খবরের কাগজে নাকি আমার মৃত্যুর সংবাদ
বেরিয়েছে কাল!
আমি খবরের
কাগজ রাখি না, পড়িও না। খবরটা আমি নিজে দেখি নি। তাই বিশ্বাস করব কি না ভেবে ঠিক
করতে পারছি না। আমাকে ব্যপারটা বলল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ইমন। আজ সকালে নাস্তা
করবার জন্যে যখন ডিম রুটি আর এক প্যাকেট ম্যাচ কিনবার জন্যে রাস্তা পার হচ্ছিলাম
আগামসী লেনের সর্বশেষ গলিটা দিয়ে, নিচে জড় করে রাখা এক গাদা ময়লা কংকৃটের টুকরো
পেরোতে ছোট এক লাফে সামনে এগোতেই ইমন যেন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে উদয় হল। আর এসে কুশল
টুশলের ধারে কাছে না গিয়ে সরাসরি বলে বসলো, ‘কিরে তুই এখানে? কাল যে পেপারে ছাপা
হল তুই মারা গেছিস?’ মানে কি জানতে চাইলে সে জানালো কোন একটা দৈনিক পত্রিকায় (যায়
যায় দিন বা প্রথম আলো অথবা বাংলাবাজার
এ) শেষ দিকে ছোট্ট করে বক্স নিউজ করা হয়েছে যে আমি হৃদযন্ত্রের কৃয়া বন্ধ হয়ে মারা
গেছি। ঘটনাটা কি? ইমন জানতে চায়। আমি তাকে বোঝালাম ঘটনা যাই হোক আমি আসলে মারা
যাইনি, মারা গেলে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। ইমনকে তাও পুরোপুরি সন্তুষ্ট মনে
হল না। সন্দেহের চোখে ‘ঠিক আছে ভালো থাকিস’ ধরনের কিছু একটা বলে সে চলে গেল হাত
মিলিয়ে। আমি আবার ডিম রুটি ও এক প্যাকেট ম্যাচ কিনবার জন্যে হাঁটা দিলাম। খেয়াল
করলাম ধীরে ধীরে প্রচন্ড রাগ ঠেলে মাথার ওপরের দিকে উঠছে। আমার মৃত্যুর সংবাদ
আমাকে না জানিয়ে কেন ছাপা হল সেটা ভেবে অসম্ভব বিরক্ত লাগা শুরু হল। ডিমের
দোকানীকে অযথাই ধমকে কথা বলে ডিম পঁচা হলে যে আবার ফেরৎ- সেটা চেঁচিয়ে শুনিয়ে
দিলাম। ফিরবার সময় দু’জন পথচারীকে সবেগে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলে দেবার জোগাড়
করলাম। তার মধ্যে একজন বৃদ্ধ মতন অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাতেই উনি কি চোখে দেখতে পান
কি না তা ঝাঁঝের সাথে জানতে চাইলাম। অন্ধ
রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি আমার ৩৪ এর বি নাম্বার দালানের তিন তলায় উঠলাম। তালা খুলতে
খুলতে ভাবলাম, খবরটা আর কেউ দেখেনি এখনো? আর কেউ দেখলে কি হবে? আমার বন্ধুরা? আগের
অফিসের কলিগেরা? যেমন শওকত সাহেব? দারোয়ান মামুন? বা আমার বাড়িওয়ালা সেলিম সাহেব?
