চণ্ড রোদ
শহর ঢাকায় পুরো দাবদাহ।
সরলরেখার মত টানা রাস্তার দিকে নিষ্পলক তাকালে হঠাৎ ঘোর লাগে, মনে হয় যেন আঁকা
বাঁকা কালো কোন থির ক্লান্ত নদী সোজা বয়ে গেছে। কিলবিলে মানুষগুলো হঠাৎ হয়ে ওঠে কচুরিপানা, বাসগুলো সব ভটভটি ট্রলার, প্রাইভেট
কারগুলো ছোট কোষা নৌকা। রঙ্গিন বিলবোর্ডগুলো হঠাৎ বর্ণিল মেঘ হয়ে যায়। অদ্ভুত এক বিষাদ নেমে আসে অকারণ। কূৎসিত কাকগুলো
বউ-কথা-কও এর মত রূপসী সাজে উড়তে থাকে।
ঘোর কেটে যেতে
অবশ্য সময় লাগে না। সব আবার আগের মত সহজ স্বাভাবিক হয়ে আসে। ডানদিকে হোটেল
শেরাটনের সারি দেয়া মুঘল কায়দার জানালা বামদিকে সাকুরা বারের থাই অ্যালু গ্লাসে
আটকা পরা উলটো দিকের তুলো মেঘ। তার ঠিক ওপরে আকাশের অনেকখানি ঢেকে দিয়ে একটা
বিলবোর্ড; তাতে কিছু রঙচঙ্গে তরুনি হাতে কোকাকোলার বোতল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে
আছে।
‘আমরা সেল হয়া
যাইতাছি বুঝলি?’ আবদাল প্রায়ই বলত কথাটা।
আসলেই কি তাই?
শহর ঢাকার কোটি খানেক মানুষ দিয়ে কি ‘আমরা’ বোঝায়? কি জানি। আবদালের সাথে প্রায়ই এ
সব নিয়ে তর্ক হত। যথারীতি এক পর্যায়ে আমার হার হত; যদিও দু’জনেই জানতাম এ সব
হারজিত কতটা অর্থহীন। তর্ক শেষ হবার পর দু’জনেই আবার চুপ হয়ে যেতাম যেন কোথাও কিছু
ঘটেনি কখনো।
আবদাল অবশ্য
বেশিক্ষন চুপচাপ থাকতে পারতো না- গান ধরত। সেসব গানের কোন অর্থ হয় না। শুধু কিছু
নাদ যেন এলো তালে ওঠা নামা করছে। আবদালের গলা ভাল বলে সবকিছু উৎরে যেত। ঢাকার সীসাজীর্ণ বাতাসে ওর গান অনায়াসে মিশে যেত। সন্ধ্যা নামতে গেলে ও
চোখ কুঁচকে ফিরোজা-লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ত-
‘বলত এই
সন্ধ্যাটা এমন মন খারাপ করে দেয় কেনো?’
কে জানে বাপ
কেন, আর তাতে কি-ই বা যায় আসে? মুখে বলি-
‘কি জানি’
আবদালও এরপর আর
উচ্চবাচ্য করতো না।
বড়জোড় সাতটা (pm)-আমরা উঠে
পড়তাম। হাঁটতে হাঁটতে কারোয়ান বাজার (নাকি কাওরানবাজার?) সেখান থেকে একটু হেঁটে পেছনে-জনতা
টাওয়ারের পেছনে। এটা নাকি একটা
স্পট। কি না পাওয়া যায়। টাকা দিলে মানুষের বাচ্চা ভি। আমরা এখানে কেন আসি আমরা
জানি না। মাঝে মাঝে ভাবি- এইবার একটা মার কাট লাগিয়ে দেব। একের পর এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট
লিখে পত্রিকায় প্রতিবেদনে এই শহরের দুর্গন্ধময় দিকটা সব সুক্ষ রুচির গোলাপী
শিক্ষিতদের সামনে মেলে ধরি। (গোলাপী শিক্ষিত শব্দটা আবদালের দেয়া, এ ধরনের আরো কত
শব্দ যে ও বানিয়েছে।) আসলে কিছুই করা হয় না। শুধু ভাবনা চিন্তাই সার।
আমরা হাঁটতে
হাঁটতে মাছের আড়তের আঁশটে গন্ধ মাখা রাস্তাটায় চলে আসি। ডানে আকাশ্চুম্বি বিজিএমইএ’র
বিল্ডিং-বেগুনবাড়ি খালের মাঝখান থেকে খাড়া উঠে গেছে, যেন আদিকাল থেকেই ওটা ওখানে
ছিল, ওখানেই থাকবার কথা। খালটাই যেন হঠাৎ পথ ভুলে এদিকে ঢুকে গেছে।
‘খালগুলাই অবৈধ
বুজলি?’ বলে আবদাল।
হবেও তাই, এই
ঝাঁ চকচকে ফরেন-গন্ধী সেন্ট্রাল এসি ও চিকেন ব্রোস্ট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, সিনেপ্লেক্স,
নকিয়া এন সিরিজ- ইত্যাদির মধ্যে জ্বলজ্যন্ত একটা খাল কিভাবে ঢুকে পরে?
