গলা বাড়িয়ে আলালকে দেখেই আবার সুট করে মসজিদের মধ্যে ঢুকে গেলেন। 

-'ধর লোকটারে ধর, হালার ভাইরা ভাত খাস না? দুই ঠ্ছযাং ধর, এক ঠ্যাং তিনজনে ধরসস ক্যান? ছয়জন মিল্যা এই ক্যাঙ্গারুরে তুলবার পারস না, ল আমি মাতা ধরি, ওই রিক্সা, ওই বান্দির পুত, প্যাসিঞ্জার নামা, নামা তর প্যাসিঞ্জার!' 
ধীরে সুস্থে আসছিলো এক রিক্সা তাতে এক মোটাসোটা লোক, আলালের কথা শুনে সে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল, আর রিক্সাওয়ালা এসে লোকটাকে ধরে রিক্সায় তুলল।

-'হুন, দুই জন এরে লয়া ডাইরেক রোডের মাতায় যা, আমি আইতাসি বাইক লয়া।'

মুহূর্তের মধ্যেই রিক্সা করে ক্ষীণ স্বরে গোঙ্গাতে থাকা এখনো বিস্ময়করভাবে জীবিত লোকটাকে নিয়ে চলে গেল, পিছন পিছন খিস্তি করতে করতে আলাল তার পুরোনো বাজাজ মোটর সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো।
হঠাত করেই ভীড় আবার পাতলা হতে লাগলো, বেশীরভাগ লোকই আইপিএল চলতে থাকা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। মহিলারা আগেই ভেতরে চলে গেছে। আস্তে আস্তে ঈমাম সাহেবকে আবার দেখা গেল রাস্তায়, গুটিকয় দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের জিজ্ঞেস করলো
-'নিয়া গেছে লোকটারে?'
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো কয়েকজন
-'আলাল ভাইয়ে নিয়া গেসে।'
-'আলাইল্যা?।'
-'হ।'
-'যাউক।'


No comments:

Post a Comment