ভাবতেই হঠাৎ করে চনমনে লাগা শুরু হল। তালা খুলতে খুলতে আমি চোখের সামনে তাদের
প্রত্যেকের বিহ্ববল মুখ দেখতে পেলাম। শওকত সাহেব খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে আফসোসের
ভংগিতে মাথা ডান বাম নাড়ছেন আর তার সহকারী সাত্তারকে বলছেন, দেখছেন? এরে চিনতেন
না? এই যে? মারা গেছে। দেখে সাত্তারও তার মুখভঙ্গীর ভান্ডার থেকে দুঃখ দুঃখ ভাবটা
বের করে এনে বলবে, আহারে। জানি এই আফসোস কারই বেশীক্ষণ থাকবে না। তাও কেন যেন
ভাবতেই পুলক বোধ করলাম। ডিম ভাংতে ভাংতে ভাবলাম আরো কিভাবে এটা সম্পর্কে খোঁজ নেয়া
যায়। মানে আর কেউ জানে কি না। এটা নিশ্চই ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না যে, ভাই আমি
যে মারা গেছি সেই খবরটা দেখেছেন? দেখেননি? সে কি দুই কলামে বক্স নিউজ... হ্যাঁ
হ্যাঁ আমি-ই তো। এটা নিশ্চই বুদ্ধিমানের মত কথা না। তাহলে? এমনিতে ফোন দেয়া যায়।
কুশল জানতে। কেউ খবরটা দেখে থাকলে সে-ই বলবে- আরে তুই? (বা তুমি বা আপনি) মারা যাসনি
(যাওনি/ যান নি) তাহলে? শুকনা মরিচ খুঁজতে খুঁজতে আমি আজকের দিনের একটা মোটামুটি
ছক করে ফেলি। একটা লিস্টি করে নিতে হবে, কাকে কাকে ফোন দেব ও কি বলব। অনেকদিন পর
মন বেশ ফুরফুরে লাগা শুরু করল। নিজের মৃত্যু সংবাদ যে এমন মজাদার হবে আগে ভাবি নি।
আমি ধীরে সু্স্থে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ডিমভাজি খেতে থাকি ও কাদেরকে ফোন দেয়া যেতে পারে সেই তালিকা মাথায়
সাজানো শুরু করি। প্রথমে আবদাল। ব্যটার চেহারা কেমন হবে ভেবে তক্ষুনি হেসে ফেল্লাম।
এমনিতেই তার মধ্যে সবসময় প্রবল আতংক কাজ করে। তার একটা অদ্ভুত ধারনা আছে যে শহরের
কোথাও কোন একজন গুপ্ত ঘাতক তাকে মেরে ফেলার জন্যে অপেক্ষা করছে। কেন কোন গুপ্ত ঘাতক
তাকে মেরে ফেলবে এটা অবশ্য সে-ও জানে না। তার কথা ইচ্ছে করে মারবে না, অন্য কাউকে
মারতে গেলে ভুল করে তাকে মেরে ফেলবে। সে তাই তার আশেপাশের প্রায় সব মানুষদের
সন্দেহের চোখে দেখে। আচ্ছা আবদাল গেল তারপর? মাহমুদ? উম... ...মাহমুদ... হতে পারে।
এরপর সাদিক, মুন্তাসির... না মুনতাসির না। জয়ন্ত। হ্যাঁ আপাতত এ-ই। আসলে আমার
পরিচিত লিস্টি অত বড় হবেও না আসলে। প্লেট ধুতে ধুতে মনে মনে ইমনকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর জন্যেই দিনটা
এমন দারুণ দিকে মোড় নিল হঠাৎ। ধীরেসুস্থে বসে আবদালের নাম্বার ডায়াল করলাম আমার পুরোনো
ঘটঘটে এনালগ ফোনে...। রিং হচ্ছে... আবার... হচ্ছে... ... এবং হচ্ছেই। ব্যটা ধরছে
না। আবার ডায়াল দিলাম... ... ... আবার রিং হচ্ছে...
নাহ... ধরছে
না। মজাটা বোধহয় নেয়া গেল না। যাক গে আবার ফোন দেয়া যাবে। লিস্টের নাম্বার দুইএ
যাওয়া যাক। মাহমুদ। মাহমুদ একটা বিদেশী সফটোয়ার ডেভেলপমেন্ট ফার্মে কাজ করে। যতবারই
দেখা হয় ততবারই সে আমাকে শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে বলে। আমি প্রতিবারই হুঁ হাঁ করে
কাটিয়ে দেই। ফোন দিয়ে দেখা যাক...
রিং হচ্ছে...
আবার...
-
হ্যালো?’
মাহমুদের
বিরক্তি জড়ানো কন্ঠ শোনা গেল।
-
হ্যালো।
-
কি রে কি অবস্থা?
-
এইতো
-
টিএন্টি নাম্বার দেখলেই আজকাল ধরি না রে। কে না কে। খালি তোরটা সেইভ করা আর
তুই ছাড়া তো এই নাম্বার থেকে আর কেউ ফোন করবে না তাই ধরলাম। অনেক ঝামেলায় আছি রে।
কি বলবি বল।
অনেকটা দমে
গেলাম, না। ও আমার সংবাদটা জানে না। বোঝাই যাচ্ছে
-
কি রে? কথা বলিস না ক্যান?
-
হুঁ এই তো, কেমন আছিস জানতে ফোন দিলাম।
-
আর থাকা, শেয়ারে নেমে রাম ধরা খাইলাম। তুই ভালই করছিস ইনভেস্ট না করে।
শালার, পুরা মানিক চিপা। উঠাইতেও পারতেছিনা, বেইচা দিতেও পারতেছি না আর... ...
(এরপর প্রায় আধা ঘন্টা আমাকে মাহমুদের শেয়ার বাজার ধরা খাবার গল্প শুনতে হল, সত্যি
বলতে আমার মেজাজ মহা খাপ্পা হয়ে গেল। একে সে অকারণ বকরবকর করে যাচ্ছে আমাকে কথা
বলার সুযোগ না দিয়ে আর দুই, সে আমার নিউজটা দেখে নি...)