সামনে হাতিরঝিল
এর নিকষ কালো পানির ওপরে কিছু উঁচু বাশের তৈরি ঘরবাড়ী। এগুলিও অবৈধ- এদের রাজউক থেকে
প্ল্যান পাশ করানো নেই। তার ঠিক উলটো পাশে হোটেল হিল্টনের জন্য ‘সাইট ফর’
সাইনবোর্ড টানানো। আর ঝিলের সামনে বিরাট এক সাইনবোর্ডে গুগল আর্থ থেকে নামানো ঢাকার ম্যাপ এ চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বর্ণনা। ঢাকাই
নবাবদের হাতিদের গোসলখানায় এবার বৈধ রাস্তা হতে যাচ্ছে। টানা রাস্তা উঠে যাবে ওই
যে সোজা একচোখা দানোর চোখের মত লাল রঙ্গা রামপুরা টিভি টাওয়ারের বাতিটা দেখা
যাচ্ছে- সেই দিকে।
আমরা বাঁয়ে
তাজউদ্দিন সরণিতে ঢুকে পরি। এসকয়্যার এর শো-রুমের সামনে সেই পাগল মহিলাটা এখনো
আছে। নিবিষ্ট মনে সারাদিনের কুড়োনো ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ের টুকরোগুলো সেলাই করে যাচ্ছে।
গত ৬ বছর ধরে একে এক জায়গাতেই এভাবে দেখছি। প্রতিদিন একইভাবে কাপড় সেলাই করে।
এতদিনে বিরাট এক শামিয়ানা হয়ে যাবার কথা। দিনেরটা সে দিনেই কোথাও ফেলে টেলে দেয়
বোধহয়। একে সুঁই সুতো কে কিনে দেয় সেটা আমার খুব জানবার ইচ্ছা করে। আবদালকে বলতেই ও সোজা মহিলার দিকে এগিয়ে গেল।
‘কাপড় বেচবেন?’