-
মাহমুদ
-
কি?
-
রাখি রে- বলেই ঠকাস করে ফোনটা ক্রেডলে ঠুকে দিলাম।
মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হয়ে আছে।
ঠিক বুঝতে পারছিনা পরের
ফোনগুলো করা ঠিক হবে কি না।
আর কে... আর কে... লিনা?...
লিনাকে ফোন দেব? বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এতদিন পর। এমন একটা বাজে কারণে। রীতিমত অসুস্থ
দেখাবে কাজটা। নাহ। হেঁটে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। ৩৪ এর বি বাড়িটার নাম কা
ওয়াস্তে এক চিলতে বারান্দা। এদিকে এখনো কিছুটা খোলা আছে, তবে বেশিদিন থাকার না আর।
অলরেডি ডেভেলপমেন্ট এর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে ছায়ানীড়
ডেভেলপার্স, যেন স্বপ্নের ছোঁয়া। বিল বোর্ডে দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা ঘাসযুক্ত
প্রান্তরে সদ্য বিবাহিতা এক দম্পতি স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে। সেই ঘাসের সীমানা
ছাড়িয়ে দূরে আইফেল টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। রীতিমত উত্তরাধুনিক বিলবোর্ড, ডিজাইনার মনে
হয় শেষের দিকে দিগন্ত ভরাতে আইফেল টাওয়ারটা বসিয়েছেন। অথবা স্বপ্ননীড় এর মালিক এমন
কিছু চেয়েছেন। সাইটে এখন পায়েলিং চলছে বিরাট এক লোহার পিলারকে শর্বশক্তিতে ‘ও আমার
দেশের মাটি’র ভেতরে পোঁতা হচ্ছে। কিছু চিমসা মুখের লেবার গা হাত পায়ে কাদা মেখে
কাজটা দেখছে। তাদের পরণে লুঙ্গী গেঞ্জী হলেও হাতে রাবারের বিদেশী গ্লোভস আর মাথায়
হলুদ একটা হেলমেট। নিরাপত্তার চুড়ান্ত। পেছনে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে কালোর মধ্যে
সাদায় লেখা ‘নিরাপত্তাই প্রথম’। সাইটের ঠিক মাঝেই একটা প্রাচীন আমগাছ ভীতভাবে
দাঁড়িয়ে, সে নিশ্চই বুঝতে পারছে যে কোন সময় তাকে কেটে ফেলা হবে। আমগাছটার ওপর একটা
কাকের বাসা, তাতে বাবা অথবা মা কাকটা তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে, নিশ্চই সেও বুঝতে
পারছে ব্যাপারটা। বাসাটায় কয়েকটা নীলচে ডিমও দেখা যাচ্ছে। এসব কিছু দেখতে দেখতে
আমি আমার নিজের মৃত্যু সংবাদ ভুলে যাই। প্রতিদিনকার মত সেই বারবার দেখা ঘটনাগুলির
ধারাবাহিকতা বজায় আছে কি না সেটা বরং খুঁজে বার করতে থাকি। যেমন রাস্তার ওপাড়ে
ফুটপাথের ধারে বসা অন্ধ ভিখারীটা আজকেও বসেছে কিনা, ডাস্টবিনের কাছে সেই কোথাকার
কোন বাড়ির এক পিচচি কাজের মেয়ে নাকে কাপড় চাপা দিয়ে ময়লার ব্যগটা ঠিক ১২ টায় ছুঁড়ে
মারলো কি না। কান ইয়ার ফোন গোঁজা থুতনীতে দাঁড়ি নিয়ে সেই চ্যাংড়ার দলটা হৈ হৈ করে
চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ধরালো কি না। সামনের গোলাপী দালানের ছাদে সেই তরুনী উঠে
কানে সেলফোন গুঁজে পায়চারী করতে করতে কথা বলল কি না। এসব দেখতে দেখতে আমি এবার
অনেকটাই আমার মৃত্যুর কথা ভুলে যাই। এই এতসব ঘটনার মাঝে আমার মৃত্যুসংবাদটা চাপা
পড়ে যাওয়াতে বরং খুশি-ই হই। এ শহর কত যত্নে আমার মৃত্যুসংবাদ সবার থেকে আড়াল করে
ফেলল তা ভেবে রীতিমত কৃতজ্ঞ বোধ করতে শুরু করি। নিচ একটানা ডেকে যাওয়া বাবা কাকটার
দিকে তাকিয়ে বলি- অনেক ধন্যবাদ।
০৫।০৫।১২
No comments:
Post a Comment