জানতে চায় আবদাল।
মহিলা শুন্য
চোখে তাকায়, বিড়বিড় করে কি একটা বলে আবার সেলাই করতে থাকে- যেন শুনতেই পায়নি।
‘আপনারে এইসব
কাপড় দেয় কে?’ আবদাল আবার জানতে চায়।
মহিলা সেই
একইভাবে সেলাই চালিয়ে যায়। আবদাল আর কিছু জানতে চায় না। আমরা আবার হাঁটতে থাকি।
সেই চেনা
রাস্তা।
ভাগ্যকূল
মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, ২টাকা মিনিটে কথা বলার নির্ভরতা, আদর্শ ভল্কানাইজিং, চিরবিদায়
স্টোর (সামনে দাঁড়া করানো একটা স্যাম্পল কফিন। সাইনবোর্ড এর নিচে ছোট করে
লেখা- ২৪ ঘন্টা খোলা।)। একটু সামনে নকশি
কাটা ফুটপাথের কনকৃট ব্লক ঢেকে দিয়ে পড়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা কাঠগোলাপ, ভুমি জরিপ
অধিদপ্তরের ভেতর থেকে ঝাঁকরে উঠেছে গাছটা। ঝালমুড়ি বিক্রেতা ছেলেটা পসরা ফেলে
গ্রিলের দোকানের ছেলেটার সাথে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মেতেছে। সাতরাস্তা মোড় চলে
এলাম। আমি প্রায় দিনই এখানে এসে সত্যি সত্যি সাতটা রাস্তা আছে কিনা সেটা মেলাবার
চেষ্টা করি। এই ছেলেমানুষি চেষ্টার কোন যুক্তি নেই তারপরেও- সবসময়ই মনে একটা ক্ষীণ
আশা থাকে যে একদিন মিলে যাবেই। শৈশবের কোন একদিন আমি কিভাবে যেন একদিন সাতটা রাস্তা
মিলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই এখোনো মনে হয় আমি গোনায় কোন একটা ভুল করছি। হঠাৎ কোন দিন আবার
গুনে মিলয়ে ফেলতে পারব।
ঘরফেরতা
গাড়ীঘোড়ার ভীড় ক্রমেই বাড়ছে। ঠিক মোড়টার মাঝখানে দাঁড়ালে কেমন দিশাহারা লাগে। এতোগুলো
রাস্তা থেকে এতোরকমের গাড়ী আসে। আবদাল
এইরকম ব্যস্ত রাস্তা পার হবার একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছে- কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা
হাঁটতে থাকো গাড়ীগুলো তখন বুঝে নেবে সাবধানতা যা নেবার তাকেই নিতে হবে। তারা তখন
তোমাকে বাঁচিয়ে গাড়ী চালাবে। আবদাল হঠাৎ আড়াআড়ী ভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হয়, একটা
পাঁচটনি ট্রাক সজোরে হর্ন বাজাতে বাজাতে প্রানপন ব্রেক করে। মুখ বের করে ঘর্মাক্ত
ড্রাইভার বিশ্রী খিস্তি ঝাড়ে। আবদাল ওই পাড়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সেগুলো শোনে। আমি
ধীরেসুস্থে রাস্তা পার হই। আবদালকে এ ব্যপারে কোন প্রশ্ন করি না। এটা ওর জন্য নতুন
কিছু না। জিজ্ঞেস করলে বলবে-
‘এইভাবে করলে
মাঝে মাঝে বোঝা যায় যে বেঁচে আছি বুঝলি?’
আমি এ ব্যপারে
ওকে দোষ দি’ না। আমিও তো মনে মনে ওই সাতটা রাস্তা মেলাতে চাই কারণ নইলে ঠিক টের
পাই না বেঁচে আছি কি না। আমার চেষ্টাটা নির্দোষ আর সেটা করি মনে মনে এই যা।
আমরা আবার
হাঁটতে থাকি।
আবার সেই চেনা
রাস্তা।
পলিটেকনিক,
বিজি প্রেস, লাভ রোড, তিব্বত, নাবিস্কো...
হলদে সোডিয়ামের
আলোয় পিচের বর্ণ কেমন যাদুকরি সোনালী হয়ে ওঠে এবার। মাঝখানের
চুনসাদা রেখাগুলো (দিনের প্রচণ্ড রোদে যেগুলো এঁকেবেঁকে গেছে) দেখে হঠাৎ জলসর্প
বলে ভ্রম হয়। জেব্রাক্রসিংগুলো যেন তিরতিরে ঢেউ। এবার আর ঘোর কাটে না। ল্যাম্পপোস্ট
গুলো হঠাৎ মাছ ধরার জালি নৌকা হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশটা যেন কোন বৃদ্ধ জেলে। হাত
নেড়ে নেড়ে অন্য নৌকাদের পথ দেখাচ্ছে। আশপাশের ইন্ডাস্টৃগুলো হঠাৎ গাছপালা বলে ভ্রম
হয়। গোটা রাস্তাটা নদী হয়ে যায় আবার।
আমরা সেই নদীতে
হাঁটতে থাকি।
০৬.০৫.০৬
No comments:
Post a Comment